প্রারম্ভ: ভারতের স্টার্ট আপ উদ্যোগের আন্তর্জাতিক সম্মেলন

ভারতের ক্ষেত্রে বিমস্টেক-এর ভূমিকা অপরিসীম । এই নিরপেক্ষ মঞ্চ ভারতের প্রধান দুই বিদেশ নীতি— প্রতিবেশী প্রথম নীতি এবং পূর্বে তাকাও নীতিকে বাস্তবায়িত করতে বিশেষ সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে চিনা বিনিয়োগ (যেমন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)-কেও কড়া টক্কর দিতে ভারতকে সাহায্য করতে পারে বিমস্টেক-এর এই মঞ্চ।

প্রারম্ভ । ভারতের স্টার্ট আপের দুই দিন ব্যাপি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করছে শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য উদ্যোগ দপ্তর এবং কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রক । নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে 2018 সালের অগাস্ট মাসে বিমস্টেক-এর চতুর্থ সম্মেলনে শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সংক্রান্ত ঘোষণা করেছিলেন । সেই ঘোষণা অনুসারেই দুই দিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। বিমস্টেক-এর সেই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যা ঘোষণা করেছিলেন তা হল—

• সদস্য দেশগুলির মধ্যে সমঝোতা ও বিশ্বাস আরও গভীর করা এবং বিমস্টেক-এর নীতি নির্ধারক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে তোলা।
• সাংসদ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাজগত সংক্রান্ত, রিসার্চ প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মিডিয়া সমাজ ইত্যাদিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়িয়ে বিমস্টেক-এর মঞ্চের সম্ভাব্য এবং যথাযথ ব্যবহার ।

‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া স্কিম’ ভারত সরকারের একটি উদ্যোগ । এর মাধ্যমে সরকার নতুন চাকরি ও পুঁজি তৈরির কথা ভাবছে । স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া-র প্রধান লক্ষ্য হল পণ্যের মান উন্নয়ন এবং নতুন পণ্য এবং পরিষেবার মাধ্যমে দেশে চাকরির হার বৃদ্ধি করা । স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া প্রকল্পের সুবিধা হল কাজের সরলীকরণ, আর্থিক সাহায্য, সরকারি টেন্ডার, এবং 2016 সালে সরকারি উদ্যোগে নেওয়া নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ সুবিধাগুলোকে ফের জাগিয়ে তোলা । বিমস্টেক-এর দেশগুলি হল বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মায়ানমার, ভুটান, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কা । ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ব্লক হিসাবে উঠে আসছে বিমস্টেক । এর অন্যতম কারণ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দুই সম্পূর্ণ আলাদা সংস্কৃতির মেলবন্ধন । এর আরও একটি কারণ হল আসিয়ান গোষ্ঠিভুক্ত দুই দেশ থাইল্যান্ড এবং মায়ানমারও এই গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত । পরস্পরের পরিপূরক একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাইছে বিমস্টেক । অন্যান্য এশিয়ান গোষ্ঠির থেকে বিমস্টেক-এর প্রধান পার্থক্য হল এর বহুস্তরীয় প্রয়াস । ভারতের ক্ষেত্রে বিমস্টেক-এর ভূমিকা অপরিসীম । এই নিরপেক্ষ মঞ্চ ভারতের প্রধান দুই বিদেশ নীতি— প্রতিবেশী প্রথম নীতি এবং পূর্বে তাকাও নীতিকে বাস্তবায়িত করতে বিশেষ সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে চিনা বিনিয়োগ (যেমন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)-কেও কড়া টক্কর দিতে ভারতকে সাহায্য করতে পারে বিমস্টেক-এর এই মঞ্চ। উপরন্তু এই মঞ্চ এটা দেখাতে পারে কী ভাবে আন্তর্জাতিক সব নিয়ম মেনে এই সব যোগাযোগের প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করা যায়। এর পাশাপাশি সার্ক (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন) গোষ্ঠির আর তেমন কাজ না থাকায় এর বিকল্প হয়ে উঠতেই পারে বিমস্টেক।

চলতি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘প্রারম্ভ’ সব দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। আম্তর্জাতিক সুবিধাগুলো পেতে এই সম্মেলন একেবারে সঠিক পদক্ষেপ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি এবং বিমস্টেক গোষ্ঠিভুক্ত অন্য দেশগুলির যাবতীয় সুযোগসুবিধা যেন ভারতের স্টার্ট আপ সংস্থাগুলি নিতে পারে সে দিক থেকে একেবারে সঠিক পথেই চলেছে এই সম্মেলন। 15 থেকে 59 বছর বয়সের মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রায় 62.5 শতাংশ জনসংখ্যা। এই শতাংশের হিসাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মনে করা হচ্ছে 2036 সালের মধ্যে এই পরিমাণ পৌঁছে যাবে 65 শতাংশের ঘরে। এই হিসাবই বলে দিচ্ছে আম জনতার বিপুল সুবিধা পেতে চলছে ভারত। এই ডিভিডেন্ট ভারত পেতে শুরু করেছে 2005-06 থেকে। এবং এই সুবিধা ভারত পাবে 2055-56 সাল পর্যন্ত । 2018-19 সালের আর্থিক সমীক্ষা অনুযায়ী জনসংখ্যার এই ডিভিডেন্ট ভারত সবচেয়ে বেশি পাবে 2041 সালে। সেই সময়ে কার্যক্ষম বয়স, অর্থাৎ 20 থেকে 59 বছরের মানুষের জনঘনত্ব হবে প্রায় 59 শতাংশ । বিশ্বে তরুণ জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের স্থান একেবারে উপরের দিকে। ভারতের পূর্ব এবং উত্তর পূর্বে রয়েছে বাংলাদেশ এবং মায়ানমার, যেখানে খুব কম অর্থে মানব শ্রম পাওয়া সম্ভব । অন্য দিকে তাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রে রয়েছে বিপুল বাজার । বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ হল স্বল্প মূল্যের মানব শ্রমিক । কৃষি ও শিল্পের উপর ভিত্তি করে সে দেশের শহরায়ন হয়ে চলেছে । সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি ফ্রিল্যান্স তথ্য প্রযুক্তি কর্মী নিয়োগ করে নজির গড়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ৬ লক্ষ তথ্য প্রযুক্তি কর্মী নিয়োগ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্রিল্যান্সিং দেশ হয়েছে তারা । এই অঞ্চলে এখন জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষ তরুণ। বিমস্টেকের দেশগুলিরও নির্ভরতা সূচক অনেকটাই কমেছে। ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (ইউএনইপিএ)-এর করা সমীক্ষা অনুযায়ী জনসংখ্যার এই পরিবর্তন দুর্দান্ত উন্নতির সুযোগ এনে দিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে রয়েছে কয়েকটি সামাজিক সূচক যেমন, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, সুস্বাস্থ্য এবং চাকরির ভাল সুযোগ। সে দিক থেকে চলতি সম্মেলন নতুন স্টার্ট আপ এবং নতুন উদ্যোগপতিদের কাছে এক মস্ত সুযোগ। সে সুযোগ আন্তর্জাতিক সমন্বয় সাদনের, সেই সুযোগ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধিরও। এর ফলে বিভিন্ন দেশ নিজেদের পারস্পরিক প্রয়োজনগুলি সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে এবং নিজেদের মানব সম্পদ বা অন্য সুযোগ সুবিধা ভাগ করে নিতে পারবে।

এ ছাড়াও, কোভিড পরবর্তী সময়ে বাণিজ্যপথ এবং সাপ্লাই রুটগুলিতে বহু পরিবর্তন এসেছে। বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্থা তাদের কারখানাগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চাইছে। তারা মাথায় রাখছে ভরসাযোগ্য বাণিজ্যপথের উপর। বিশ্ব যখন পণ্য উৎপাদন এবং পরিবহণের বিকল্প পথ খুঁজছে, তখন তা ভারতের সামনে এক নতুন দরজা খুলে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিনের থেকে বিশ্বের নজরও ভারতের দিকে ঘুরতেই পারে। চলতি আন্তর্জাতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে এই নতুন স্টার্ট আপগুলিকে নিজেদের তৈরি করা উচিত । ব্যবসা সূচকে এখন ভারত অনেকটাই উপরে উঠে এসেছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগও বেড়ে চলেছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে ভারত নিজেদের তৈরি করছে বিশ্বের চাহিদার মতো করে নিজেকে তৈরি করতে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের এই নতুন স্টার্ট আপগুলির চাহিদা বাড়তে বাধ্য।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রাস্তা এবং রেল লাইনই যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম, তা একেবারেই বলা যাবে না। আজকের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগেযোগের মাধ্যম হল ডিজিটাল মাধ্যম। আরও বেশি করে যোগাযোগ বাড়াতে আমাদের ডিজিটাল নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করে তুলতেই হবে। এর জন্য দেশের মানুষের জন্য সাধ্যের মধ্যে খরচে উচ্চ গতির ইন্টারনেট পরিষেবা এবং মোবাইল পরিষেবা অত্যন্ত জরুরি। আর এই ডিজিটাল প্রযুক্তি যত বিকশিত হচ্ছে, যত উন্নত হচ্ছে, ততই সামনে আসছে সাইবার নিরাপত্তা, তথ্যের নিরাপত্তা, ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির আদান প্রদান, মানব সম্পদের মতো বিষয়গুলির গুরুত্ব বিভিন্ন দেশে বেড়ে চলেছে। ‘প্রারম্ভ’ সে দিক থেকেও এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিজিটাল ভারতকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে এ এক অনন্য পদক্ষেপ ।

স্টার্ট আপ সংস্কৃতিতে ভারতের প্রাণবন্ততা ইতিমধ্যেই বিশ্বের দরবারে প্রমাণীত । এই সম্মেলনের মাধ্যমে স্টার্ট আপগুলি নিজেদের মধ্যে এবং বিমস্টেক গোষ্ঠিভুক্ত দেশগুলির মধ্যে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারবে। তরুণ হৃদয় এর ফলে আরও উজ্জীবিত হবে । স্টার্ট আপ কার্যকলাপের সঠিক অঞ্চল হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে এই সম্মেলন। ‘প্রারম্ভ’-এর এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন সে ক্ষেত্রে দেখাতে পারে নতুন দিশা, খুলে দিতে পারে নতুন দিগন্ত।