গোটা বিশ্বের সমস্ত দেশ যেখানে করোনার বিরুদ্ধে নিজ নিজ লড়াই চালাচ্ছে, সেখানেই মায়ানমারের সেনা ফিরে গিয়েছে নিজেদের পুরানো অভ্যেস পালনে । আর তা হল দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের উপর আক্রমণ চালানো । ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি, যারা গত নভেম্বরে হওয়া পার্লামেন্টারি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের আক্ষরিক অর্থেই রাজনৈতিক বন্দিতে পরিণত করা হচ্ছে । সেনা দেশের প্রেসিডেন্ট, উইন মিন্ট, স্টেট কাউন্সিলর আং সান সু কি— সহ দেশের সমস্ত বড় বড় নেতাদের কারাবন্দি করছে । প্রতিবাদী সমস্ত কণ্ঠকে লোহার মুষ্ঠি দাবিয়ে রাখছে । আনুমানিক 180 জন, যারা সেনার কার্যকলাপের প্রতিবাদ করেছে, তাদের দেড় মাসের মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে । দেশবাসীকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল যে যদি সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (ইউএসডিপি) 2015 সালের ভোটে হেরে যায়, তাহলে দেশে রক্তের বন্যা বইবে । কিন্তু মানুষ সেই সতর্কবার্তায় কান দেয়নি এবং সেই সময় ঝুলি ভরে ভোট দিয়েছিল আং সান সু কি’র দলকে । সাম্প্রতিক নির্বাচনে সু কি’র দল 2015 সালের ভোটের তুলনায় আরও বেশি ব্যবধানে জনসমর্থন পেয়ে জিতেছে । আর তার পর জরুরি যে যে সাংবিধানিক সংস্কার সু কি করেছিলেন, তার জেরে বার্মার সেনা জেনারেল মিং আং লেয়াং, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে ।
লেয়াং-এর ভয়, তিনি যে রোহিঙ্গা-বিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার জেরে 65 বছর বয়সে নিজের পদ থেকে অবসরের পর তাঁকে আন্তর্জাতিক তদন্তের মুখে পড়তে হতে পারে । আর আগামী জুলাই মাসেই তাঁর 65 হবে । তাঁর বিদ্রোহ গোটা মায়ানমারের ভাগ্যই বদলে দিয়েছে । সেনা অভু্যত্থানের জেরে মায়ানমারের রাস্তা প্রতিবাদীদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে । সেনা জেনারেলের এই অন্ধবিশ্বাস যে তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে পারলে যে কোনও ধরণের তদন্ত থেকে বাঁচতে পারবেন, মায়ানমারের গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ ঘটিয়েছে । সে দেশে বর্তমানে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বলতে এমন একটি ব্যাঙের মতো, যে সাপের ফণার ছায়ায় আশ্রিত ।
মায়ানমার (যার পূর্ব নাম বার্মা), ব্রিটিশদের শিকল থেকে মুক্ত হয়েছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর । কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি দশকের পর দশক ধরে সেনার শাসনেই ছিল সেই 1962 সাল পর্যন্ত । 1990 সালে সেনা জুন্টার তরফে আয়োজিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতেছিল এনএলডি । যদিও তৎকালীন সময়ে সেনাবাহিনী এই যুক্তিতে হস্তক্ষেপে বিরত থেকেছিল যে সংবিধান ছাড়া কখনও ক্ষমতার হস্তান্তর হয় না । জুন্টা সেই সময় গণতন্ত্রের সমস্ত সমর্থককে জেলে পুরে দিয়েছিল । সাম্প্রতিক সেনা অভু্যত্থানের ফলে তিন দশক আগে সেখানে যা ঘটেছিল, তার পুনরাবৃত্তিও ঘটেছে ।
আরও পড়ুন : চিনকে প্রতিহত করতে কোয়াড
মায়ানমারের সেনা দখলদাররা দেশের উপর একবছর-ব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছে । তারা সুকিকে এই অভিযোগে বন্দি করেছে যে তার কাছে না কি লাইসেন্সবিহীন ওয়াকি-টকি ছিল । তার বিরুদ্ধে আনা অপর অভিযোগ হল করোনা বিধি লঙ্ঘন করা । তারা সুকির বিরুদ্ধে ঘেরাটোপ আরও কঠোর করছে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে । আমেরিকা, ব্রিটেন এবং কানাডা মায়ানমারের সেনা নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে । দক্ষিণ কোরিয়া মায়ানমারকে অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে । ইন্দোনেশিয়া আবার এই সংকট মেটাতে কূটনৈতিক পথে হাঁটার চেষ্টা করছে । অথচ চিনের অবস্থান এই নিয়ে উদ্বেগের । সম্প্রতি চিন তাদের প্রতিরক্ষা আইনে সংস্কার করেছে, যা পিপলস লিবারেশন আর্মিকে নিজেদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে অন্য দেশে প্রবেশ করতে পারে । চিনের এই পদক্ষেপের উপর কড়া নজর রাখা উচিত । ভারত সরকারের উচিত, মায়ানমারে যে টানাপোড়েন চলছে, তার প্রেক্ষিতে দেশের উত্তর-পূর্বাংশে কোনও ধরনের অনুপ্রবেশ যাতে না ঘটে, সেদিকে বাজপাখির দৃষ্টি রাখতে । রাষ্ট্রসংঘের উচিত মায়ানমারের নাগরিকদের উন্নয়নশীল আশা-আকাঙ্খা নিরাপদ রাখতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসা । আন্তর্জাতিক সমর্থনের উপর ভিত্তি করে যদি দেশে সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় মায়ানমার, শুধুমাত্র তার পরই এই দেশ দশকের পর দশক ধরে চলা নিঃসঙ্গতা এবং অসহনীয় দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়ে, বিজয়ী হতে পারবে ।