কলকাতা, 4 সেপ্টেম্বর : বাড়ির ছেলেটি অবলীলায় কাঁধে তুলে নিত ধানের বস্তা ৷ তাই মা বলেছিলেন, দৌড় প্রতিযোগিতার পরিবর্তে গায়ের শক্তি প্রয়োগ করে ছুড়তে হয়, এমন কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ৷ মায়ের ধারণা অমূলক ছিল না তা কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয় ৷ স্কুল স্পোর্টসে বর্শা ছোঁড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ছেলেটি ৷ পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল তিনটে বালতি ৷ ছেলেকে আরও উৎসাহিত করলেন মা ৷ নদিয়ার চাকদহের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সেই ছেলেটিই বাংলার একমাত্র জ্যাভলিন থ্রোয়ার অমিত মজুমদার (Amit Majumder) ।
অলিম্পিকসের মঞ্চে নীরজ চোপড়ার ইতিহাস গড়া পারফরম্যান্স দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে । তবে একই সঙ্গে রয়েছে বাংলার জ্যাভলিন থ্রোয়ার অমিত মজুমদারদের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ । বিখ্যাত অ্যাথলেটিকস কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে পড়ে চাকদহের ছেলে অমিত ৷ খুব অল্প দিনেই জুনিয়র এবং সিনিয়র পর্যায়ে আশা জাগাতে শুরু করেছিলেন তিনি । 2008 থেকে 2011 এবং পরবর্তী বছরগুলোতে অমিত কার্যত শুধু বাংলা নয়, দেশের অন্যতম প্রতিভাবান জ্যাভলিন থ্রোয়ার হিসেবে উঠে এসেছিলেন । 60, 65, 70, 75 মিটারের লক্ষণরেখা টপকে যখন 2016 সালের রিও অলিম্পিকসে যোগ্যতা অর্জনকে পাখির চোখ করছিলেন তখনই ছন্দপতন । এখানে কোনও চোট বা অভাবের জন্য ছিটকে যাওয়ার গল্প নেই । বরং দেশ ও রাজ্যের ভেঙে পড়া পরিকাঠামোর শিকার হওয়ার ছবিটা প্রকট হয়েছে ।
দশবছর পূর্বাঞ্চলীয় সাইয়ে (SAI) শিক্ষানবীশ ছিলেন অমিত । শুনতে অবাক হলেও সাইতে নাকি ছাত্র তাঁর শিক্ষককে বেছে নেন । সেইমতো অমিত তাঁর কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সাই থেকে অবসর নেওয়ার পরে সুশান্ত সিনহার কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিলেন । এরপর কী হল ? অমিত বলছেন, "আমার ছোটবেলার কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় 2010 সালে সাই থেকে অবসর নেন । চাকদহ থেকে আমাকে নিয়ে এসে গড়েপিঠে তুলেছিলেন । তাঁর অবসরের পরে সাইয়ের নিয়ম অনুযায়ী সুশান্ত সিনহাকে কোচ হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম । তাঁকে বললাম আমার জ্যাভলিন নেই । তিনি আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ হয়নি । সাইয়ের ইনচার্জ কল্যাণ চৌধুরীও আশ্বাস দিয়েছিলেন ৷ কাজের কাজ হয়নি ৷ দিল্লিতে এক পরিচিত কর্তার কাছে দরবার করেছিলাম । এই সময় একটা দরখাস্ত পূর্বাঞ্চলীয় সাই থেকে দরকার ছিল। কিন্তু সেটাও দেওয়া হয়নি । এরপর ওড়িশার সাই থেকে জ্যাভলিন নিয়ে আসার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলাম । সেখানেও প্রয়োজন ছিল একটি চিঠির । কিন্তু তার পরিবর্তে আমাকে সাই থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ৷"
আরও পড়ুন : Neeraj Chopra : সোনাজয়ী নীরজ চোপড়ার নামে এবার স্টেডিয়াম, উদ্বোধন করলেন রাজনাথ সিং
তাঁর অগ্রগতির পথে অন্তরায়ের গল্প বলতে গিয়ে অমিত বলেন, "একটি রেঞ্জার জ্যাভলিনের দাম সেই সময় নূন্যতম 95 হাজার টাকা মূল্য ছিল । একজন অ্যাথলিটের অনুশীলনের জন্য অন্তত তিনটে জ্যাভলিন দরকার ৷ না হলে সুষ্ঠুভাবে অনুশীলন সম্ভব নয় । বর্তমানে কার্বনের তৈরি জ্যাভলিন একজন অ্যাথলিটের সাফল্যের নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে । নীরজ চোপড়ার বর্তমান জ্যাভলিন এতটাই মহার্ঘ যে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ।"
তিনি আরও বলেন, "আমার সেরা সময়ে পৌনে পঁচাত্তর মিটার জ্যাভলিন ছুঁড়েছি । জাতীয় এবং রাজ্যস্তরে নিয়মিত পদক পেয়েছি ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার এগিয়ে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জ্যাভলিনের অভাব । এই সমস্যা শুধু একা আমার নয়, এই রাজ্যের প্রতিটি জ্যাভলিন থ্রোয়ারের । যে কজন হাতে গোনা জ্যাভলিন থ্রোয়ার বাংলা ছিলেন, তাঁরা সবাই এখন হতাশায় খেলা ছেড়ে দিয়েছেন বা দেওয়ার পথে । নতুনভাবে কেউ জ্যাভলিন থ্রোয়ে আসছেন না । অন্তত আমি জানি না ৷" হতাশা ঝরে পড়ছে অমিতের গলায় ।
রিও অলিম্পিকসে যোগ্যতার মান অতিক্রম করার স্বপ্ন দেখা অ্যাথলিট এখন আয়কর দফতরের কর্মী । আর্থিক অনটন জীবনে এখন নেই । তবে যার জন্য এই চাকরি, সেই খেলাটাই যখন অন্ধকারে তখন হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক । শুধুমাত্র পরিকাঠামোর অভাবে আটকে গেলাম । দশবছর সাইয়ে থেকে দেখেছি কীভাবে ওখানকার কোচেরা পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়াতে অনাগ্রহী । ইগো সমস্যায় কোচেরা আক্রান্ত । অথচ খেলোয়াড়দের কোচিং করানোর জন্য মোটা অঙ্কের বেতন দেওয়া হয় ৷"
আরও পড়ুন : Tokyo Olympics : 22 শ্রাবণেই টোকিয়োতে 'জনগণমন', নীরজ-ছোঁয়ায় রবি প্রণাম
একটু থেমে ফের যোগ করলেন, "ভেবেছিলাম জাতীয় বা রাজ্যস্তরে পদক পেলে চাকরি পাওয়া সহজ হয় । কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন । অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আয়কর দফতরে চাকরি পেয়েছি । চাকরি পাওয়ার পর উৎসাহের পরিবর্তে শুনতে হল, এবার ঘরসংসার করার দিকে নজর দেওয়াই ভাল । চাকরি কি সবকিছু, বলুন তো ? নিজেদের বিভাগের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আমার এখন একমাত্র কাজ । এগারোটার সময় অফিসে আসি চারটেয় চলে যাই । হতাশায় সব সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেছি । পদক জলে ফেলে দিয়েছি । শরীর চর্চা যৎসামান্য করি । অচল কয়েকটি জ্যাভলিন আছে তা নিয়ে নাড়াচাড়া করি মাত্র । আমাদের দেশে আশি মিটারের বেশি জ্যাভলিন ছোড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন থ্রোয়ার ছিল । কিন্তু ওরা কেউ নীরজের মতো পরিকাঠামো পায়নি । তাই হতাশ লাগে ৷’’
টোকিয়ো অলিম্পিকসের ভারতের সাফল্যে অমিতের কথাগুলো আলোয় কালো দাগ হয়ে ধরা দেয় । মনে হয় আড়ম্বরের আলোর তত্ত্ব কথা রয়েছে । তার বাস্তবায়ন শুধুমাত্র ছলনা ।