ETV Bharat / international

নিউ নর্মাল: অভিব্যক্তির প্রকাশ হোক অন্তরে - ইটিভি ভারত অপিনিয়ন

জুলাই মাসে জাপানের সেই থিম পার্কগুলি খুলেছে । এই পার্কগুলিকে COVID-১৯-র সংক্রমণ রুখতে ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল । সেইক্ষেত্রে নিউ নর্মাল কেমন হবে ? রোলার কোস্টারের পরবর্তী রাইডগুলি কেমন হবে; লিখছেন অতনু বিশ্বাস, কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক ।

roller coaster
ফাইল চিত্র
author img

By

Published : Aug 4, 2020, 6:11 PM IST

বিশ্ব যখন লকডাউন শিথিল করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ফের চালু করার চেষ্টা করছে, তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নিউ নর্মালে কোনওকিছুই আর আগের মতো থাকবে না । একদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে পরিবহন, স্কুল, ব্যবসা ও বিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে । অন্যদিকে সাধারণ মানুষকেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলতে হবে এবং সংবেদনশীল হতে হবে । এর একটা আদর্শ উদাহরণ হল, যখন জুলাই মাসে জাপানের সেই থিম পার্কগুলি খুলেছে । এই পার্কগুলিকে COVID-১৯-র সংক্রমণ রুখতে ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ।

জাপানের প্রধান থিমপার্ক অপারেটরদের গোষ্ঠী অতিথি এবং কর্মী, উভয়ের জন্যই একগুচ্ছ নতুন নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে । এর মধ্যে সামাজিক দূরত্ব, স্যানিটাইজ় করা, নিয়মিত শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা এবং মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে । ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট জাপান থিম পার্ক অ্যাসোসিয়েশন, এর মধ্যে জাপানের 30টির বেশি প্রধান বিনোদন পার্ক রয়েছে । তাদের জন্য নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে । নির্দেশিকায় জানানো হয়, "গ্রাহক পরিষেবার নতুন ধরন হিসেবে, এমনকী যখন আপনি মাস্কও পরে রয়েছেন, আপনি চোখের অভিব্যক্তির সাহায্যে দর্শকদের সঙ্গে আলাপাচারিতা চালাতে পারেন । গ্রাহক পরিষেবা ধাক্কা খেতে পারে কারণ, কথাবার্তা যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখা উচিত । তাই নিউ নর্মালে বেশি গুরুত্ব পাবে অঙ্গভঙ্গি, শব্দ উচ্চারণ পাবে কম । এমনকী ঘরের মধ্যে গান গাওয়াকেও রোগ ছড়ানোর পথ বলে মনে করা হতে পারে । আরেকটি অনুরোধ রয়েছে, যা রাখতে জাপানি থিম পার্কে আসা অতিথিরা বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন, সেটা হল ‘চিৎকার নয়’ । তার পাশাপাশি রোলার কোস্টারে চড়ার সময়ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে । নিশ্চিতভাবেই এর লক্ষ্য হল ড্রপলেটের মাধ্যমে কোরোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোখা । চিৎকার করার সময় প্রায় ১২০ কিমি/ঘণ্টা গতিতেও বেরিয়ে আসতে পারে ড্রপলেট ।

এটা অদ্ভূত শোনাতে পারে, যে রোলার কোস্টারে চেপেও কেউ চিৎকার করবে না, কারণ এই দুটো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত । এমনকী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু পরিচিত রোলার কোস্টারগুলি এই ধারণার ভিত্তিতেই চলে । যেমন ‘স্কাই স্ক্রিম’ হচ্ছে একটি ইস্পাতের রোলার কোস্টার, যা রয়েছে জার্মানির রাইনল্যান্ড-প্যালাটিনেটের হাসলকের হলিডে পার্কে । এছাড়াও ‘স্ক্রিম’ হচ্ছে আরও একটি স্টিল রোলার কোস্টার, যা রয়েছে অ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যালেন্সিয়ার সিক্স ফ্ল্যাগ ম্যাজিক মাউন্টেনে । নিশ্চিতভাবেই যখন এগুলি কয়েকশো ফুট নিচে নামে, তখন চিৎকার না করার বিধি মেনে চলাটা কঠিন । জাপানের ফুজি-কিউ হাইল্যান্ড থিম পার্ক একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছে, যেখানে পার্কের দুই আধিকারিককে সেখানকার ফুজিয়ামা রোলার কোস্টারে শান্তভাবে, চিৎকার না করে চড়তে দেখা যাচ্ছে । ভিডিয়ো শেষ হচ্ছে এই বার্তা দিয়ে: “দয়া করে মনে মনে চিৎকার করুন ।" এমনকী রোলার কোস্টারে চড়ার সময় গম্ভীর মুখভঙ্গি করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে সোশাল মিডিয়া ট্রেন্ডও শুরু হয়ে গেছে ।

আমি যতদূর জানি, বিশ্বের অন্যান্য থিম পার্কগুলি এখনও এই নিয়ম চালু করেনি । উদাহরণ স্বরূপ, ওর্ল্যান্ডোর ডিজ়নি ওয়ার্ল্ড পার্কও জুলাইতে ফের খুলেছে । কিন্তু চিৎকারে নিষেধাজ্ঞা সেখানে ঘোষণা হয়নি । বিনোদন ও আনন্দ করার জায়গায় এইধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সহজ নয় । কারণ ‘চিৎকার-নয়’ নিয়ম পালন না করা হলে, যদি শাস্তি বা জরিমানা হয়, তাহলে মানুষ এইধরণের জায়গায় আসতে চাইবেন না । চিত্তাকর্ষকভাবে, জাপানের থিম পার্কগুলিতে এই নিয়মভঙ্গকারীদের জন্য কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেই । তবুও মানুষ নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করছেন । আসলে, পুরোটাই শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতির বিষয় । সামাজিক ভদ্রতা নিয়ে জাপানের অবসেশন রয়েছে, সর্দি-কাশিতে আক্রান্তরা তাঁদের জীবাণু যাতে অন্যদের মধ্যে না ছড়ায়, তার জন্য মাস্ককে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে নিয়েছেন । দেশের মানুষ কয়েক দশক ধরে মাস্ক পরেন । শুধু নিজেকে বাঁচাতে নয়, অন্যদের বাঁচাতেও । এই গভীর সামাজিকতা বোধ মহামারির সময়ও বজায় থাকবে । এবং এটাও সম্ভব যে বিপজ্জনক রোলার কোস্টারে উঠেও চিৎকার না করার অভ্যেস দেশের মানুষ সফলভাবে অনুসরণ করবেন । পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য কিছু জায়গাতেও এটা সফল হতে পারে । তবে বিশ্বের বেশিরভাগে প্রান্তে এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করা নিশ্চিতভাবেই কঠিন । বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ও মনোবিদ ভিক্টর এমিল ফ্র্যাঙ্কল বলেছেন, "উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা পরিসর থাকে । সেখানেই রয়েছে আমাদের প্রতিক্রিয়া বেছে নেওয়ার ক্ষমতা । আমাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই আমাদের বৃদ্ধি ও স্বাধীনতা রয়েছে ।" নিশ্চিতভাবেই এটা সেই স্থানের পরীক্ষার সময় । এই মহামারীর সময় সেই দেশই বেশি সফল হবে, যেখানকার মানুষ স্বাধীনতার পথে এই স্থানটির ওপর নিয়ন্ত্রণ পাবে । একটা জিনিস যদিও পরিষ্কার, যে নিউ নর্মাল একদমই আলাদা হতে চলেছে । কারণ এটা আমাদের মনে মনে চিৎকারের সময় ।

অতনু বিশ্বাস

(সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা)

বিশ্ব যখন লকডাউন শিথিল করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ফের চালু করার চেষ্টা করছে, তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নিউ নর্মালে কোনওকিছুই আর আগের মতো থাকবে না । একদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে পরিবহন, স্কুল, ব্যবসা ও বিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে । অন্যদিকে সাধারণ মানুষকেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলতে হবে এবং সংবেদনশীল হতে হবে । এর একটা আদর্শ উদাহরণ হল, যখন জুলাই মাসে জাপানের সেই থিম পার্কগুলি খুলেছে । এই পার্কগুলিকে COVID-১৯-র সংক্রমণ রুখতে ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ।

জাপানের প্রধান থিমপার্ক অপারেটরদের গোষ্ঠী অতিথি এবং কর্মী, উভয়ের জন্যই একগুচ্ছ নতুন নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে । এর মধ্যে সামাজিক দূরত্ব, স্যানিটাইজ় করা, নিয়মিত শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা এবং মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে । ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট জাপান থিম পার্ক অ্যাসোসিয়েশন, এর মধ্যে জাপানের 30টির বেশি প্রধান বিনোদন পার্ক রয়েছে । তাদের জন্য নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে । নির্দেশিকায় জানানো হয়, "গ্রাহক পরিষেবার নতুন ধরন হিসেবে, এমনকী যখন আপনি মাস্কও পরে রয়েছেন, আপনি চোখের অভিব্যক্তির সাহায্যে দর্শকদের সঙ্গে আলাপাচারিতা চালাতে পারেন । গ্রাহক পরিষেবা ধাক্কা খেতে পারে কারণ, কথাবার্তা যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখা উচিত । তাই নিউ নর্মালে বেশি গুরুত্ব পাবে অঙ্গভঙ্গি, শব্দ উচ্চারণ পাবে কম । এমনকী ঘরের মধ্যে গান গাওয়াকেও রোগ ছড়ানোর পথ বলে মনে করা হতে পারে । আরেকটি অনুরোধ রয়েছে, যা রাখতে জাপানি থিম পার্কে আসা অতিথিরা বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন, সেটা হল ‘চিৎকার নয়’ । তার পাশাপাশি রোলার কোস্টারে চড়ার সময়ও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে । নিশ্চিতভাবেই এর লক্ষ্য হল ড্রপলেটের মাধ্যমে কোরোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোখা । চিৎকার করার সময় প্রায় ১২০ কিমি/ঘণ্টা গতিতেও বেরিয়ে আসতে পারে ড্রপলেট ।

এটা অদ্ভূত শোনাতে পারে, যে রোলার কোস্টারে চেপেও কেউ চিৎকার করবে না, কারণ এই দুটো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত । এমনকী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু পরিচিত রোলার কোস্টারগুলি এই ধারণার ভিত্তিতেই চলে । যেমন ‘স্কাই স্ক্রিম’ হচ্ছে একটি ইস্পাতের রোলার কোস্টার, যা রয়েছে জার্মানির রাইনল্যান্ড-প্যালাটিনেটের হাসলকের হলিডে পার্কে । এছাড়াও ‘স্ক্রিম’ হচ্ছে আরও একটি স্টিল রোলার কোস্টার, যা রয়েছে অ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যালেন্সিয়ার সিক্স ফ্ল্যাগ ম্যাজিক মাউন্টেনে । নিশ্চিতভাবেই যখন এগুলি কয়েকশো ফুট নিচে নামে, তখন চিৎকার না করার বিধি মেনে চলাটা কঠিন । জাপানের ফুজি-কিউ হাইল্যান্ড থিম পার্ক একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছে, যেখানে পার্কের দুই আধিকারিককে সেখানকার ফুজিয়ামা রোলার কোস্টারে শান্তভাবে, চিৎকার না করে চড়তে দেখা যাচ্ছে । ভিডিয়ো শেষ হচ্ছে এই বার্তা দিয়ে: “দয়া করে মনে মনে চিৎকার করুন ।" এমনকী রোলার কোস্টারে চড়ার সময় গম্ভীর মুখভঙ্গি করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে সোশাল মিডিয়া ট্রেন্ডও শুরু হয়ে গেছে ।

আমি যতদূর জানি, বিশ্বের অন্যান্য থিম পার্কগুলি এখনও এই নিয়ম চালু করেনি । উদাহরণ স্বরূপ, ওর্ল্যান্ডোর ডিজ়নি ওয়ার্ল্ড পার্কও জুলাইতে ফের খুলেছে । কিন্তু চিৎকারে নিষেধাজ্ঞা সেখানে ঘোষণা হয়নি । বিনোদন ও আনন্দ করার জায়গায় এইধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সহজ নয় । কারণ ‘চিৎকার-নয়’ নিয়ম পালন না করা হলে, যদি শাস্তি বা জরিমানা হয়, তাহলে মানুষ এইধরণের জায়গায় আসতে চাইবেন না । চিত্তাকর্ষকভাবে, জাপানের থিম পার্কগুলিতে এই নিয়মভঙ্গকারীদের জন্য কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেই । তবুও মানুষ নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করছেন । আসলে, পুরোটাই শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতির বিষয় । সামাজিক ভদ্রতা নিয়ে জাপানের অবসেশন রয়েছে, সর্দি-কাশিতে আক্রান্তরা তাঁদের জীবাণু যাতে অন্যদের মধ্যে না ছড়ায়, তার জন্য মাস্ককে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে নিয়েছেন । দেশের মানুষ কয়েক দশক ধরে মাস্ক পরেন । শুধু নিজেকে বাঁচাতে নয়, অন্যদের বাঁচাতেও । এই গভীর সামাজিকতা বোধ মহামারির সময়ও বজায় থাকবে । এবং এটাও সম্ভব যে বিপজ্জনক রোলার কোস্টারে উঠেও চিৎকার না করার অভ্যেস দেশের মানুষ সফলভাবে অনুসরণ করবেন । পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য কিছু জায়গাতেও এটা সফল হতে পারে । তবে বিশ্বের বেশিরভাগে প্রান্তে এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করা নিশ্চিতভাবেই কঠিন । বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ও মনোবিদ ভিক্টর এমিল ফ্র্যাঙ্কল বলেছেন, "উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা পরিসর থাকে । সেখানেই রয়েছে আমাদের প্রতিক্রিয়া বেছে নেওয়ার ক্ষমতা । আমাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই আমাদের বৃদ্ধি ও স্বাধীনতা রয়েছে ।" নিশ্চিতভাবেই এটা সেই স্থানের পরীক্ষার সময় । এই মহামারীর সময় সেই দেশই বেশি সফল হবে, যেখানকার মানুষ স্বাধীনতার পথে এই স্থানটির ওপর নিয়ন্ত্রণ পাবে । একটা জিনিস যদিও পরিষ্কার, যে নিউ নর্মাল একদমই আলাদা হতে চলেছে । কারণ এটা আমাদের মনে মনে চিৎকারের সময় ।

অতনু বিশ্বাস

(সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা)

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.