প্রকল্পের সামনে ক্রমবর্দ্ধমান সমস্যা
আমাদের সবাইকেই সময়ের সঙ্গে বদলাতে হয় । আমাদের আধুনিক প্রযুক্তিকে সবসময়ই বরণ করে নেওয়া উচিত । নয়তো আমরা এই প্রতিযোগিতার বিশ্বে পিছিয়ে পড়ব । এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় কুড়িটি দেশে বুলেট ট্রেন দৌড়চ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে জাপান, চিন ও ব্রিটেন । বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠা ভারতে এই হাই-স্পিড ট্রেনের কথা এখনও শোনা যায়নি । প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর তিন বছর আগে স্থাপিত হলেও, জমি অধিগ্রহণের মতো সমস্যাকে এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি । এর ওপরে, কেন্দ্র আরও সাতটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে । বাণিজ্য-রাজধানী মুম্বইয়ের সঙ্গে হায়দরাবাদের যোগাযোগকারী করিডর তার মধ্যে একটি । যেখানে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়া আনন্দদায়ক । সেখানে দুশ্চিন্তা হয় এজন্য যে শুরুতে যে উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, তাতে কোনও অগ্রগতি হয়নি ।
জাপান – বুলেট ট্রেনের আদর্শ উদাহরণ
জাপান হচ্ছে বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে বুলেট ট্রেন চালু হয়েছিল । টোকিও এবং ওসাকা শহরের মধ্যে সংযোগস্থাপনকারী হাই-স্পিড ট্রেন পরিষেবা চালু হয়েছিল 1964 সালেই । বুলেট ট্রেন ব্যবস্থাই অন্যতম কারণ, যে জাপান অ্যামেরিকা ও চিনের পরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে উঠে এসেছে । যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে জাপানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল । তারপর থেকে সরকার ও জনগণ সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে একসঙ্গে ঘাম ঝরিয়েছে । জাপান দেশের মধ্যে সার্বিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটা বুলেট ট্রেন প্রকল্প হাতে নিয়েছে । এতে দেশের বাণিজ্যক্ষেত্র এবং অর্থনীতিতে বিপ্লব এসেছে । শিল্পগুলো মানবসম্পদকে ভালভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে, কারণ যাতায়াতের সময় কমে গিয়ে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে । একইসঙ্গে পর্যটনের প্রসার ঘটেছে । এভাবেই জাপানে অর্থনীতি এগোতে শুরু করেছে । জাপানের মতো দেশে বুলেট ট্রেনের শক্তি ও দক্ষতার উদাহরণ হল, ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য এবং বছরে গড় বিলম্ব মাত্র 20 সেকেন্ডের । মোদি সরকার জাপানের সহযোগিতায় মুম্বই থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত 508 কিলোমিটার দীর্ঘ বুলেট ট্রেন লাইন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে । 2017 সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পের সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি । প্রকল্পের আনুমানিক খরচ 1.08 লাখ কোটি টাকা । এর মধ্যে 81 শতাংশ জাপান ঋণ হিসেবে দিচ্ছে । লক্ষ্য, অন্তত 2023 সালে প্রথম যাত্রাটি করা । 2022 সালে যখন ভারত 75 বছরে পা দেবে, তখন কেন্দ্রের আশা সেই বছরের অগাস্টে বুলের পরিষেবা চালু করা । সেই পর্যন্ত শুরুর দিনটাকে এগিয়ে আনা হয়েছে ।
কৃষকদের আশ্বস্ত করা প্রয়োজন
বুলেট ট্রেন ঘণ্টায় 320 কিলোমিটার বেগে দৌড়ায় । ন্যাশনাল হাই স্পিড রেল কর্পোরেশনের (NHSRC) দাবি, এতে আহমেদাবাদ থেকে মুম্বইয়ে যাতায়াতের সময় তিন ঘণ্টায় নেমে আসবে । যদিও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর তিন বছর কেটে গেলেও এই প্রকল্পে বিশেষ কোনও অগ্রগতি হয়নি । এই করিডরের নির্মাণের জন্য প্রয়োজন 1380 হেক্টর জমি । গুজরাতে দরকার 940 হেক্টর জমি, 431 হেক্টর মহারাষ্ট্রে এবং বাকিটা দাদরানগর হাভেলিতে । এর মধ্যে মাত্র 63 শতাংশ জমি সংগ্রহ করা গেছে এখনও পর্যন্ত । এর পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, কেন্দ্র ও NHSRCL প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা 2028 পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে । সেই অনুযায়ী প্রকল্পের খরচও বেড়ে যাবে ! মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে সম্প্রতি প্রকাশ্য বিবৃতিতেই বলেছেন যে, এই প্রকল্প তাঁদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই । উদ্ধব মুম্বই-আহমেদাবাদ প্রকল্পকে অগ্রাহ্য করছেন, কারণ তিনি মনে করেন যে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি উচ্চাকাঙ্খী । গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে, একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে এভাবে কথা বলেন, তাহলে একজন কৃষক রাজ্য বা দেশের স্বার্থে তাঁর কৃষিজমি ছাড়তে এগিয়ে আসবেন, এটা আশা করা যায় না ।
একবার কৃষিজমি হাতছাড়া হলেই কৃষকদের রাস্তার পাশে থাকতে হবে । প্রকল্পের জন্য তাঁরা জীবিকা হারালে বিপদে পড়বেন । তাই কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে কৃষকদের আত্মবিশ্বাস জোগাতে হবে এবং তাঁদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে পদক্ষেপ করতে হবে । বুলেট ট্রেন চালু হলে দেশের কী কী উপকার হবে, সেটা তাঁদের বোঝাতে হবে । আরও ভালো পুনর্বাসনের সুবিধা দিতে হবে । বাজারদরের থেকে তাঁদের জমির দাম আরও বেশি দিতে হবে । গৃহহারাদের জন্য বাড়ি তৈরি এবং অধিগৃহীত জমির বদলে অন্যত্র জমি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে । প্রয়োজন হলে সরকারকে এগিয়ে এসে চাকরিও দিতে হবে । এগুলি সম্ভব হলেই দেশ বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন সফল করার পথে সত্যি অগ্রসর হবে ।
মান্দা নবীন কুমার গৌড়