বাঁকুড়া, 8 মার্চ : ভরতপুর ৷ লালপাহাড়ির দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রাম বাংলার প্রাচীন পটশিল্পের ধারক ও বাহক ৷ অন্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, বলা চলে স্বতন্ত্র এখানকার শিল্পীদের সৃষ্টি ৷ মূলত আদিবাসী সংস্কৃতির ঝলক মেলে ভরতপুরের পটে ৷ প্রাচীন গুহাচিত্রের আদল লক্ষ্য করা যায় ৷ কিন্তু, বিভিন্ন কারণে বিগত কয়েকবছর ধরে বিলুপ্তির পথে ভরতপুরের পটশিল্প ৷ ক্ষয়িষ্ণু এই শিল্প এবং শিল্পীদের বাঁচাতে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছেন বাঁকুড়ার সংহিতা মিত্র ৷ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্রামের পটুয়া পরিবারগুলিকে নিয়ে এসেছেন এক ছাদের তলায় ৷
সংহিতার জন্ম বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া গ্রামে । গ্রামের পটুয়া পরিবারগুলিকে তাই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন ৷ তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগ কোনওটাই তাঁর কাছে অজানা ছিল না ৷ পড়াশোনার সুবাদে বেশ কয়েকবছর বাইরে কাটিয়েছিলেন তিনি ৷ আর্ট ও গ্রাফিক্স ডিজ়াইনিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে কয়েক বছর কলকাতার একটি সংস্থায় গ্রাফিক্স ডিজ়াইনার হিসেবে কাজও করেছেন ৷ পরে বিয়ে হয় বাঁকুড়ার বাসিন্দা দেবরাজ মিত্রর সঙ্গে । ফলে কলকাতার চাকরি ছেড়ে নিজের জেলায় ফিরে আসেন সংহিতা ৷
2011 সাল থেকে জেলার বিভিন্ন শিল্পীকে নিয়ে ছোটোখাট কাজ শুরু করেন ৷ 2019 সালে ভরতপুরের পটশিল্প ও শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার কথা তাঁর মাথায় আসে ৷ যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ ৷ নিতান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই পটুয়া পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ান ৷ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ৷ নিজে আর্টের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে প্রাচীন এই শিল্পকলার কদর তিনি জানতেন ৷ তাই বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্পকে বাঁচাতে শুরু করেন প্রশিক্ষণ শিবির ৷ শুধু পুরুষ নয়, পটুয়া পরিবারের মহিলাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝান ৷ তাঁদের একজোট করেন ৷ শুধু কাগজ নয়, টেরাকোটার উপর তাঁদের কাজ করা শেখান ৷
শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি সংহিতা ৷ পটুয়াদের তৈরি পণ্য বাজারে কীভাবে বিক্রি করা যেতে পারে তা নিয়েও একাধিক উদ্যোগ নেন ৷ শুরুটা করেছিলেন সরকারি বইমেলায় পটুয়াদের আঁকা পটচিত্র তুলে ধরা দিয়ে ৷ বইমেলায় ভরতপুরের পটুয়াদের আঁকা পটচিত্র দিয়ে অতিথিদের জন্য তৈরি করা হয় মেমেন্টো ৷ এর ফলে কিছু টাকা হাতে পান পটুয়ারা ৷ বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস ৷
সংহিতা বলেন, "কাজ করে ঘরে রেখে দিলে ওঁদের দিন চলবে না ৷ ওঁদের তৈরি সামগ্রী বিক্রি করার জায়গাটা তৈরি করা প্রয়োজন ৷ না হলে ওঁরা উৎসাহ হারাবেন ৷ কারণ সকাল থেকে চিত্রকর পরিবারের পুরুষদের কাজে বেরিয়ে পড়তে হয় ৷ কিন্তু মহিলারা বাড়িতে থেকে যান ৷ তাঁরা পুরুষদের পাশাপাশি যদি কাজে হাত লাগান তাহলে তাঁদেরও ভালো হবে ৷" তিনি আরও বলেন, "আমার মনে হয়, ওঁদের আর্থ-সমাজিক উন্নয়ন এবং সামগ্রী বিক্রয় ও বিপণনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে, সেটা সরকারি বা বেসরকারি যে কোনও উদ্যোগেই হোক ৷ পাশাপাশি মনে করি, যদি একটা মিউজ়িয়াম করা যায় ৷ মিউজ়িয়ামে এই শিল্পগুলিকে যদি স্টোর করে রাখার এবং ডিসপ্লে করার যদি একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আগামী প্রজন্ম উপকৃত হবে ৷ এখন যাঁরা এই শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করছেন তাঁরাও অনুপ্রাণিত হবেন ৷ পাশাপাশি স্থায়ীভাবে তাঁদের আর্থিক সংস্থানের একটা উপায় হবে ৷ "
সংহিতার এই কাজে তাঁর পাশে রয়েছেন তাঁর স্বামী দেবরাজবাবুও ৷ তিনি জানান, সংহিতার এই কাজে বাড়ির থেকে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ৷ সম্প্রতি জেলা পুলিশের তরফেও প্রাচীন এই শিল্পকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল ৷ রাজ্য ছাড়াও সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের পটশিল্পীরাও ৷ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শ্যামল সামন্ত বলেন, "অনুষ্ঠানের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সংহিতা মিত্র ৷ তিনি অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন ৷ ওঁর উদ্যোগেই আমরা বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম ৷ কলকাতার শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম ৷ বাঁকুড়ার যিনি স্বনামধন্য শিল্পী তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম ৷ সবাইকে উনি একসঙ্গে করেন ৷ সবাইকে একসঙ্গে করে এই যে আইডিয়া শেয়ারিংয়ের ব্যাপারটা, এটাতে উনি খুব সহযোগিতা করেছেন ৷ উনি ব্যক্তিগতভাবেই এগিয়ে এসেছেন ৷ "
দিদিকে পাশে পেয়ে ভরসা পেয়েছেন পটুয়া পরিবারের মহিলারও ৷ গ্রামবাসীদের একজন গোলাপি চিত্রকর বলেন, "দিদি এখানে এসে আমাদের এইসব সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন ৷ কাজটা করতে অবশ্য বেশ ভালোই লাগে ৷ " অপর এক গ্রামবাসী কাজল চিত্রকর বলেন, "স্বামী আঁকেন ৷ আমি রং করে দিই ৷ আমাদের উপকার করতেই দিদি এসেছেন ৷ দিদি আসায় আমরাও সাহস পেয়েছি ৷ দিদি কাজ শেখাচ্ছেন ৷ আমাদের ভালোই লাগে ৷ "