ETV Bharat / lifestyle

অন্যতম জটিল রোগের সরল ব্যাখ্যা : ক্যানসার

ক্যানসারের ক্ষেত্রে জিনস্তরে আমাদের স্বাভাবিক কোষে কিছু ভুলভ্রান্তি ঘটে । যেমনটা আমরা জানি যে, প্রতিটা কোষে 20,000-25,000 জিন থাকে আর ক্যানসারের ক্ষেত্রে শয়ে শয়ে জিনের বদল ঘটে । বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, বিভিন্ন ধরনের কারণের জন্য হয় । যেমন ফুসফুসের ক্যানসার সিগারেট সেবনের জন্য হয় আর লিভারের ক্যানসার হয় মদ্যপানের কারণে ।

Cancer
ক্যানসার
author img

By

Published : Jan 20, 2021, 8:15 AM IST

‘নিজেদের সহজাত আণবিক গঠনের কারণে ক্যানসার কোষগুলি হল আমাদেরই অতিসক্রিয়, বেঁচে থাকার অধিকারী, স্তরে স্তরে গঠিত, উর্বর এবং উদ্ভাবনীশক্তি সম্পন্ন প্রতিলিপি’–সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়, এমপারার অফ অল ম্যালাডিজ় – এ বায়োগ্রাফি অফ ক্যানসার ।

ক্যানসার হল অন্যতম জটিল একটি রোগ এবং সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় একে যথার্থভাবেই ‘এমপারার অফ অল ম্যালাডিজ়’ অর্থাৎ সব রোগব্যাধির সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন । প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের ক্যানসারে মৃত্যু হয় এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও আমরা এখনও কোনও আরোগ্যপ্রক্রিয়া বের করে উঠতে পারিনি, যার প্রয়োগে সমস্ত ক্যানসার আক্রান্তদের প্রাণ বাঁচানো যায় । ক্যানসার আসলে ঠিক কী, তা বুঝতে আমাদের আগে জানতে হবে কোষ কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে । কোষ হল আমাদের শরীরের সবচেয়ে ছোট অংশ যেমন দেওয়ালের একটা ইঁট এবং এটি কোষ-কলা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনের নানা ধরনের প্রক্রিয়ার বিন্যাস সম্পাদন করে । একটি কোষ আলাদা আলাদাভাবে জিনকে ফুটিয়ে তুলে কাজ করে । পরিণত লাল লোহিতকণিকা ছাড়া আমাদের শরীরের প্রতিটা কোষে 20,000-25,000টি করে জিন থাকে, যা হল ডিএনএ-র কার্যকরী প্রসারণ । প্রতিটি জিনের কোড তথা নির্দেশাবলী থাকে, যার মাধ্যমে প্রোটিন সংশ্লেষ এবং জটিল ধরনের প্রোটিন যেমন উৎসেচক, রিসেপটর, লিগ্যান্ড প্রভৃতির সংশ্লেষ হয় । এগুলি কোষকে কার্যকরী বৈশিষ্ট্য প্রদান করে । কিন্তু শুধু প্রোটিনেই গল্প শেষ নয় । এই ধরনের প্রোটিনের কাজ বিপাক প্রক্রিয়া এবং বেশ কিছু মেটাবোলাইটস প্রক্রিয়ারও জন্ম দেয়। এই মেটাবোলাইটস প্রোটিন ও অন্যান্য বায়োমলিকিউলের সঙ্গে মিলে কোষকে কাজ করতে সাহায্য করে । এমনকী, কোনও স্বাভবিক কোষও নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজিত হতে পারে । যখন কোনও কোষ, অস্বস্তিকর কোনও পরিবেশের ইঙ্গিত পায়, তখন তা তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, একাধিক ধরনের জটিল প্রোটিন সিগন্যালিং এবং মেটাবোলাইটসের মাধ্যমে । কিন্তু যখন চাপের স্তর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন এটি ‘অ্যাপোপটোসিস’ (প্রথামাফিক মৃতু্য) করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে অথবা চাপ কাটাতে এটি কোষ বিভাজন বন্ধ করে দিতে পারে। যে কোনও সিস্টেমের মতোই, কোষব্যবস্থাও কোনও ভুলভ্রান্তি-রহিত নয় এবং সামান্য বদলের প্রতি সংবেদনশীল । আমরা যদি ক্যানসার প্রসঙ্গে কোষের অস্বাভাবিক ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে বলতে হয় এটি জিনগত । জীবিত কোনওকিছুর কোনও ক্রিয়া বা বৈশিষ্ট্য হল পরিবেশ এবং জিনের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া । সুতরাং, জিনের (মিউটেশন) বদল হতে পারে পরিবেশগত বিভিন্ন নিয়ামকের কারণে যেমন ধূমপান, মদ্যপান, তামাক এবং কীটনাশকের ব্যবহার প্রভৃতি অথবা এটা ভুল করতে পারে সময় বিভাজনের ক্ষেত্রে । যেমনটা আমরা জানি যে একটি কোষ নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজিত হতে পারে, সেক্ষেত্রে ক্যানসার আক্রান্ত কোষ অনির্দিষ্টবার বিভাজিত হতে পারে যা একাধিক কোষের জন্ম দেয়, সাধারণভাবে যাকে টিউমার বলা হয় । সুতরাং, ক্যানসারের ক্ষেত্রে জিনস্তরে আমাদের স্বাভাবিক কোষে কিছু ভুলভ্রান্তি ঘটে । যেমনটা আমরা জানি যে, প্রতিটা কোষে 20,000-25,000 জিন থাকে আর ক্যানসারের ক্ষেত্রে শয়ে শয়ে জিনের বদল ঘটে । বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার আছে এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, বিভিন্ন ধরনের কারণের জন্য হয়। যেমন ফুসফুসের ক্যানসার সিগারেট সেবনের জন্য হয় আর লিভারের ক্যানসার হয় মদ্যপানের কারণে ।

সবচেয়ে সাধারণ যে প্রশ্নগুলি মাথায় আসে, তা হল কেন এর নিরাময়ের কোনও থেরাপি নেই? ক্যানসারের একাধিক থেরাপি আছে কিন্তু সমস্ত ওষুধ (কেমোথেরাপি) 100 শতাংশ সক্রিয় নয় এবং বিভিন্ন রোগীর উপর এদের প্রভাবও বিভিন্ন হয় । আমরা জিনগতভাবে কোনও না কোনওভাবে একে অনে্যর থেকে আলাদা (যা আমাদের ব্যতিক্রমী করে তোলে) এবং এটাই হল অন্যতম কারণ যে, একই ধরনের ক্যানসার হওয়া সত্ত্বেও একই ওষুধে সকলের একই রকম কাজ হয় না । যদিও এটাই যে সামগ্রিক ছবি তা নয় এবং ওষুধের পরিবর্তনশীল প্রভাবের কারণ হতে পারে আমাদের জীবনযাত্রা যেমন ডায়েট, শরীরচর্চা অথবা শরীরে অন্য কোনও রোগের উপস্থিতি যেমন ডায়াবিটিস বা এইডস । আরেকটা প্রশ্ন যেটা প্রায়ই মাথায় আসে, সেটা হল ক্যানসারটা ঠিক কোন স্টেজে বা স্তরে আছে । আমরা প্রায়ই শুনি, ক্যানসারের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্টেজ আছে । এই স্টেজগুলি কী এবং কেন, অ্যাডভান্সড স্টেজে ক্যানসার বা তৃতীয়-চতুর্থ স্টেজের ক্যানসারের শ্রুশুষা কঠিন । এখন আমরা জানি, একটি ক্যানসার কোষের অনির্দিষ্টবার বিভাজিত হওয়ার ক্ষমতা আছে যা পরবর্তীকালে টিউমার মাসে পরিণত হয় । এই টিউমার নির্দিষ্ট কোনও স্থানে বা অঙ্গে তৈরি হয় এবং যখন এটি আকারে ছোট থাকে এবং স্থানীয় ধরনের হয়, তখনই তাকে ক্যানসারের প্রথম স্টেজ বা ‘আর্লি স্টেজ’ বলা হয় । এবার সেই টিউমার যত বেশি আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনই এটি ছড়াতে থাকে অথবা নিকটবর্তী স্থান যেমন লিম্ফ নোড এবং কোষকলাগুলিকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিতে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, স্তন থেকে ক্যানসার মস্তিষ্কে ছড়াতে পারে । সাধারণ অর্থে বলতে গেলে আমরা বুঝতে পারি যে, যা কিছু স্থানীয় এবং এক জায়গায় স্বল্প পরিসরে অবস্থান করে, তা সহজেই সরিয়ে ফেলা যায় । আর যা শরীরের নানা অংশে ইতিমধে্যই অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে থাকে, তা দূর করা কঠিন । আর ঠিক এই কারণেই অ্যাডভান্সড স্টেজের ক্যানসারের চিকিৎসা করা খুবই কঠিন । ক্যানসার থেরাপির মধে্য রেডিয়েশন, ওষুধপত্র, অস্ত্রোপচার প্রভৃতি নানা ধরনের পদ্ধতিই রয়েছে । একজন চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে, ক্যানসার হল সেই সব রোগব্যধির অন্যতম যার চিকিৎসা করতে গিয়ে বহু পেশাদার চিকিৎসক, সার্জনদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে । ক্যানসার হল এমন একটি রোগ, যা এককভাবে দেখিয়েছে চিকিৎসার একক পদ্ধতির যাবতীয় ত্রুটিসমূহ । পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের একজোট হতেও বাধ্য করেছে । সেই সব দিন এখন অতীত, যখন কোনও ক্যানসার আক্রান্তকে সিলোয় চিকিৎসা করতেন তাও আবার কোনও একজন নির্দিষ্ট চিকিৎসকই । আর যে কোনও ক্যানসার আক্রান্ত ব্যক্তি, যা সে তিনি যত প্রত্যন্ত এলাকাতেই থাকুন না কেন, অংকোলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন এবং একইসঙ্গে বহুস্তরীয় প্যানেলের তরফেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন । তেমন প্যানেলে থাকেন জেনারেল ফিজিশিয়ান, সার্জন, কেমো-থেরাপিস্ট, রেডিওথেরাপিস্ট এবং কোনও কোনও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে তো একজন ইমিউনোলজিস্টও (ক্যানসার কোষের সঙ্গে দেহের স্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেমের লড়াইকে যিনি সঠিক দিশায় পরিচালিত করতে সাহায্য করেন) থাকেন । সুসংবাদ এখানেই শেষ হচ্ছে না । যদিও কোভিড-১৯ এর ফলে ক্যানসার চিকিৎসার নয়া দিশার খোঁজে হওয়া গবেষণায় অনুদানে কাটছাঁট হয়েছে, তবুও চিকিৎসা জগতে আকস্মিক ও বিপুল অগ্রগতি গৃহীত হয়েছে ‘প্রিসিশন অ্যান্ড পার্সোনালাইজড মেডিসিন (পিপিএম) এবং নন-ইন্টারভেনশনাল থেরাপির ক্ষেত্রে । পিপিএম-এ ক্যানসার থেকে সম্পূর্ণ উপশম মেলে আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সামান্য । এটা হয় কোনও আক্রান্তের নিজস্ব জেনেটিক গঠন বিচার করে, তার স্বাস্থ্যের অবস্থার অতীত ইতিহাস নিরীক্ষণ করে এবং ক্যানসার সৃষ্টিকারী অনুঘটকের সংস্পর্শে এলে কী হয়, সেই সব কিছু বিশ্লেষণ করে তার জন্য অনুযায়ী একক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এসে । আবার অন্যদিকে, প্রোটন লেজার থেরাপির মতো প্রযুক্তি ‘ক্যানসার হত্যাকারী’ যন্ত্র হিসাবে পরিচিত যা টিউমার কোষগুলিকে টার্গেট করে, বেছে বেছে নিখুঁত দক্ষতায় ধ্বংস করে, স্থানীয় কোষগুলির উপর কোনও প্রভাব না ফেলেই । এই ধরনের রেডিয়েশন থেরাপির আবির্ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, চোখ, এবং প্রস্টেটের অস্ত্রোপচারে আগে যে দুর্বলতা দেখা যেত, তা কমে যায়, ফলে অস্ত্রোপচার পরবর্তী আরোগ্যলাভ আরও সহজ হবে ।

আরও পড়ুন : বিশ্ব ক্যানসার দিবস : মারণ রোগ থেকে কীভাবে দূরে থাকবেন

গল্পের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যে কোনও ক্যানসারজয়ী আপনাকে এটাই বলবে যে, এই লড়াই যতটা শারীরিক, ততটা মানসিকও । মৃতু্যর ভয়, চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত উদ্বেগ, রোগ সম্পর্কে কলঙ্ক, চিকিৎসার খরচ এবং পরিবারের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ানোর চিন্তা–কোনও ক্যানসার আক্রান্তের মনে সাধারণত এই ধরনের চিন্তাগুলিই চলতে থাকে । ক্যানসার চিকিৎসার কষ্টকর যাত্রা সহজ করার সমাধান হল চিকিৎসার ‘ভ্যালু অ্যাডেড কেয়ার মডেল’। কেয়ারগিভারদের প্যানেলে থাকেন একজন কাউন্সিলর, একজন প্রশিক্ষক, ফিজ়িওথেরাপিস্ট, পুষ্টিবিদ এবং চিকিৎসাজগতের সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকে, যারা একজোট হয়ে সার্বিকভাবে আরোগ্যলাভে সাহায্য করেন । এই ধরনের পদক্ষেপে কেবল অভাবনীয়ভাবে কোনও ক্যানসার রোগীর রোগনির্ণয় (পশ্চিমে যা প্রমাণ করেছে অ্যানোভা হেলথ কেয়ার) আরও নিখুঁতই হয় না, বরং আরও বেশি সাশ্রয়ী হয় ইনসু্যরেন্স দাতা এবং আর্থিক সহায়তাপ্রদানকারীদের মাধ্যমে, কারণ এতে অ্যাডভান্সড স্টেজে রোগ চলে যাওয়াকে আটকানো সম্ভব হয় ।

পীযূশ প্রসাদ

রিসার্চ ফেলো

স্যার গঙ্গা রাম হাসপাতাল

ডা. নাদিম আহমেদ

হেলথকেয়ার কনসালটেন্ট এবং এমার্জেন্সি ফিজিশিয়ান

‘নিজেদের সহজাত আণবিক গঠনের কারণে ক্যানসার কোষগুলি হল আমাদেরই অতিসক্রিয়, বেঁচে থাকার অধিকারী, স্তরে স্তরে গঠিত, উর্বর এবং উদ্ভাবনীশক্তি সম্পন্ন প্রতিলিপি’–সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়, এমপারার অফ অল ম্যালাডিজ় – এ বায়োগ্রাফি অফ ক্যানসার ।

ক্যানসার হল অন্যতম জটিল একটি রোগ এবং সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় একে যথার্থভাবেই ‘এমপারার অফ অল ম্যালাডিজ়’ অর্থাৎ সব রোগব্যাধির সম্রাট বলে অভিহিত করেছেন । প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের ক্যানসারে মৃত্যু হয় এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও আমরা এখনও কোনও আরোগ্যপ্রক্রিয়া বের করে উঠতে পারিনি, যার প্রয়োগে সমস্ত ক্যানসার আক্রান্তদের প্রাণ বাঁচানো যায় । ক্যানসার আসলে ঠিক কী, তা বুঝতে আমাদের আগে জানতে হবে কোষ কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে । কোষ হল আমাদের শরীরের সবচেয়ে ছোট অংশ যেমন দেওয়ালের একটা ইঁট এবং এটি কোষ-কলা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনের নানা ধরনের প্রক্রিয়ার বিন্যাস সম্পাদন করে । একটি কোষ আলাদা আলাদাভাবে জিনকে ফুটিয়ে তুলে কাজ করে । পরিণত লাল লোহিতকণিকা ছাড়া আমাদের শরীরের প্রতিটা কোষে 20,000-25,000টি করে জিন থাকে, যা হল ডিএনএ-র কার্যকরী প্রসারণ । প্রতিটি জিনের কোড তথা নির্দেশাবলী থাকে, যার মাধ্যমে প্রোটিন সংশ্লেষ এবং জটিল ধরনের প্রোটিন যেমন উৎসেচক, রিসেপটর, লিগ্যান্ড প্রভৃতির সংশ্লেষ হয় । এগুলি কোষকে কার্যকরী বৈশিষ্ট্য প্রদান করে । কিন্তু শুধু প্রোটিনেই গল্প শেষ নয় । এই ধরনের প্রোটিনের কাজ বিপাক প্রক্রিয়া এবং বেশ কিছু মেটাবোলাইটস প্রক্রিয়ারও জন্ম দেয়। এই মেটাবোলাইটস প্রোটিন ও অন্যান্য বায়োমলিকিউলের সঙ্গে মিলে কোষকে কাজ করতে সাহায্য করে । এমনকী, কোনও স্বাভবিক কোষও নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজিত হতে পারে । যখন কোনও কোষ, অস্বস্তিকর কোনও পরিবেশের ইঙ্গিত পায়, তখন তা তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, একাধিক ধরনের জটিল প্রোটিন সিগন্যালিং এবং মেটাবোলাইটসের মাধ্যমে । কিন্তু যখন চাপের স্তর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন এটি ‘অ্যাপোপটোসিস’ (প্রথামাফিক মৃতু্য) করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে অথবা চাপ কাটাতে এটি কোষ বিভাজন বন্ধ করে দিতে পারে। যে কোনও সিস্টেমের মতোই, কোষব্যবস্থাও কোনও ভুলভ্রান্তি-রহিত নয় এবং সামান্য বদলের প্রতি সংবেদনশীল । আমরা যদি ক্যানসার প্রসঙ্গে কোষের অস্বাভাবিক ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে বলতে হয় এটি জিনগত । জীবিত কোনওকিছুর কোনও ক্রিয়া বা বৈশিষ্ট্য হল পরিবেশ এবং জিনের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া । সুতরাং, জিনের (মিউটেশন) বদল হতে পারে পরিবেশগত বিভিন্ন নিয়ামকের কারণে যেমন ধূমপান, মদ্যপান, তামাক এবং কীটনাশকের ব্যবহার প্রভৃতি অথবা এটা ভুল করতে পারে সময় বিভাজনের ক্ষেত্রে । যেমনটা আমরা জানি যে একটি কোষ নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজিত হতে পারে, সেক্ষেত্রে ক্যানসার আক্রান্ত কোষ অনির্দিষ্টবার বিভাজিত হতে পারে যা একাধিক কোষের জন্ম দেয়, সাধারণভাবে যাকে টিউমার বলা হয় । সুতরাং, ক্যানসারের ক্ষেত্রে জিনস্তরে আমাদের স্বাভাবিক কোষে কিছু ভুলভ্রান্তি ঘটে । যেমনটা আমরা জানি যে, প্রতিটা কোষে 20,000-25,000 জিন থাকে আর ক্যানসারের ক্ষেত্রে শয়ে শয়ে জিনের বদল ঘটে । বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার আছে এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, বিভিন্ন ধরনের কারণের জন্য হয়। যেমন ফুসফুসের ক্যানসার সিগারেট সেবনের জন্য হয় আর লিভারের ক্যানসার হয় মদ্যপানের কারণে ।

সবচেয়ে সাধারণ যে প্রশ্নগুলি মাথায় আসে, তা হল কেন এর নিরাময়ের কোনও থেরাপি নেই? ক্যানসারের একাধিক থেরাপি আছে কিন্তু সমস্ত ওষুধ (কেমোথেরাপি) 100 শতাংশ সক্রিয় নয় এবং বিভিন্ন রোগীর উপর এদের প্রভাবও বিভিন্ন হয় । আমরা জিনগতভাবে কোনও না কোনওভাবে একে অনে্যর থেকে আলাদা (যা আমাদের ব্যতিক্রমী করে তোলে) এবং এটাই হল অন্যতম কারণ যে, একই ধরনের ক্যানসার হওয়া সত্ত্বেও একই ওষুধে সকলের একই রকম কাজ হয় না । যদিও এটাই যে সামগ্রিক ছবি তা নয় এবং ওষুধের পরিবর্তনশীল প্রভাবের কারণ হতে পারে আমাদের জীবনযাত্রা যেমন ডায়েট, শরীরচর্চা অথবা শরীরে অন্য কোনও রোগের উপস্থিতি যেমন ডায়াবিটিস বা এইডস । আরেকটা প্রশ্ন যেটা প্রায়ই মাথায় আসে, সেটা হল ক্যানসারটা ঠিক কোন স্টেজে বা স্তরে আছে । আমরা প্রায়ই শুনি, ক্যানসারের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্টেজ আছে । এই স্টেজগুলি কী এবং কেন, অ্যাডভান্সড স্টেজে ক্যানসার বা তৃতীয়-চতুর্থ স্টেজের ক্যানসারের শ্রুশুষা কঠিন । এখন আমরা জানি, একটি ক্যানসার কোষের অনির্দিষ্টবার বিভাজিত হওয়ার ক্ষমতা আছে যা পরবর্তীকালে টিউমার মাসে পরিণত হয় । এই টিউমার নির্দিষ্ট কোনও স্থানে বা অঙ্গে তৈরি হয় এবং যখন এটি আকারে ছোট থাকে এবং স্থানীয় ধরনের হয়, তখনই তাকে ক্যানসারের প্রথম স্টেজ বা ‘আর্লি স্টেজ’ বলা হয় । এবার সেই টিউমার যত বেশি আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনই এটি ছড়াতে থাকে অথবা নিকটবর্তী স্থান যেমন লিম্ফ নোড এবং কোষকলাগুলিকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিতে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, স্তন থেকে ক্যানসার মস্তিষ্কে ছড়াতে পারে । সাধারণ অর্থে বলতে গেলে আমরা বুঝতে পারি যে, যা কিছু স্থানীয় এবং এক জায়গায় স্বল্প পরিসরে অবস্থান করে, তা সহজেই সরিয়ে ফেলা যায় । আর যা শরীরের নানা অংশে ইতিমধে্যই অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে থাকে, তা দূর করা কঠিন । আর ঠিক এই কারণেই অ্যাডভান্সড স্টেজের ক্যানসারের চিকিৎসা করা খুবই কঠিন । ক্যানসার থেরাপির মধে্য রেডিয়েশন, ওষুধপত্র, অস্ত্রোপচার প্রভৃতি নানা ধরনের পদ্ধতিই রয়েছে । একজন চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে, ক্যানসার হল সেই সব রোগব্যধির অন্যতম যার চিকিৎসা করতে গিয়ে বহু পেশাদার চিকিৎসক, সার্জনদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে । ক্যানসার হল এমন একটি রোগ, যা এককভাবে দেখিয়েছে চিকিৎসার একক পদ্ধতির যাবতীয় ত্রুটিসমূহ । পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের একজোট হতেও বাধ্য করেছে । সেই সব দিন এখন অতীত, যখন কোনও ক্যানসার আক্রান্তকে সিলোয় চিকিৎসা করতেন তাও আবার কোনও একজন নির্দিষ্ট চিকিৎসকই । আর যে কোনও ক্যানসার আক্রান্ত ব্যক্তি, যা সে তিনি যত প্রত্যন্ত এলাকাতেই থাকুন না কেন, অংকোলজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন এবং একইসঙ্গে বহুস্তরীয় প্যানেলের তরফেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন । তেমন প্যানেলে থাকেন জেনারেল ফিজিশিয়ান, সার্জন, কেমো-থেরাপিস্ট, রেডিওথেরাপিস্ট এবং কোনও কোনও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে তো একজন ইমিউনোলজিস্টও (ক্যানসার কোষের সঙ্গে দেহের স্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেমের লড়াইকে যিনি সঠিক দিশায় পরিচালিত করতে সাহায্য করেন) থাকেন । সুসংবাদ এখানেই শেষ হচ্ছে না । যদিও কোভিড-১৯ এর ফলে ক্যানসার চিকিৎসার নয়া দিশার খোঁজে হওয়া গবেষণায় অনুদানে কাটছাঁট হয়েছে, তবুও চিকিৎসা জগতে আকস্মিক ও বিপুল অগ্রগতি গৃহীত হয়েছে ‘প্রিসিশন অ্যান্ড পার্সোনালাইজড মেডিসিন (পিপিএম) এবং নন-ইন্টারভেনশনাল থেরাপির ক্ষেত্রে । পিপিএম-এ ক্যানসার থেকে সম্পূর্ণ উপশম মেলে আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সামান্য । এটা হয় কোনও আক্রান্তের নিজস্ব জেনেটিক গঠন বিচার করে, তার স্বাস্থ্যের অবস্থার অতীত ইতিহাস নিরীক্ষণ করে এবং ক্যানসার সৃষ্টিকারী অনুঘটকের সংস্পর্শে এলে কী হয়, সেই সব কিছু বিশ্লেষণ করে তার জন্য অনুযায়ী একক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে এসে । আবার অন্যদিকে, প্রোটন লেজার থেরাপির মতো প্রযুক্তি ‘ক্যানসার হত্যাকারী’ যন্ত্র হিসাবে পরিচিত যা টিউমার কোষগুলিকে টার্গেট করে, বেছে বেছে নিখুঁত দক্ষতায় ধ্বংস করে, স্থানীয় কোষগুলির উপর কোনও প্রভাব না ফেলেই । এই ধরনের রেডিয়েশন থেরাপির আবির্ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, চোখ, এবং প্রস্টেটের অস্ত্রোপচারে আগে যে দুর্বলতা দেখা যেত, তা কমে যায়, ফলে অস্ত্রোপচার পরবর্তী আরোগ্যলাভ আরও সহজ হবে ।

আরও পড়ুন : বিশ্ব ক্যানসার দিবস : মারণ রোগ থেকে কীভাবে দূরে থাকবেন

গল্পের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যে কোনও ক্যানসারজয়ী আপনাকে এটাই বলবে যে, এই লড়াই যতটা শারীরিক, ততটা মানসিকও । মৃতু্যর ভয়, চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত উদ্বেগ, রোগ সম্পর্কে কলঙ্ক, চিকিৎসার খরচ এবং পরিবারের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়ানোর চিন্তা–কোনও ক্যানসার আক্রান্তের মনে সাধারণত এই ধরনের চিন্তাগুলিই চলতে থাকে । ক্যানসার চিকিৎসার কষ্টকর যাত্রা সহজ করার সমাধান হল চিকিৎসার ‘ভ্যালু অ্যাডেড কেয়ার মডেল’। কেয়ারগিভারদের প্যানেলে থাকেন একজন কাউন্সিলর, একজন প্রশিক্ষক, ফিজ়িওথেরাপিস্ট, পুষ্টিবিদ এবং চিকিৎসাজগতের সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকে, যারা একজোট হয়ে সার্বিকভাবে আরোগ্যলাভে সাহায্য করেন । এই ধরনের পদক্ষেপে কেবল অভাবনীয়ভাবে কোনও ক্যানসার রোগীর রোগনির্ণয় (পশ্চিমে যা প্রমাণ করেছে অ্যানোভা হেলথ কেয়ার) আরও নিখুঁতই হয় না, বরং আরও বেশি সাশ্রয়ী হয় ইনসু্যরেন্স দাতা এবং আর্থিক সহায়তাপ্রদানকারীদের মাধ্যমে, কারণ এতে অ্যাডভান্সড স্টেজে রোগ চলে যাওয়াকে আটকানো সম্ভব হয় ।

পীযূশ প্রসাদ

রিসার্চ ফেলো

স্যার গঙ্গা রাম হাসপাতাল

ডা. নাদিম আহমেদ

হেলথকেয়ার কনসালটেন্ট এবং এমার্জেন্সি ফিজিশিয়ান

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.