কলকাতা : লকডাউন পরবর্তী সময়ে কীভাবে চলবে শুটিং, তাই নিয়ে প্রাথমিক নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে । বলা হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, কম সংখ্যক কর্মী নিয়ে করতে হবে শুটিংয়ের যাবতীয় কাজ । অর্থাৎ, সেই সব মানুষরা, যাঁরা দিনরাত এক করে একটা ঘরের চেহারা পালটে দেন, ট্রলি সরিয়ে দেন, শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে খাবারের জোগান দেন, আর্টিস্টদের পোশাক পরিচ্ছদের দেখাশোনা করেন, তাঁদের সংখ্যায় পড়বে টান । তখন কী করবে সেই অসহায় কর্মীরা, যাঁরা দিনের হিসেবে পারিশ্রমিক পান ? এমনিতেই এই লকডাউন তাঁদের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে । অনেকের তিলতিল করে জমানো অর্থ শূন্য হয়েছে । এবার কাজ হারানোর ভয় তাঁদের গ্রাস করছে একটু একটু করে । ETV ভারত সিতারা কথা বলল সেই মানুষগুলোর সঙ্গে, যাঁরা না থাকলে শুটিংয়ের ইউনিট অচল।
কিছুদিন আগেই (পড়ুন লকডাউনের আগেই) সুজয় ঘোষের কন্যা দিয়া ঘোষের ছবি 'বব বিশ্বাস'এর শুটিংয়ে আর্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ছিলেন ফ্লোরের পরিচিত টুটুদা, ভালো নাম প্রসন সায়েন । জিনিসপত্র সরানো, সেটের বিভিন্ন জিনিস ঠিক করা, আরও দু'একজনের সঙ্গে টিম হিসেবে কাজ করতেন টুটুদা । ওড়িশা থেকে আসা কলকাতার এই বাসিন্দা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে । তিনি বললেন, "এই পরিস্থিতিতে কম সংখ্যক লোক নিয়ে কাজ করলে অনেকে কিন্তু কাজ পাবেন না । তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করানো যেতেই পারে । যেমন তিনদিন একজন, আর তিনদিন আরও কয়েকজন । তাতে সকলের কাজ থাকবে । আমাদের যা ডিপার্টমেন্ট, সেখানে একটা কন্টিনিউইটির ব্যাপার থাকে । ফিল্মের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি জরুরি । কাজের প্রেশার খুব বাড়বে । একটা মেগা সিরিয়ালে তিনজন যায় । সেখানে দু'জন গেলে মোটামুটি কাজ হবে । আর একজন গেলে কাজই করা যাবে না । ধরুন, একটা ওয়াড্রোব সরানো হবে, সেটা তো একজনকে নিয়ে হয় না । দু'জন লোক লাগবেই ।"
লকডাউন হওয়ার সময় থেকে একেবারে হাত খালি করে বসে আছেন টুটুবাবু । বললেন, "আমরা বাড়িতে এমনি বসে আছি । বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারিনি । আর যাব কীভাবে, সেখানে তো কোরোনার ভয় । আমার তো বাড়িতে বাচ্চা আছে । কোনও মতে সংসার চলছে ।" ইন্ডাস্ট্রি থেকেও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াননি কেউ, সেই বিষয়টিও জানালেন টুটুবাবু । বললেন, "বলিউডে শুনছি অনেক তারকারা সাহায্য করেছেন । আমি তো এখানে থাকি । আমি আপাতত কিছু পাইনি । আমার গিল্ড থেকে প্রত্যেক মেম্বারকে ১০০০ টাকা করে দিয়েছে । সেটাও আমাদের নিজস্ব পয়সা । আমি আর একটা কথা শুনেছিলাম, আমার বলা উচিত নয়, বলা হয়েছিল আমাদের রাজ্য সরকার থেকে নাকি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক টাকা দিয়েছেন, সবাইকে সাহায্য করা হয়েছে । আমি শুনে অবাক হয়েছি, কারণ আমি তো নিজে কিছু পাইনি । এটা খুব কষ্ট লাগে, যে আমরা কিছুই পেলাম না, আর খবর হল সাহায্য করা হয়েছে । আমরা তো জানি এই পেশায় কাজ না করলে টাকা পাব না । আমাদেরও তো অনেক প্রেশার নিয়ে থাকতে হয় । বাচ্চার স্কুলের প্রেশার থাকে । আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা কোনও অর্থ সাহায্যই পাননি । এই পরিস্থিতিতে আমাদের একমাত্র সহায় ভগবান ।"
শুটিং ফ্লোরের ইলেক্ট্রিকের কাজ করতেন সুনীল মন্ডল । তারপর সেই কাজ করতে শুরু করেন তাঁর ছেলে অজয় মন্ডল । এই লকডাউনের বাজারে কর্মহীন, অর্থহীন অবস্থায় কোনও মতে দিন কাটাচ্ছেন তিনিও । তার উপর বাবাকে হারিয়েছেন ফেব্রুয়ারি মাসেই । চিকিৎসা ও শ্রাদ্ধের কাজ মিলিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে তাঁর । তারপরই গৃহবন্দী হয়েছেন কোরোনার কারণে । এই পরিস্থিতিতে বিষন্নতার সুর শোনা গেল অজয়বাবুর কণ্ঠেও । বললেন, "এই পরিস্থিতিতে সবার আগে কাজ দরকার । কিন্তু সকলকে সামাজিক দূরত্বও মানতে হবে । এই বিষয়টাও কিন্তু অবাঞ্ছনীয় নয়, আমাদের বিষয়টাও অবাঞ্ছনীয় নয় । আমার মনে হয় কাজ চালু রাখা উচিত । কিছুক্ষণ কাজ করলাম, তারপর বাইরে বেরোলাম, অপেক্ষা করলাম, সেভাবেও কাজটা করলে হয় । এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে আমার বাবা মারা গেছেন । আমি আমার বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মানুষ । বাবার চিকিৎসায় ও তারপরের কাজগুলোতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে । তারপরই এই পরিস্থিতি শুরু হয় মার্চ থেকে । আমাদের তহবিল থেকে টাকাও আসেনি । বলেছিল চ্যানেল দেবে, কিন্তু আমি তো কিছু পাইনি । একটা দেড় হাজার টাকার টোকেন পেয়েছিলাম ।"
অন্যদিকে শুটিংয়ে ক্যামেরার সহকারী প্রদীপ আমাদের বলেন, "যতক্ষণ না কাজ শুরু হচ্ছে আমরা কিছুই বলতে পারছি না । এখন তো সবই বন্ধ । শুটিংয়ের যেই নির্দেশিকাগুলো দেওয়া হয়েছিল, তাতে আদতেও কাজ করা সম্ভব নয় । জানি না ওইভাবে কাজ শুরু হলে কী হবে । ওরকমভাবেই হয়তো কাজ করতে হবে । যেটুকু টাকা জমিয়েছিলাম সব তো খরচ হয়ে গেছে ।"
সব মিলিয়ে প্রত্যেকেই একটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে । কোরোনা, লকডাউন, আমফান সবকিছু যেন একটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এই মানুষগুলোকে । কীভাবে কী হবে কেউ বুঝতে পারছেন না । তবুও আশা করছেন যে, সুদিন আসবেই । এবার সময়ের উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা ।