বাঁকুড়া, 28 মে : কাঁসা পিতলের ঢং ঢাং আওয়াজে ঘুম ভাঙত গ্রামবাসীর । শিল্পীর অসামান্য কারিগরীতে তৈরি করা বাসন রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিত ৷ জাহাজে করে অন্য দেশে রফতানি হত ৷ কাঁচামাল আমদানি হত লরি ভর্তি করে । চাহিদার চাপে নাওয়া খাওয়ার সময় জুটত না । দিন রাত জেগে কাজ করে বরাত তুলে দিতে হত ব্যবসায়ীর হাতে । এখন সেসব অতীত ৷ বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি কারখানা চলছে নমো নমো করে । কোনওরকমে দিন গুজরান করছেন কাঁসা পিতল শিল্পীরা ।
কথা হচ্ছে বাঁকুড়ার কাঁসা পিতলের শহর নামে পরিচিত কেঞ্জাকুড়ার । কেঞ্জাকুড়া জুড়ে ছিল 300টি ছোট বড় কাঁসা পিতলের বাসন তৈরির কারখানা । বংশপরম্পরায় কাঁসা পিতলের বাসন তৈরি উপর নির্ভর করেই কেঞ্জাকুড়ার শিল্পীদের জীবন চলত । এলাকার দু থেকে আড়াই হাজার মানুষ কাঁসা পিতলের বাসন তৈরি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৷ কেঞ্জাকুড়া শিল্পীদের তৈরি কাঁসা পিতলের বাসনের চাহিদা দিন দিন কমে আসছে । কাঁচামালের চড়া দাম, পুঁজির অভাব, চাহিদার কমতি, সবে মিলে এখন প্রায় ধুঁকছে কাঁসা পিতল শিল্প ।
কারখানা বন্ধ হতে হতে এখন 50টিতে ঠেকেছে । তাও প্রতিদিন কাজ হয় না । হাতে গোনা কয়েকজন সপ্তাহে দু তিনদিন কাজ করে কারখানা খোলেন । অন্যদের সকালবেলা কারখানা খুলে ঠাকুরকে ধূপ দেখানো আর বন্ধ করা, এই যেন রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
আরও পড়ুন : গঞ্জ রইল, ফ্রেজার সাহেবের স্মৃতি চলে গেল সমুদ্রগর্ভে
কারণ যে শুধু লকডাউন তেমনটা নয় । এক দশক আগেও কাঁসা পিতলের বাসনের বহুল ব্যবহার ছিল জেলা এবং জেলার সীমানা পেরিয়ে রাজ্য এবং বিদেশের বাজারে । বাড়িতে দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহার হত কাঁসা পিতলের বাসনপত্র । আত্মীয় কুটুম্ব এলে কাঁসা পেতলের থালা বাটিতে খাবার দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল গ্রামবাংলায় । কিন্তু সেইসব আজ অতীত । কাঁসা পেতলের বাসনের জায়গা নিয়েছে স্টেনলেস স্টিল, ফাইবার, চিনামাটির বাসন । আজ কাঁসা পিতলের বাসনের কদর কমেছে । কাঁসার পিতলের বাসন এখন পুজোর কাজে কিংবা বিয়েতে কাঁসার বাসন যৌতুক হিসাবে বরপক্ষকে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে জেলার অনেকাংশেই । কিন্তু করোনা অতিমারির প্রভাবে কার্যত লকডাউনের জেরে নমো নমো করে হচ্ছে বিয়েবাড়ি, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন সহ সামাজিক অনুষ্ঠান ।
সকাল দশটার পর দোকানপাট ও যানবাহন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । যাতায়াতের সমস্যায় গত দু'বছরে কাঁচামালের দ্বিগুণ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে । কাঁসা পিতলের বাসন তৈরি মূল উপাদান তামা, যার দাম প্রতি কেজি 400 টাকা ছিল ৷ এখন তা বেড়ে হয়েছে 700 টাকা । অন্যান্য কাঁচামাল রাংতা, দস্তার দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে । এদিকে চাহিদার অভাব । ফলে শেষের মুখে বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী কেঞ্জাকুড়ার কাঁসা পিতলের বাসন শিল্প । এ প্রজন্মের কেউ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না । প্রচন্ড কষ্ট, চাহিদা নেই, পুঁজির অভাব । অনেকেই লেখাপড়া শিখে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন ।
আরও পড়ুন : দুয়ারে ত্রাণ নিয়ে গায়িকা ইমন, দুর্গতদের পাশে শ্রীলেখা-সব্যসাচীরা
অনেকেই আবার বাপ ঠাকুরদার সৃষ্ট এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছেন ৷ ভালো দিন ফেরার আশায় বাঁচছেন তারা । সরকারি সাহায্যে, রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের কাতর আর্তি জানিয়েছেন কাঁসা পিতলের বাসনের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা । যদি সরকার সাহায্য করে তাহলে আবার স্বমহিমায় ফিরতে পারে কাঁসা পিতলের বাসন তৈরীর শিল্প । বাঁচবে শিল্পী, বাঁচবে শিল্প ৷