হায়দরাবাদ, 11 অগাস্ট : 2013 সালে এশিয়ান প্যারা গেমসে দুটি স্বর্ণ পদক জিতেছিলেন ভারতের তারকা প্যারা-সাঁতারু সুযশ যাদব। 2016 সালে দুটি ব্রোঞ্জ পদক এবং 2018 সালে জার্মান সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো জিতেছিলেন তিনি । ইটিভি ভারতের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং তারপর ফিরে এসে প্যারা সাঁতারে সাফল্য পাওয়ার কথা শেয়ার করলেন সুযশ যাদব।
এশিয়ান প্যারা গেমসে ভারতের হয়ে প্রথম সোনার জয়ের অনুভূতি কেমন ছিল?
এটি আমার প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক এবং এশিয়ান প্যারা গেমসের ইতিহাসে ভারতের প্রথম স্বর্ণপদক । আমি মনে করি এটা আমার পাশাপাশি দেশের জন্যও একটা বিরাট মুহূর্ত ছিল। ভারতীয় হিসেবে দেশকে এই সাফল্য এনে দিতে পেরে আমি গর্বিত । এটা সত্যিই একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা ছিল।
সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা বলুন , যেই দুর্ঘটনায় আপনি দুটো হাত হারিয়েছিলেন ? দুর্ঘটনার পরে আপনি কীভাবে হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন?
2004 সাল , আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। পরিবারের সঙ্গে আমি আমার এক আত্মীয়ের বিয়েতে গেছিলেম । আমার আরও ভাই-বোনদের সঙ্গে বিয়ে বাড়ির ছাদে খেলছিলাম । সেই সময় খেলার ছলে আমি একটি খোলা তার ছুঁয়ে ফেলি , ওই তারের মাধ্যমে একটি লোহার রড়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছিল । মুহূর্তের মধ্যে আমার দুটো হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত, ডাক্তাররা আমার হাত কনুইয়ের নীচ থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
যে সময় যখন দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম। আমার কী হয়েছিল তা আমি বুঝতে পারিনি । আমি সেরকম ভাবে হতাশায় ডুবে যাইনি তবে আমার পরিবার অনেক ক্ষতি হয়েছিল । পরে দুটো হাত হারানোর মর্ম বুঝতে পেরে আমি সত্যিই খুব দুঃখ পেয়েছিলাম । তবে আমি হতাশ হইনি । প্রথমিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমি কোনও বিশেষ সহায়তা গ্রহণ করিনি। আমি আস্তে আস্তে স্বাধীন হয়েছি এবং আমার নিজের প্রতিদিনের কাজ নিজেই করতে শুরু করি । এখন আমি আমার সব কাজ নিজেই করতে পারি ।
আপনি বলেছিলেন যে আপনার বাবা আপনাকে অনেক সহায়তা করেছিলেন এবং তিনি আপনার প্রথম সাঁতার কোচও ছিলেন । আপনার বাবার সম্পর্কে বলুন, যিনি নিজে জাতীয় স্তরের সাঁতারু ছিলেন
1978 সালে তিনি জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তবে কিছু সমস্যার কারণে প্রতিযোগিতা বাতিল করা হয়েছিল। তাঁর স্বপ্ন ভেঙে গেছিল এবং তিনি চেয়েছিলেন যে আমি যে ভারতের হয়ে তাঁর সোনার জয়ের স্বপ্নটি পূরণ করি । আমার বাবা আমার প্রথম কোচ, তিনি আমাকে সাঁতারের প্রাথমিক বিষয়গুলি শিখিয়েছিলেন।
আপনার ফিটনেস রুটিন সম্পর্কে বলুন এবং অন্য সাঁতারুদের থেকে এটা কীভাবে আলাদা?
আমি রোজ নিয়ম করে দৌড়াচ্ছি। বক্সিং গ্লাভস পরে আমি পুশআপ করি। আমি স্বাভাবিক জিমও কাজ করতে পারি । হাত না থাকায় স্বাভাবিক কারণেই আমি ট্রেনিং পদ্ধতি আমার মতো করে কিছু পরিবর্তন করেছি । তবে যাই হোক আমি নিয়মিত ফিটনেস ট্রেনিং করি । সাঁতারের জন্য শরীরের উপরের ভাগে বেশি নজর দিতে হয়, তবে শরীরের নিচের অংশেরও নজর রাখি । প্রতিদিন সাঁতার কাটার আগে এবং পরে ফিটনেস সেশন করি । বুধবার এবং শনিবার ফিটনেস ট্রেনিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে ।
আমি আসলে একজন স্প্রিন্টার এবং স্প্রিন্টারদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ডায়েট রয়েছে, এতে প্রোটিন এবং ক্যালোরি উভয়েরই ভারসাম্য রয়েছে। মাছ, মুরগির মাংস মূলত আমার ডায়েটে থাকে। এছাড়া সপ্তাহে এক দিন আমি ডায়েটের বাইরে যেকোনও খাবার খাই ।
কোভিড-19-র কারণে প্রায় পুরো পৃথিবী লকডাউনে ছিল। অনেক খেলোয়াড় নিজেকে ফিট রাখতে সমস্যায় পড়েছেন। আপনি কীভাবে নিজেকে ফিট রেখেছেন?
কোরোনার জেরে সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত সাঁতারের পুল বন্ধ ছিল । এর ফলে আমার এবং অন্য সমস্ত সাঁতারুদের খুব সমস্যা হয়েছে । তবে আমি হাল ছাড়িনি এবং বাড়িতেই কিছু ফিটনের ওয়ার্কআউট করতাম । এর পর আমি রোড দৌড়াতাম । রোজ দৌড়ালে সাঁতার কাটতে সুবিধে হয় । কাঁধের পেশি শক্তিশালী হয়। তাই লক ডাউনে আমি এভাবেই নিজেকে ফিট রেখেছি ।
ভারত ক্রিকেটপ্রেমী একটা দেশ। আপনি কী মনে করেন যে ক্রিকেট অন্য খেলাধুলাকে ঢেকে দেয় এবং বড়স্তরে অন্য খেলাধুলোর জন্য কোন কোন পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন?
অনেকে এই বিষয়ে আমার মতামত পছন্দ করবেন না তবে আমরা যে নগদ পুরস্কার পাই এবং ক্রিকেটাররা যে নগদ পুরস্কার পায় তার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে । এই পার্থক্য একটা বড় সমস্যা।
আরেকটি বিষয় যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হল, ক্রিকেটাররা ক্রিকেট সংস্থার শিবিরগুলোতে ভালো প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় । অন্যদিকে সাঁতারে সেরকম সুবিধে নেই । ক্রিকেট ছাড়া অন্যান্য খেলিধূলার সঙ্গে যুক্ত খেলেয়াড়দের পাশে সকলের দাঁড়ানো উচিত । এরাও সমান তালে আন্তর্জজাতিক মঞ্চে ভারতের নাম উজ্জ্বল করে চলেছে ।
বিশেষত সাঁতার সম্পর্কে কথা বললে, বিভিন্নভাবে সক্ষম সাঁতারুদের জন্য অনেকগুলো পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিটি পুলে তাদের জন্য আলাদা র্যাম্প থাকা উচিত। যদি কোনও অন্ধ সাঁতারু থাকে তবে আমাদের অবশ্যই তাঁর সাথে এসকর্ট পাঠাতে হবে। যদি এই বিষয়গুলি পরিবর্তন করা হয় তবে খুব শীঘ্রই আমরা দেশের ক্রিকেটে যে সাফল্য অর্জন করছে সাতাঁরেও সেই জায়গায় পৌঁছতে পারব ।
দেশে খেলাধুলোর উন্নয়নে মিডিয়াও বড় ভূমিকা পালন করে আমরা মিডিয়া থেকে তেমন মনোযোগ পাই না, যার পরিবর্তন হওয়া উচিত।
কোন ক্রীড়াব্যাক্তিত্ব আপনার আইডল ?
সাঁতারের ক্ষেত্রে আমার আইডল মাইকেল ফেলপস । সামগ্রিকভাবে আমি উসেন বোল্টকে পছন্দ করি । আমি বিরাট কোহলিকেও অনুসরণ করি । তবে শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতার জন্য আমার গুরুদেব সচিন তেন্ডুলকর ।
টোকিও অলিম্পিক এক বছরের জন্য স্থগিত হয়েছে, এর ফলে কি আপনার প্রশিক্ষণ কীভাবে কতটা প্রভাবিত হয়েছে ?
এটা দিনের আলোর মত পরিস্কার শুধু মাত্র আমি একা নই , যারা এই মেগা ইভেন্টের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদের সকলকেই প্রভাবিত করেছে । তবে আমি এটি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছি । আমার ফিটনেসে উন্নতি করেছি । আমি সোনা জেতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি এবং আমি সোনা জিতে দেশের নাম উজ্জবল করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্ট করব ।
আপনি দেশের অনেক উদীয়মান সাঁতারুদের সত্যিকারের অনুপ্রেরণা। আপনি তাদের কী বার্তা দিতে চান?
আমি জীবনকে একটা জিনিসে বিশ্বাস করি । তা হল আপনার যা আছে তা ভেবে দেখুন, আপনার যা নেই তা নিয়ে ভাববেন না । আপনার আবেগকে অনুসরণ করুন এবং আপনি সাফল্য পাবেন । শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রমই আপনাকে এবং অন্য কিছুই আপনাকে সাফল্যার শিখরে পৌঁছে দিতে পারে ।