মালদা, 28 সেপ্টেম্বর : আশঙ্কাই সত্যি হল ৷ গত কয়েকদিন ধরে পাহাড় সহ উত্তরবঙ্গে একটানা বৃষ্টির জল নদীর ঢাল বেয়ে নেমে এসেছিল দুই দিনাজপুরের নদীগুলিতে ৷ কয়েকদিন ধরেই ফুঁসছে দুই দিনাজপুরের মহানন্দা, শ্রীমতী, নাগর, সুই, পুনর্ভবা, টাঙন সহ একাধিক নদী ৷ এসব নদীর জলে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ৷ জলস্তর ক্রমাগত বাড়ছে মহানন্দারও ৷ কিন্তু এই জেলায় মহানন্দার থেকে চিন্তা বেশি বাড়িয়েছিল পুনর্ভবা ও টাঙন ৷ মালদা জেলা দিয়েও ওই দুই নদী প্রবাহিত হয়েছে ৷ আপার ক্যাচমেন্টের জল যে প্রবল গতিতে নেমে আসবে, তা নিয়ে নিশ্চিত ছিল দুই নদীপাড়ের মানুষ ৷ অবশেষে এই জেলায় প্রথম কোপ বসাল পুনর্ভবা ৷ গতকাল রাত থেকেই অল্প অল্প করে কাটছিল বামনগোলা ব্লক দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদীর বাঁধ৷ আজ সকালের মধ্যে জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে বাঁধের প্রায় 60 মিটার অংশ ৷ দুপুর গড়াতে কাটা বাঁধের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় 100 মিটার ৷ জলের নীচে চলে গিয়েছে কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমির আমন ধান ৷ জল ঢুকেছে কিছু বাড়িতেও ৷ যদিও এখনও পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব নেই ব্লক প্রশাসনের কাছে ৷ এদিকে সেচ বিভাগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই এলাকায় কোনও নদীবাঁধই নেই ৷ মানুষের চলাচলের রাস্তাকেই অনেকে বাঁধ ভেবে ভুল করছে ৷ যদিও পরিস্থিতির উপর নজর রেখে চলেছে সেচ বিভাগ ও ব্লক প্রশাসন ৷
দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে বামনগোলা ব্লক দিয়ে মালদা জেলায় ঢুকেছে পুনর্ভবা ৷ কয়েক কিলোমিটার দূরেই নদী বাংলাদেশে ঢুকে সেখানকার নবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুরে মহানন্দায় মিশেছে ৷ এই জেলার অন্যতম শুখা ব্লক হিসাবে পরিচিত বামনগোলা ৷ চাষের ক্ষেত্রে এলাকার কৃষকরা এই নদীর উপরেই মূলত ভরসা করেন ৷ বিশেষত আমন মরশুমে এই নদীর উপর নির্ভর করে ব্লকের বেশিরভাগ চাষ হয়ে থাকে ৷ এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি ৷ এবারের আগাম বর্ষায় প্রথম থেকেই নদীতে ভালো জল ছিল ৷ কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে উত্তরবঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাত চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল চাষিদের ৷ উপরের জল প্রবল গতিতে নীচে নেমে আসলে কী হতে পারে, ভেবেই আকুল ছিল সবাই ৷ সেই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত করেই গতকাল বামনগোলা ব্লকের মদনাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতের বাঁশিপাড়ায় নদীর পশ্চিমপাড়ের বাঁধে ফাটল দেখা দেয় ৷ আজ সকালের মধ্যে সেই ফাটল প্রায় 60 মিটার হয়ে যায় ৷ এই মুহূর্তে নদীর জল প্রচণ্ড গতিতে ঢুকছে কৃষিজমিতে ৷ বামনগোলার সঙ্গে যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ভোলাসামনা, গাড়াপাড়া, বাঁশিপাড়া, কুপাদহ সহ 5-7 টি গ্রামের ৷ কয়েক হাজার বিঘা জমির চাষ এখন জলের তলায় ৷ কিছু বাড়িও জলবন্দী হয়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে ৷ নদীর জল ঘুরপথে এই গ্রামগুলিকেও জলবন্দী করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসীরা ৷
আরও পড়ুন : ভারী বৃষ্টির জেরে ওড়িশায় বন্যা পরিস্থিতি, মৃত 9
এলাকার বাসিন্দা গুলজার হোসেন বলেন, “গতকাল রাতেই পুনর্ভবার এই বাঁধ ভেঙেছে ৷ এই বাঁধে ইঁদুরের গর্ত ছিল ৷ সেকারণেই জলের তোড়ে বাঁধ ভেঙে যায় ৷ প্রথমে যন্ত্র দিয়ে মাটি ফেলে বাঁধ রক্ষা করার চেষ্টা চলছিল৷ কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি৷ নদীর জলে অনেক কৃষিজমির ক্ষতি হয়েছে৷ জল ঢুকছে দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর, শুকদেবপুর, ভোলামাসনা সহ কয়েকটি গ্রামে৷ কিছু বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে৷ এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের কেউ পরিস্থিতি দেখতে আসেননি৷”
অন্য এক বাসিন্দা মহম্মদ হেপাজুদ্দিন বলেন, “গতরাতে প্রথমে ইঁদুরের গর্ত দিয়ে বাঁধ চুঁইয়ে জল ঢুকছিল৷ যন্ত্র দিয়ে মাটি ফেলে সেই গর্ত বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল৷ কিন্তু সামাল দেওয়া যায়নি৷ প্রথমে বাঁধের প্রায় দুই হাত এলাকা দিয়ে জল ঢুকছিল৷ রাতের মধ্যে বাঁধের প্রায় 60 মিটার ভেঙে গেছে ৷ এখনও বাঁধ কাটছে ৷ আরও 10-15 মিটার কাটবে বলে মনে হচ্ছে ৷ কারণ, বাঁধে ফাটল ধরেছে ৷ নদীর জলে 5-7 টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ কিছু বাড়িতে জল ঢুকেছে ৷ কয়েক হাজার জমির আমনচাষ নষ্ট হয়ে গেছে ৷ এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের কাউকে এলাকায় দেখা যায়নি ৷
যদিও এই ঘটনা নিয়ে এখনও ব্লক প্রশাসনের কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই ৷ BDO সঞ্জিত মণ্ডল জানান, “গোটা ঘটনা সেচ বিভাগকে জানানো হয়েছে ৷ আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রেখে চলেছি ৷ এখনও পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যায়নি ৷ এনিয়ে ব্লক কৃষি বিভাগকে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে ৷ সেই রিপোর্ট পাওয়ার পরেই এনিয়ে সঠিকভাবে কিছু বলা সম্ভব হবে ৷ তবে এখনও পর্যন্ত কোনও বাড়ি জলবন্দী হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর নেই ৷”
আরও পড়ুন : গুমানি নদীর হড়কা বানে প্লাবিত ফরাক্কা
জেলা সেচ বিবাগের এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র প্রণবকুমার সামন্ত বলেন, “ঘটনার খবর পেয়েছি ৷ ওই এলাকায় পুনর্ভবায় সেচ দপ্তরের কোনও বাঁধই নেই ৷ গ্রামের মানুষের যাতায়াতের জন্য নদীর ধারে রাস্তা রয়েছে ৷ সেই রাস্তা নদী থেকে কিছুটা উঁচু হওয়ায় সবাই সেটাকে বাঁধ ভেবে ভুল করে ৷ এই মুহূর্তে আপার ক্যাচমেন্টের জল প্রবল গতিতে পুনর্ভবায় নেমে আসছে ৷ ফলে নদীর জলস্তর ক্রমাগত বাড়ছে ৷ সেই জলেই ওই রাস্তা কেটে গেছে ৷ তবে আমরা সেদিকে নজর রাখছি ৷ এখন যে গতিতে জল ঢুকছে, তাতে সেখানে কোনও কাজ করা সম্ভব নয় ৷ নদীর জলস্তর কমলে আমরা ওই এলাকায় কাজ শুরু করব ৷ বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে BDO ও জেলাশাসকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ৷”