আলিপুরদুয়ার, 14 জুলাই : লখিন্দরের বাসরঘর বিশ্বকর্মাকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর ৷ তবুও সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাননি লখিন্দর ৷ এখন সাপই বাঁচতে চেয়ে মানুষের আবাসস্থলে আশ্রয় নিতে চাইছে ৷ ধ্বংস হচ্ছে বন-জঙ্গল ৷ শহরে সাপেদের প্রিয় জলাভূমি দখল করে অবাধে গড়ে উঠছে সুবিশাল ইমারত । আজ তাই বাস্তুহারা সাপ ৷ অস্তিত্ব বাঁচাতে মানুষের আবাসস্থানে খুঁজে নিচ্ছে তাদের নিরাপদ বাসস্থান ।
রাজ্যে সাপের সংখ্যা কত? এই উত্তর বনদপ্তরের কাছেও নেই ৷ কিন্তু রাজ্যে হাতির সংখ্যা, বাঘের সংখ্যা এমনকী হরিণের সংখ্যাও তারা বলে দিতে পারবে অনায়াসে ৷ আসলে সর্প সমীক্ষা মানে সাপের সংখ্যা গোনা নয় ৷ কোথায় কত ধরনের সাপ আছে অর্থাৎ সাপের প্রজাতির সংখ্যা জানা হয় সর্প সমীক্ষায় ৷ সাপ সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য সর্প সমীক্ষা খুব প্রয়োজন ৷ রাজ্য সরকার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পে সাপ নিয়ে কোনও সমীক্ষাই করেনি । সমীক্ষার জন্য অর্থ চেয়ে বনদপ্তর আবেদনও করেছে । সেই আবেদনে এখনও সাড়া পাওয়া যায়নি ৷
দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যু কত জনের ? এই নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ই-লাইফ জার্নালে ৷ শেষ 20 বছরে এই দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে 12 লাখ মানুষের ৷ ভারতে সাধারণত কোবরা, রাসেলস ভাইপার এবং ক্রেইৎ সাপের কামড়েই অধিকাংশ মানুষ মারা যায়। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভ 1983 সালে গড়ে ওঠে । উত্তরবঙ্গের বৃষ্টি ভেজা বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভ অঞ্চল বরাবরই সাপেদের প্রিয় আবাসস্থান । এই বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলেই আকছার দেখা মেলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তর বিষধর সাপ কিং কোবরার। এছাড়াও বেশ কয়েকটি বিষধর সাপের জন্য বিখ্যাত বক্সার এই জঙ্গল । কাঠচোরদের দৌলতে বক্সার জঙ্গল ক্রমে হারাচ্ছে তার নির্জন গভীরতা । অন্যদিকে বক্সার জঙ্গলের বুক চিরে পর্যটনের নামে জঙ্গলের মধ্যেই গড়ে উঠছে ,ইটকাঠের তৈরি হোম-স্টে ,হোটেল ,রেস্তরাঁ ,সুইমিং পুল , পার্ক। গাছ গাছালির জঙ্গলের পরিবর্তে বক্সার জঙ্গল এখন ইট, কাঠ, লোহার জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে । এর জেরে বিপাকে পড়েছে বক্সার সর্পকুল । আলিপুরদুয়ার জেলা শহরে এখন মানুষের বসতভিটা থেকে বিষধর সাপ উদ্ধার হওয়া যেন এক রুটিনে পরিণত হয়েছে ।
জেলা শহরে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের উদ্যেগে শহরে সাপ ধরার কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে মূল দু'টি সংস্থা বক্সা বনদপ্তরে সঙ্গে সমন্বয় রেখে সাপ ধরার কাজ করে চলছে । 2000 সাল থেকে আলিপুরদুয়ারের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই কাজে নিয়োজিত । এই সংস্থার সম্পাদক জয়দেব দে জানান, জেলা শহরে মূলত স্পেকটাকাল কোবরা , কেউটে , কালাচের মতো বিষধর সাপ হামেশাই পাওয়া যায় । আগে এই সাপগুলো লোকালয়ে বসতভিটায় পাওয়া যেত না । এই সাপেদের সঙ্গে বর্তমানে বার্মিজ পাইথনও প্রায়ই উদ্ধার হচ্ছে । জয়দেববাবু বলেন, জলাভূমি বুজিয়ে মানুষ তার বসতভিটা তৈরি করছে । বার্মিজ পাইথনের উপযুক্ত আবাসস্থান হারিয়ে যাচ্ছে । মানুষ এখন পাকাবাড়ি তৈরি করছে । এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ইঁদুরের গর্ত । আর সেই কারণেই বিষধর সাপগুলো এখন মানুষের ঘরে আশ্রয় নিচ্ছে । তবে জয়দেববাবু জানান, দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গে সাপে কাটা মৃত্যুর হার অনেক কম । তিনি বলেন, গত দু'মাসে তাঁদের সংগঠন জেলা শহর থেকে প্রায় 80 টি বিভিন্ন প্রজাতির সাপ উদ্ধার করেছেন । তার মধ্যে 55 টি বিষধর সাপ । সব সাপগুলোই বনদপ্তরের সাহায্যে ছাড়া হয়েছে রাজাভাতখাওয়ার মধু জঙ্গল স্নেক পয়েন্টে । আলিপুরদুয়ারে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্পোর-এর জেলা কো-অর্ডিনেটর শিলাদিত্য আচার্য বলেন, গত এক বছরে তাদের সংগঠন 150 টি সাপ মানুষের বাড়ি এবং লোকালয় থেকে উদ্ধার করেছে। গত একমাসে 40 টি সাপ উদ্ধার হয়েছে। আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের সুপার চিন্ময় বর্মণ জানান, গত একবছরে জেলায় হাসপাতালে চার জনের মৃত্যু হয়েছে । তিনি বলেন, সময় মতো হাসপাতালে ওই রোগীদের আনা হলে তাদের মৃত্যু রোধ করা যেত । স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়াও বক্সা বনদপ্তর একটি নিজস্ব সাপ উদ্ধারের দল রয়েছে জেলায়।
বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভের ক্ষেত্র অধিকর্তা শুভঙ্কর সেনগুপ্ত জানান, বক্সার জঙ্গলে এখনও সাপ সমীক্ষা করা হয়নি । তবে এই জঙ্গলে কিং কোবরা-সহ প্রচুর বিষধর সাপ এবং নির্বিষ সাপের দেখা মেলে । তবে লোকালয়ে এখনও কিং কোবরা দেখা না পাওয়া গেলেও গোখরো, কেউটে ,কালাচ, চন্দ্রবড়া জাতীয় বিষধর সাপের দেখা পাওয়া যায় । মানুষ এবং সাপেদের যাতে সংঘাত না হয় সে কারণে প্রচার চালানো হয় । কিন্তু এত কিছুর পরও সাপেরা তাদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবে? না-কি ইট-কাঠের তৈরি হোম-স্টে ,হোটেল ,রেস্তরাঁ , সুইমিং পুল , পার্কের ফলে আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে সর্পকুল? এভাবে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হলে তার ফল ভোগ করতে হবে মানুষকেও ৷