ভাবনার জায়গা থেকে দেখতে গেলে কোনও সন্দেহ নেই সেটি প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের। অনেকদিন পর এমন সূক্ষ্ম অনুভূতির ছোঁয়া পাওয়া গেল কোনও বাংলা ছবিতে। সেই সঙ্গে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ইন্ডাস্ট্রি যে ভাতৃসুলভ প্রসেনজিতের সান্নিধ্য পেয়ে থাকে, তাঁকে ধরা গেল রুপোলি পর্দায়। আর অবশ্যই কৌশিক গাঙ্গুলি। যিনি না বলা অনেক কথা বলে গেলেন গোটা ছবি জুড়ে। ঋতুপর্ণ-প্রসেনজিৎ-কৌশিক এই তিনজনের মেশালে জ্যেষ্ঠপুত্র হয়তো এবছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হয়ে থাকবে।
ভাবনা, বিষয়বস্তু এবং চিত্রনাট্য - গোটা বিশ্ব স্বীকার করে নিয়েছে এই তিনটি ছবির ক্ষেত্রে প্রথম উপজীব্য। এবং যে বিষয়টি ছাড়া চিত্রনাট্যও মাঝেমধ্যে হার মেনে যায়, তা হল অভিনয়। 'জ্যেষ্ঠপুত্র' এ সবের অ্যামালগামেশন। এই প্রথম দু'জন দুর্দান্ত অভিনেতার একসঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার। একদিকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও অন্যদিকে ঋত্বিক চক্রবর্তী। তীর্যক ডায়লগ ডেলিভারি থেকে শুরু করে, বাচনভঙ্গি , নির্বাক চাউনি - সব যেন বলে গেল, বাংলাতেও অভিনেতারা আছেন। এবং তাঁরা যখন সেরা ফর্মে থাকেন, পরদায় জাদু সৃষ্টি হয়। একজন সুপারস্টারের সঙ্গে একজন চরিত্রাভিনেতা একসঙ্গে বলে গেল অভিনয়ই শেষ কথা বলে। তবে মানতেই হচ্ছে, প্রসেনজিৎ এগিয়ে গেলেন। আর ঋত্বিক বরাবরের মতো দুর্দান্ত। এরপর যাঁদের কথা বলতেই হয় - সুদীপ্তা চক্রবর্তী। স্ক্রীনে কী দাপট! মানসিক ভারসাম্যহীন ইলা গাঙ্গুলির চরিত্রে এমনভাবে তুলে ধরলেন নিজেকে, যে স্বীকার করতেই হল সুদীপ্তা দারুণ। অন্যদিকে শান্ত-সৌম্য ব্যক্তিত্বময়ী সুদেষ্ণা সেন, অর্থাৎ গার্গী রায়চৌধুরী। গোটা ছবিতে তিনি অসম্ভব ব্যক্তিত্ব বজায় রেখেছেন - বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে যখন 'জ্যেষ্ঠপুত্র' ইন্দ্রজিৎ গাঙ্গুলি (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) ভোররাতে ক্লান্ত, ভারাক্রান্ত হয়ে তাকে বলছে, ভাই পার্থ গাঙ্গুলিকে (ঋত্বিক চক্রবর্তী) বাড়ি প্রোমোটিংয়ের জন্য নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়েছে, আর দেখা হবে না কোনওদিন। সেটা যেন দর্শকমনে নিস্তব্ধতা নিয়ে আসে। গার্গী ও প্রসেনজিতের এই অভিনয় দর্শক অনেকদিন মনে রাখবে। ঠিক একইভাবে মনে থাকবে প্রসেনজিৎ-ঋত্বিকের তর্কবিতর্কের দৃশ্য। যেখানে থিয়েটার বড় না সিনেমা বড়, তাই নিয়ে বাকযুদ্ধ চলতে থাকে দুই ভাইয়ের মধ্যে। পরিচালক খুব সুন্দরভাবে এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন বড় পরদায়। কোনও থিয়েটারপ্রেমী মানুষকে নাটক-ফাটক বললে, যেভাবে সে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে, ঋত্বিকও ঠিক সেইভাবেই জ্বলে উঠেছেন। পালটা যুক্তি খাড়া করেছেন প্রসেনজিৎও। না দেখলে বিশ্বাস করবেন না! সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হলের বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃখজনক ঘটনাকেও পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি তুলে ধরেছেন এই ছবিতে। ইন্দ্রজিৎ গাঙ্গুলি, অর্থাৎ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের নাম রেখেছেন প্রিয়া মিত্রা। অগ্নিদগ্ধ প্রিয়া সিনেমা হল এবং সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া মিত্রা সিনেমা হলকে মনে পড়ে যাবে দর্শকের। ছবিতে উল্লেখ আছে ঋতুপর্ণ ঘোষের মূলভাবনা 'অন্য নায়ক'-এর। কিন্তু কীভাবে, সবটা এখানে বলে দিলে, ছবি দেখার আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে।
বাড়ির জ্যেষ্ঠপুত্র এমন একটি শব্দ, যা শুনলে প্রথমেই মনে হয় এমন এক ব্যক্তি যার কাঁধ শক্ত। যাকে হাঁটতে হয় ত্যাগের পথে, দুঃখের চরমে। তবে কি জ্যেষ্ঠপুত্রদের স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই? তেমনই এক জ্যেষ্ঠপুত্র, অর্থাৎ খুব সাকসেসফুল অভিনেতা সুপারস্টার ইন্দ্রজিৎ গাঙ্গুলি। যাকে সব ছেড়ে দিতে হয়েছিল লক্ষ্যপূরণের জন্য। বাবা ইন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির মৃত্যুর খবর পেয়ে বল্লভপুর গ্রামে আসে সে, প্রায় এক দশক পরে। ইন্দ্রনাথবাবু কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও, মুখ্যমন্ত্রী তার জ্যেষ্ঠপুত্র ইন্দ্রজিৎকে পুলিশি নিরাপত্তা, থাকার জন্য সুব্যবস্থা ও হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দেয়। হেলিকপ্টারে করে নিজের গ্রামে আসেন ইন্দ্রজিৎ এবং চারদিকে হইহই পড়ে যায়। সাধারণের থেকে হয়তো সুপারস্টাররা আলাদা। কিন্তু সুপারস্টার নিজেও যে মানুষ, তারও যে বেদনা-দুঃখ সবই থাকতে পারে, সেই গল্পই বলে 'জ্যেষ্ঠপুত্র'। এ এক নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প। যে মানুষটি সকলকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল, ভালোবাসতে চেয়েছিল প্রিয়জনদের। এবং এই জ্যেষ্ঠপুত্রকে খুব সুন্দরভাবে পরদায় তুলে ধরেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ইন্ডাস্ট্রির সকলের প্রিয় বুম্বাদা।