ETV Bharat / sitara

EXCLUSIVE : ইন্ডাস্ট্রির আলোয় বেঁচে থাকা মুখগুলো আজ অন্ধকারে - Bengali film industry post lockdown

কেউ মেকআপ আর্টিস্ট তো কেউ খাবার জোগান দেন, কেউ পোশাকের ডিপার্টমেন্ট সামলান তো কেউ ট্রলি ঠেলেন । ইন্ডাস্ট্রির চড়া আলোয় এই মানুষগুলোকে দেখা না গেলেও এঁরা ভীষণভাবে বর্তমান । লকডাউন উঠে গেলেও কি তাঁদের সমস্যা মিটবে ? খোঁজ নিলাম আমরা ।

bengali film industry ground level staff
bengali film industry ground level staff
author img

By

Published : May 28, 2020, 12:08 AM IST

কলকাতা : লকডাউন পরবর্তী সময়ে কীভাবে চলবে শুটিং, তাই নিয়ে প্রাথমিক নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে । বলা হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, কম সংখ্যক কর্মী নিয়ে করতে হবে শুটিংয়ের যাবতীয় কাজ । অর্থাৎ, সেই সব মানুষরা, যাঁরা দিনরাত এক করে একটা ঘরের চেহারা পালটে দেন, ট্রলি সরিয়ে দেন, শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে খাবারের জোগান দেন, আর্টিস্টদের পোশাক পরিচ্ছদের দেখাশোনা করেন, তাঁদের সংখ্যায় পড়বে টান । তখন কী করবে সেই অসহায় কর্মীরা, যাঁরা দিনের হিসেবে পারিশ্রমিক পান ? এমনিতেই এই লকডাউন তাঁদের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে । অনেকের তিলতিল করে জমানো অর্থ শূন্য হয়েছে । এবার কাজ হারানোর ভয় তাঁদের গ্রাস করছে একটু একটু করে । ETV ভারত সিতারা কথা বলল সেই মানুষগুলোর সঙ্গে, যাঁরা না থাকলে শুটিংয়ের ইউনিট অচল।


কিছুদিন আগেই (পড়ুন লকডাউনের আগেই) সুজয় ঘোষের কন্যা দিয়া ঘোষের ছবি 'বব বিশ্বাস'এর শুটিংয়ে আর্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ছিলেন ফ্লোরের পরিচিত টুটুদা, ভালো নাম প্রসন সায়েন । জিনিসপত্র সরানো, সেটের বিভিন্ন জিনিস ঠিক করা, আরও দু'একজনের সঙ্গে টিম হিসেবে কাজ করতেন টুটুদা । ওড়িশা থেকে আসা কলকাতার এই বাসিন্দা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে । তিনি বললেন, "এই পরিস্থিতিতে কম সংখ্যক লোক নিয়ে কাজ করলে অনেকে কিন্তু কাজ পাবেন না । তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করানো যেতেই পারে । যেমন তিনদিন একজন, আর তিনদিন আরও কয়েকজন । তাতে সকলের কাজ থাকবে । আমাদের যা ডিপার্টমেন্ট, সেখানে একটা কন্টিনিউইটির ব্যাপার থাকে । ফিল্মের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি জরুরি । কাজের প্রেশার খুব বাড়বে । একটা মেগা সিরিয়ালে তিনজন যায় । সেখানে দু'জন গেলে মোটামুটি কাজ হবে । আর একজন গেলে কাজই করা যাবে না । ধরুন, একটা ওয়াড্রোব সরানো হবে, সেটা তো একজনকে নিয়ে হয় না । দু'জন লোক লাগবেই ।"

লকডাউন হওয়ার সময় থেকে একেবারে হাত খালি করে বসে আছেন টুটুবাবু । বললেন, "আমরা বাড়িতে এমনি বসে আছি । বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারিনি । আর যাব কীভাবে, সেখানে তো কোরোনার ভয় । আমার তো বাড়িতে বাচ্চা আছে । কোনও মতে সংসার চলছে ।" ইন্ডাস্ট্রি থেকেও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াননি কেউ, সেই বিষয়টিও জানালেন টুটুবাবু । বললেন, "বলিউডে শুনছি অনেক তারকারা সাহায্য করেছেন । আমি তো এখানে থাকি । আমি আপাতত কিছু পাইনি । আমার গিল্ড থেকে প্রত্যেক মেম্বারকে ১০০০ টাকা করে দিয়েছে । সেটাও আমাদের নিজস্ব পয়সা । আমি আর একটা কথা শুনেছিলাম, আমার বলা উচিত নয়, বলা হয়েছিল আমাদের রাজ্য সরকার থেকে নাকি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক টাকা দিয়েছেন, সবাইকে সাহায্য করা হয়েছে । আমি শুনে অবাক হয়েছি, কারণ আমি তো নিজে কিছু পাইনি । এটা খুব কষ্ট লাগে, যে আমরা কিছুই পেলাম না, আর খবর হল সাহায্য করা হয়েছে । আমরা তো জানি এই পেশায় কাজ না করলে টাকা পাব না । আমাদেরও তো অনেক প্রেশার নিয়ে থাকতে হয় । বাচ্চার স্কুলের প্রেশার থাকে । আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা কোনও অর্থ সাহায্যই পাননি । এই পরিস্থিতিতে আমাদের একমাত্র সহায় ভগবান ।"

শুটিং ফ্লোরের ইলেক্ট্রিকের কাজ করতেন সুনীল মন্ডল । তারপর সেই কাজ করতে শুরু করেন তাঁর ছেলে অজয় মন্ডল । এই লকডাউনের বাজারে কর্মহীন, অর্থহীন অবস্থায় কোনও মতে দিন কাটাচ্ছেন তিনিও । তার উপর বাবাকে হারিয়েছেন ফেব্রুয়ারি মাসেই । চিকিৎসা ও শ্রাদ্ধের কাজ মিলিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে তাঁর । তারপরই গৃহবন্দী হয়েছেন কোরোনার কারণে । এই পরিস্থিতিতে বিষন্নতার সুর শোনা গেল অজয়বাবুর কণ্ঠেও । বললেন, "এই পরিস্থিতিতে সবার আগে কাজ দরকার । কিন্তু সকলকে সামাজিক দূরত্বও মানতে হবে । এই বিষয়টাও কিন্তু অবাঞ্ছনীয় নয়, আমাদের বিষয়টাও অবাঞ্ছনীয় নয় । আমার মনে হয় কাজ চালু রাখা উচিত । কিছুক্ষণ কাজ করলাম, তারপর বাইরে বেরোলাম, অপেক্ষা করলাম, সেভাবেও কাজটা করলে হয় । এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে আমার বাবা মারা গেছেন । আমি আমার বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মানুষ । বাবার চিকিৎসায় ও তারপরের কাজগুলোতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে । তারপরই এই পরিস্থিতি শুরু হয় মার্চ থেকে । আমাদের তহবিল থেকে টাকাও আসেনি । বলেছিল চ্যানেল দেবে, কিন্তু আমি তো কিছু পাইনি । একটা দেড় হাজার টাকার টোকেন পেয়েছিলাম ।"

অন্যদিকে শুটিংয়ে ক্যামেরার সহকারী প্রদীপ আমাদের বলেন, "যতক্ষণ না কাজ শুরু হচ্ছে আমরা কিছুই বলতে পারছি না । এখন তো সবই বন্ধ । শুটিংয়ের যেই নির্দেশিকাগুলো দেওয়া হয়েছিল, তাতে আদতেও কাজ করা সম্ভব নয় । জানি না ওইভাবে কাজ শুরু হলে কী হবে । ওরকমভাবেই হয়তো কাজ করতে হবে । যেটুকু টাকা জমিয়েছিলাম সব তো খরচ হয়ে গেছে ।"

bengali film industry ground level staff
ক্যামেরা হাতে
প্রোডাকশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রবিবাবু আমাদের বলেন, "এরকম হলে আমাদের সংসার কীভাবে চলবে ? কোনও ডিপার্টমেন্ট থেকে যদি একজন করে নেয়, কী করে চলবে ? এমনিতেই তো মানুষ খেতে পাচ্ছে না । এখন তো বিকল্প পেশা হিসেবেও কিছু ভেবে রাখিনি । আমার ধার করে সংসার চলছে ।"বহু সংখ্যক মানুষের সঙ্গে একটি ধারাবাহিকে কাজ করেন ধনঞ্জয় দত্ত । কিন্তু শোনা যাচ্ছে লকডাউন উঠে গেলে সেই ধারাবাহিক বন্ধও হয়ে যেতে পারে । ধনঞ্জয় কাজ করেন ড্রেস ডিপার্টমেন্টে । কোন চরিত্র কী পোশাক পরবে খবর রাখা, পোশাকের দেখভাল করা, সেটাই তাঁর কাজ । এই পরিস্থিতিতে ধনঞ্জয় আমাদের বলেন, "আর্টিস্টকে রেডি করি, ওঁদের পোশাক দেখি । আমি যেই প্রোজেক্টে কাজ করি সেখানে কম লোক নিয়ে কাজ করলে হবে না । সিরিয়ালটা বন্ধ হলে কাজের সমস্যা তৈরি হবেই । আমরা এমনিতেই খুব অসুবিধের মধ্যে পড়ে আছি । আমার তো আর কোনও কাজ জানা নেই । এটাই আমার পেশা ।"কর্মসংস্থান হারানোর ভয় পাচ্ছেন আর্ট ডিপার্টমেন্টের আর এক কর্মী বাপি । তিনি আমাদের বলেন, "খুব ভয় পাচ্ছি জানেন তো । এই কাজ ছাড়া আমি কিছুই করি না । আমাদের যদি কোনও কারণে বাদ দেওয়া হয়, ঝুট ঝামেলা অশান্তি হবেই । আমরা প্রযোজকদের উপর নির্ভর করছি । দাদারা নিশ্চয়ই বিষয়টা দেখবেন । আজ এই সেট কাল ওই সেটে ঘুরে ঘুরে কাজ করছিলাম । এখন বসেই আছি । এখন আমাদের সেক্রেটারির কাছে যেতে হবে, আর কিছুই করার নেই ।"ট্রলির কাজ করেন লাল বাহাদুর দাস । দু'জন কর্মী প্রয়োজন হয় এই কাজে । ট্রলি পেতে লাইনের উপর ট্র্যাক তুলতে হয় । ক্যামেরা বসাতে হয় তার উপর । শট নেওয়া হলে, তার উপর মনিটারিংও করা হয় । লাল বাহাদুর আমাদের বলেন, "আমরা ডিসটেন্স রেখেও কাজ করতে পারি । সেই সুবিধে আছে । কী হবে বা কী হতে চলেছে, তাই নিয়ে কোনও খবর পাইনি । এতদিন বসে থাকার কারণে আমাদের সকলেরই একটা আর্থিক সমস্যা হয়ে গেছে । আমার বাড়িতে দুটো বাচ্চা, মা, আমি, বউ আছি । আমাদের সকলের অবস্থাই খুব শোচনীয় ।" দীর্ঘদিনের হেয়ার ড্রেসার হেমা মুন্সী বলেন, "আমাদের PPE পরে কাজ করতে হবে কিনা, সেটা নিয়ে তেমন কোনও গাইডলাইন তো তৈরি হয়নি । আমরা ইউনিটে প্রায় 80 জন থাকি । সেটাই কিন্তু শিফটিং ডিউটি করে করা যায় । আমার অ্যাসিস্ট্যান্টদের তো ফ্লোরেই কাজ থাকে । আর আমরা যে সকলে গায়ের উপর উঠে কাজ করি তাও কিন্তু নয় । আমাদেরও একহাত দূরত্ব বজায় রেখেই কাজ করতে হয় । তার উপর যাঁরা মেকআপের ব্যবসা করে বড়বড় তাঁদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে । কালার প্যালেট থেকে রং তুলে যেমন আর্টিস্টরা ছবি আঁকে, আমাদেরও সেভাবেই করতে হবে মেকআপ । তারপর একজনের মেকআপ হয়ে গেলে ব্রাশ স্যানিটাইজ় করতে হবে । তবে মসকারা, লিপস্টিক, কাজল এগুলো পার্সোনাল হলেই ভালো । অনেক আর্টিস্টরা এগুলো নিজেরাই আনেন । আমাদের জিনিসগুলো তো স্যানিটাইজ় করা সহজ । এই যে রটে গেছে, শুটিং মানেই ঘনিষ্ঠতা, এটা একটা ভুল বিষয় । এগুলো নিয়ে আমরা ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনাও করব।"

সব মিলিয়ে প্রত্যেকেই একটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে । কোরোনা, লকডাউন, আমফান সবকিছু যেন একটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এই মানুষগুলোকে । কীভাবে কী হবে কেউ বুঝতে পারছেন না । তবুও আশা করছেন যে, সুদিন আসবেই । এবার সময়ের উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা ।

কলকাতা : লকডাউন পরবর্তী সময়ে কীভাবে চলবে শুটিং, তাই নিয়ে প্রাথমিক নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে । বলা হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, কম সংখ্যক কর্মী নিয়ে করতে হবে শুটিংয়ের যাবতীয় কাজ । অর্থাৎ, সেই সব মানুষরা, যাঁরা দিনরাত এক করে একটা ঘরের চেহারা পালটে দেন, ট্রলি সরিয়ে দেন, শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে খাবারের জোগান দেন, আর্টিস্টদের পোশাক পরিচ্ছদের দেখাশোনা করেন, তাঁদের সংখ্যায় পড়বে টান । তখন কী করবে সেই অসহায় কর্মীরা, যাঁরা দিনের হিসেবে পারিশ্রমিক পান ? এমনিতেই এই লকডাউন তাঁদের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে । অনেকের তিলতিল করে জমানো অর্থ শূন্য হয়েছে । এবার কাজ হারানোর ভয় তাঁদের গ্রাস করছে একটু একটু করে । ETV ভারত সিতারা কথা বলল সেই মানুষগুলোর সঙ্গে, যাঁরা না থাকলে শুটিংয়ের ইউনিট অচল।


কিছুদিন আগেই (পড়ুন লকডাউনের আগেই) সুজয় ঘোষের কন্যা দিয়া ঘোষের ছবি 'বব বিশ্বাস'এর শুটিংয়ে আর্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ছিলেন ফ্লোরের পরিচিত টুটুদা, ভালো নাম প্রসন সায়েন । জিনিসপত্র সরানো, সেটের বিভিন্ন জিনিস ঠিক করা, আরও দু'একজনের সঙ্গে টিম হিসেবে কাজ করতেন টুটুদা । ওড়িশা থেকে আসা কলকাতার এই বাসিন্দা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে । তিনি বললেন, "এই পরিস্থিতিতে কম সংখ্যক লোক নিয়ে কাজ করলে অনেকে কিন্তু কাজ পাবেন না । তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করানো যেতেই পারে । যেমন তিনদিন একজন, আর তিনদিন আরও কয়েকজন । তাতে সকলের কাজ থাকবে । আমাদের যা ডিপার্টমেন্ট, সেখানে একটা কন্টিনিউইটির ব্যাপার থাকে । ফিল্মের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি জরুরি । কাজের প্রেশার খুব বাড়বে । একটা মেগা সিরিয়ালে তিনজন যায় । সেখানে দু'জন গেলে মোটামুটি কাজ হবে । আর একজন গেলে কাজই করা যাবে না । ধরুন, একটা ওয়াড্রোব সরানো হবে, সেটা তো একজনকে নিয়ে হয় না । দু'জন লোক লাগবেই ।"

লকডাউন হওয়ার সময় থেকে একেবারে হাত খালি করে বসে আছেন টুটুবাবু । বললেন, "আমরা বাড়িতে এমনি বসে আছি । বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারিনি । আর যাব কীভাবে, সেখানে তো কোরোনার ভয় । আমার তো বাড়িতে বাচ্চা আছে । কোনও মতে সংসার চলছে ।" ইন্ডাস্ট্রি থেকেও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াননি কেউ, সেই বিষয়টিও জানালেন টুটুবাবু । বললেন, "বলিউডে শুনছি অনেক তারকারা সাহায্য করেছেন । আমি তো এখানে থাকি । আমি আপাতত কিছু পাইনি । আমার গিল্ড থেকে প্রত্যেক মেম্বারকে ১০০০ টাকা করে দিয়েছে । সেটাও আমাদের নিজস্ব পয়সা । আমি আর একটা কথা শুনেছিলাম, আমার বলা উচিত নয়, বলা হয়েছিল আমাদের রাজ্য সরকার থেকে নাকি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক টাকা দিয়েছেন, সবাইকে সাহায্য করা হয়েছে । আমি শুনে অবাক হয়েছি, কারণ আমি তো নিজে কিছু পাইনি । এটা খুব কষ্ট লাগে, যে আমরা কিছুই পেলাম না, আর খবর হল সাহায্য করা হয়েছে । আমরা তো জানি এই পেশায় কাজ না করলে টাকা পাব না । আমাদেরও তো অনেক প্রেশার নিয়ে থাকতে হয় । বাচ্চার স্কুলের প্রেশার থাকে । আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা কোনও অর্থ সাহায্যই পাননি । এই পরিস্থিতিতে আমাদের একমাত্র সহায় ভগবান ।"

শুটিং ফ্লোরের ইলেক্ট্রিকের কাজ করতেন সুনীল মন্ডল । তারপর সেই কাজ করতে শুরু করেন তাঁর ছেলে অজয় মন্ডল । এই লকডাউনের বাজারে কর্মহীন, অর্থহীন অবস্থায় কোনও মতে দিন কাটাচ্ছেন তিনিও । তার উপর বাবাকে হারিয়েছেন ফেব্রুয়ারি মাসেই । চিকিৎসা ও শ্রাদ্ধের কাজ মিলিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে তাঁর । তারপরই গৃহবন্দী হয়েছেন কোরোনার কারণে । এই পরিস্থিতিতে বিষন্নতার সুর শোনা গেল অজয়বাবুর কণ্ঠেও । বললেন, "এই পরিস্থিতিতে সবার আগে কাজ দরকার । কিন্তু সকলকে সামাজিক দূরত্বও মানতে হবে । এই বিষয়টাও কিন্তু অবাঞ্ছনীয় নয়, আমাদের বিষয়টাও অবাঞ্ছনীয় নয় । আমার মনে হয় কাজ চালু রাখা উচিত । কিছুক্ষণ কাজ করলাম, তারপর বাইরে বেরোলাম, অপেক্ষা করলাম, সেভাবেও কাজটা করলে হয় । এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে আমার বাবা মারা গেছেন । আমি আমার বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মানুষ । বাবার চিকিৎসায় ও তারপরের কাজগুলোতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে । তারপরই এই পরিস্থিতি শুরু হয় মার্চ থেকে । আমাদের তহবিল থেকে টাকাও আসেনি । বলেছিল চ্যানেল দেবে, কিন্তু আমি তো কিছু পাইনি । একটা দেড় হাজার টাকার টোকেন পেয়েছিলাম ।"

অন্যদিকে শুটিংয়ে ক্যামেরার সহকারী প্রদীপ আমাদের বলেন, "যতক্ষণ না কাজ শুরু হচ্ছে আমরা কিছুই বলতে পারছি না । এখন তো সবই বন্ধ । শুটিংয়ের যেই নির্দেশিকাগুলো দেওয়া হয়েছিল, তাতে আদতেও কাজ করা সম্ভব নয় । জানি না ওইভাবে কাজ শুরু হলে কী হবে । ওরকমভাবেই হয়তো কাজ করতে হবে । যেটুকু টাকা জমিয়েছিলাম সব তো খরচ হয়ে গেছে ।"

bengali film industry ground level staff
ক্যামেরা হাতে
প্রোডাকশনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রবিবাবু আমাদের বলেন, "এরকম হলে আমাদের সংসার কীভাবে চলবে ? কোনও ডিপার্টমেন্ট থেকে যদি একজন করে নেয়, কী করে চলবে ? এমনিতেই তো মানুষ খেতে পাচ্ছে না । এখন তো বিকল্প পেশা হিসেবেও কিছু ভেবে রাখিনি । আমার ধার করে সংসার চলছে ।"বহু সংখ্যক মানুষের সঙ্গে একটি ধারাবাহিকে কাজ করেন ধনঞ্জয় দত্ত । কিন্তু শোনা যাচ্ছে লকডাউন উঠে গেলে সেই ধারাবাহিক বন্ধও হয়ে যেতে পারে । ধনঞ্জয় কাজ করেন ড্রেস ডিপার্টমেন্টে । কোন চরিত্র কী পোশাক পরবে খবর রাখা, পোশাকের দেখভাল করা, সেটাই তাঁর কাজ । এই পরিস্থিতিতে ধনঞ্জয় আমাদের বলেন, "আর্টিস্টকে রেডি করি, ওঁদের পোশাক দেখি । আমি যেই প্রোজেক্টে কাজ করি সেখানে কম লোক নিয়ে কাজ করলে হবে না । সিরিয়ালটা বন্ধ হলে কাজের সমস্যা তৈরি হবেই । আমরা এমনিতেই খুব অসুবিধের মধ্যে পড়ে আছি । আমার তো আর কোনও কাজ জানা নেই । এটাই আমার পেশা ।"কর্মসংস্থান হারানোর ভয় পাচ্ছেন আর্ট ডিপার্টমেন্টের আর এক কর্মী বাপি । তিনি আমাদের বলেন, "খুব ভয় পাচ্ছি জানেন তো । এই কাজ ছাড়া আমি কিছুই করি না । আমাদের যদি কোনও কারণে বাদ দেওয়া হয়, ঝুট ঝামেলা অশান্তি হবেই । আমরা প্রযোজকদের উপর নির্ভর করছি । দাদারা নিশ্চয়ই বিষয়টা দেখবেন । আজ এই সেট কাল ওই সেটে ঘুরে ঘুরে কাজ করছিলাম । এখন বসেই আছি । এখন আমাদের সেক্রেটারির কাছে যেতে হবে, আর কিছুই করার নেই ।"ট্রলির কাজ করেন লাল বাহাদুর দাস । দু'জন কর্মী প্রয়োজন হয় এই কাজে । ট্রলি পেতে লাইনের উপর ট্র্যাক তুলতে হয় । ক্যামেরা বসাতে হয় তার উপর । শট নেওয়া হলে, তার উপর মনিটারিংও করা হয় । লাল বাহাদুর আমাদের বলেন, "আমরা ডিসটেন্স রেখেও কাজ করতে পারি । সেই সুবিধে আছে । কী হবে বা কী হতে চলেছে, তাই নিয়ে কোনও খবর পাইনি । এতদিন বসে থাকার কারণে আমাদের সকলেরই একটা আর্থিক সমস্যা হয়ে গেছে । আমার বাড়িতে দুটো বাচ্চা, মা, আমি, বউ আছি । আমাদের সকলের অবস্থাই খুব শোচনীয় ।" দীর্ঘদিনের হেয়ার ড্রেসার হেমা মুন্সী বলেন, "আমাদের PPE পরে কাজ করতে হবে কিনা, সেটা নিয়ে তেমন কোনও গাইডলাইন তো তৈরি হয়নি । আমরা ইউনিটে প্রায় 80 জন থাকি । সেটাই কিন্তু শিফটিং ডিউটি করে করা যায় । আমার অ্যাসিস্ট্যান্টদের তো ফ্লোরেই কাজ থাকে । আর আমরা যে সকলে গায়ের উপর উঠে কাজ করি তাও কিন্তু নয় । আমাদেরও একহাত দূরত্ব বজায় রেখেই কাজ করতে হয় । তার উপর যাঁরা মেকআপের ব্যবসা করে বড়বড় তাঁদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে । কালার প্যালেট থেকে রং তুলে যেমন আর্টিস্টরা ছবি আঁকে, আমাদেরও সেভাবেই করতে হবে মেকআপ । তারপর একজনের মেকআপ হয়ে গেলে ব্রাশ স্যানিটাইজ় করতে হবে । তবে মসকারা, লিপস্টিক, কাজল এগুলো পার্সোনাল হলেই ভালো । অনেক আর্টিস্টরা এগুলো নিজেরাই আনেন । আমাদের জিনিসগুলো তো স্যানিটাইজ় করা সহজ । এই যে রটে গেছে, শুটিং মানেই ঘনিষ্ঠতা, এটা একটা ভুল বিষয় । এগুলো নিয়ে আমরা ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনাও করব।"

সব মিলিয়ে প্রত্যেকেই একটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে । কোরোনা, লকডাউন, আমফান সবকিছু যেন একটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এই মানুষগুলোকে । কীভাবে কী হবে কেউ বুঝতে পারছেন না । তবুও আশা করছেন যে, সুদিন আসবেই । এবার সময়ের উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.