কলকাতা, 24 জুলাই: বর্তমান সময়ে একাধিক চরিত্রে সম্ভবনাময় অভিনেতা হিসাবে উঠে আসছেন সুহোত্র মুখোপাধ্যায় । কখনও তিনি ডাকঘর-এর সরল সাধাসিধে পোস্টমাস্টার দামোদার দাস । কখনও আবার তিনি একেনবাবুর সহকারী কিংবা গোরার সারথী । এক চরিত্র থেকে অন্য একটি চরিত্রে নিজেকে বদলাতে ঠিক কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয় তাঁকে? গোরার তিনিও সহকারী আবার একেনবাবুরও কীভাবে তিনি আলাদা করেন দুই চরিত্রকে? এসব নিয়েই এবার আড্ডা দিলেন সুহোত্র ।
প্রশ্ন: একেনবাবুর তুমি সহকারী আবার গোরার ক্ষেত্রেও তুমি ক্রাইসিস ম্যানেজার ৷ কীভাবে আলাদা কর দু'টি চরিত্রকে?
উত্তর: চরিত্রের ভিতটা দেখতে গেলে আপাতদৃষ্টিতে দু'টি চরিত্র পরিস্থিতি সালমায় । কিন্তু বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে চরিত্রগুলোর কাজ কিন্ত একেবারে অন্যরকম । যদি 'গোরা'র ক্ষেত্রে চরিত্র দেখ, এখানে সারথী কিন্তু রয়েছে তাঁকে মনে করিয়ে দিতে । কারণ গোরা চরিত্রটি এমন একজন মানুষ যে সবকিছু ভুলে যায় । সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সারথী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় ।
অন্যদিকে একেনবাবু কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমান গোয়েন্দা । সে ওরকম একটা ছদ্মবেশ ধরে থাকে । কারণ সে মারামারি করতে জানে, বন্দুক চালায়, পুলিশের সঙ্গে বহুকাল যুক্ত । তাই এখানে একেনের সঙ্গে বাপি-প্রমথ যে থাকে সেটা নিছক বন্ধুত্ব । অন্যদিকে গোরার নির্ভরতাটা সারথীর ওপর একটু বেশি । একেনবাবু হয়তো আমাদের ছাড়াও একটা কেস সলভ করতে পারবে । গোরা হয়তো পারবে না । আমি যেভাবে চরিত্রটাকে দেখি এটা আমার ধারণা । যদিও যাঁরা লিখছেন তাঁরা এমনকিছু ভেবে লিখছেন কি না জানা নেই । সেই জায়গা থেকে দু'টি চরিত্র করতেই আমার ভীষণ মজা লাগে ।
প্রশ্ন: দু'টি চরিত্রের ভিত্তি এক হলে টাইপ ক্যারেকটার হওয়ার ঝুঁকিও তো থাকে?
উত্তর: রিস্ক তো থেকেই যায় । সেটাকেই আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলাম । আমি প্রথমে 'গোরা'য় কাজ করেছি তারপর একেনবাবুর সঙ্গে কাজ করেছি । আমি জানতাম পরেও আমাকে এই চরিত্রগুলো করে যেতে হবে । আমি নিজেই এই চ্যালেঞ্জটা নিতে উৎসুক ছিলাম । আর কোথাও গিয়ে হয়তো দু'টো চরিত্রকে আলাদা করতে পেরেছি । তাই আলাদা করে দু'টো চরিত্রই মানুষের ভালো লাগছে ।
প্রশ্ন: কোন চরিত্রটা তোমার ওপর বেশি প্রভাব রেখে যায় যদি একটু বল...
উত্তর: দেখ দু'টি চরিত্রের ক্ষেত্রেই, খুব মননিবেশ করে, কী করব পরপর সাজিয়ে যে কাজ করি তা নয় । চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমি আলাদা আলাদা ব্র্যাকেট তৈরি করি । এই চরিত্রটি কী করতে পারে কী করতে পারে না । সেটা দু'জনের ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা । সেই অনুযায়ী আমি কাজটা করার চেষ্টা করি ।
প্রশ্ন: বারবার একটা প্রশ্ন উঠছে ওটিটি আসার পর গোয়েন্দাদের সংখ্যা নাকি বেড়ে গিয়েছে । আজকাল তো প্রচুর গোয়েন্দা । সেক্ষেত্রে তুমি দু'জন আলাদা আলাদা গোয়েন্দার সঙ্গে কাজ কর । কোথাও কি একঘেয়ে লাগে না কি প্রতিটা চরিত্রই তোমায় তোমায় সমান আনন্দ দেয়?
উত্তর: চরিত্রটা যখন করছি অভিনেতা হিসাবে আনন্দ তো আমায় পেতেই হবে । সেটাই আমার দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে দু'টো চরিত্র করেই আমি ভীষণ মজা পাই । কিন্তু চ্যালেঞ্জ হিসাবে বলতে গেলে সারথীর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কিছুটা বেশি ।
প্রশ্ন: 'ডাকঘর' সিরিজেও তুমি একইরকম জনপ্রিয় । ট্রেলার আসার পর অনেকেই 'পঞ্চায়েত' সিরিজের সঙ্গে এর তুলনা করছিলেন । তুমি যখন চরিত্রটার জন্য রাজি হয়েছিলে তখন অভিষেক ত্রিপাঠীর কথা কি কখনও মাথায় এসেছিল কি?
উত্তর: প্রথমত, 'পঞ্চায়েত'-এর সঙ্গে তুলনা করে আমরা কাজটাই শুরু করিনি । পদ্মনাভ দাশগুপ্ত মানে পদ্মদা পুরো গল্পটা কোভিডের সময় বসে লেখেন । দেখতে গেলে 'পঞ্চায়েত' সিরিজের বছরখানেক আগে এই গল্পটা লেখা । তারপর 'পঞ্চায়েত' সিরিজ মুক্তি পায় এবং বিপুল জনপ্রিয় হয় । ফলে মানুষ কোথাও একটা সাযুজ্য খুঁজে পায় এবং এই প্রসঙ্গটা আসে ।
যেহেতু এই গল্পটাও গ্রামের । আর শহর থেকে একটা চরিত্র আসছে যে রয়েছে গল্পের কেন্দ্রে । কিন্তু এই বিষয়গুলো বাদ দিলে আর কিন্তু কোনও মিল নেই । সেই ক্ষেত্রে শুধু এটুকুর ওপর বিচার করে সাযুজ্য টানা ভুল হবে । কারণ আটের দশকে একটা ধারাবাহিক হতো যেখানে শাহরুখ খান অভিনয় করতেন । নাম সম্ভবত 'উমিদ' । সেখানেও শহর থেকে একটি ছেলে গ্রামে ব্যাঙ্কে চাকরি করতে আসে । সেই চরিত্রে অভিনয় করেন শাহরুখ । তাই এভাবে তুলনা টানা ভুল হবে । 'ডাকঘর'-এর গল্পই তাই আমায় বলে দিয়েছে চরিত্রটাকে কীভাবে আলাদা করতে হবে । আর এটা সুন্দর একটা গল্প । যে আমি প্রথম থেকেই এই কাজটার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিলাম ।
প্রশ্ন: মিঠুন চক্রবর্তী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো অভিনেতারা অনেকসময় বলেছেন তাঁরা অনেক বাস্তবজীবনে দেখা চরিত্রকে হুবহু পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন । তোমার ক্ষেত্রে এমন কোনও গল্প আছে কি?
উত্তর: না, কোনও বিশেষ চরিত্র যদি বল তাহলে তাকে ফুটিয়ে তুলেছি এমন হয়নি । তবে হ্যাঁ, একজন অভিনেতাকে তো চোখ কান খোলা রাখতে হয় । তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে কোনও মানুষের কোনও চারিত্রিক বৈশিষ্ট নিশ্চই তুলে ধরেছি ।
প্রশ্ন: ঋত্বিকদার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল যদি একটু বল ?
উত্তর: খুবই সুন্দর । তিনটি কাজ আমরা একসঙ্গে করে ফেললাম । এখন আমাদের খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । আমি সৌভাগ্যবান যে আমার ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে । এত তাড়াতাড়ি হবে আমি সত্যিই ভাবিনি ।
আরও পড়ুন: 'চরিত্রই ঠিক করে দেয় প্রস্তুতি কেমন হবে', অভিনয় জীবন নিয়ে অকপট ঋত্বিক
প্রশ্ন: 'গোরা'র প্রথমদিন কী এই ফ্যানবয় বিষয়টা কাজ করেছিল ?
উত্তর: ওরে বাবা! দারুণভাবে । 'গোরা'-র জন্য প্রথম যেদিন অভিনয় করতে গেলাম তার আগের দিন ঠিক করে ঘুমোতে পারিনি । শেষমেষ অবশ্য় খুব ভালো হয় প্রথম শুট ।
প্রশ্ন: কোন অভিনেতার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে খুব কঠিন? ইনি একেবারে আনপ্রেডিক্টেবেল ।
উত্তর: আমার ঋত্বিকদার সঙ্গেই এই বিষয়টা হয়েছে । 'গোরা'র প্রথম মরশুমে যেটা নিয়ে বলছিলাম । আগের রাতে আমি সিন মুখস্ত করে গিয়েছিলাম । ভেবে গিয়েছিলাম এটা এভাবে করব, সেটা সেভাবে করব । যাতে আমার জন্য কোনও ভুল না হয় । গিয়ে যেই প্রথম দৃশ্যের শুট হল আমি বুঝে গেলাম এটা করে কোনও লাভ নেই । কারণ উনি এমনই একজন আনপ্রেডিক্টেবল এবং শক্তিশালী অভিনেতা ওনার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিতে হয় শুধু । স্রেফ মুখস্ত বলে গেলে অনেককিছু মিস করে যেতে হয় । উনি একজন দারুণ সহ-অভিনেতা ।
আরও পড়ুন: 'অন্তর্জলী যাত্রা' থেকে 'আবার অরণ্যে', জন্মদিনে ফিরে দেখা বাঙালির 'মনের মানুষ' গৌতম ঘোষকে
প্রশ্ন: আগামিদিনে কোন অভিনেতার কাজ করার ইচ্ছে আছে?
উত্তর: সে তো অনেকেই রয়েছেন । তবে আমি অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব ভক্ত । তাই তাঁর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে তো আছেই । 'চতুষ্কোণ' ছবিতে মাত্র কয়েক মিনিটের অভিনয় । কিন্তু যাকে বলে হি স্টিল দ্য শো ।
প্রশ্ন: পেশাদার অভিনেতা হিসাবে সবসময় তো পছন্দের চরিত্রটা নাও পেতে পার । সেক্ষেত্রে কাজটা কর কীভাবে ?
উত্তর: দেখ অভিনেতা হিসাবে আমার মনে হয় সেটাই তোমার দায়িত্ব । অপছন্দ হলেও তোমার কাজটা তোমায় সবটা দিয়েই করতে হবে । তবে অসুবিধা তো হয় । সকলে বলে না দর্শককে বিশ্বাস করানোর আগে নিজেকে বিশ্বাস করাতে হয় । সেক্ষেত্রে বিশ্বাস করাতে একটু বেগ পেতে হয় । তবে পছন্দ অপছন্দের রং লাগানো উচিত নয় । কারণ তাতে চরিত্রের সঙ্গে সুবিচার করা হয় না ।