কলকাতা, 5 সেপ্টেম্বর : 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে সকলকে চমকে দিয়ে উত্তরবঙ্গে উত্থান ঘটেছিল বিজেপির । সে সময় উত্তরবঙ্গের সিংহভাগ আসনেই চালকের আসনে ছিল গেরুয়া শিবির । 2021-এর বিধানসভা নির্বাচন উত্তরবঙ্গের 8 জেলার 54টি আসনে সেই চিত্রকে অনেকটাই বদলে দেয় । লোকসভার চমক না থাকলেও 29টি আসন ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল দিলীপ ঘোষের দল । কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সময় যত এগোচ্ছে বিজেপির শক্তি অথবা সেই কামড় ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করছে । সবচেয়ে বড় কথা একুশের নির্বাচনে বিজেপি সরকার গঠন করতে না পারায় পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্রই যেন বাজছে একটা ঘরে ফেরার সুর । তথ্য বলছে, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের ডাকা গেরুয়া বিধায়কদের সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিলেন বিজেপির 5 বিধায়ক । দলীয় বৈঠকে এই পাঁচ বিজেপি বিধায়কের গরহাজিরা ঘিরে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে । তবে কি এঁরাও বেসুরো ?
শনিবার এই জল্পনার মধ্যেই পদ্ম শিবির ছেড়ে ঘাসফুল শিবিরে যোগ দিয়েছেন উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের বিজেপি বিধায়ক সৌমেন রায় । 3 দিন আগে বিধায়কদের সম্মেলনে যোগ দিলেও গতকাল তিনি শিবির বদল করেন । আর এর থেকেই প্রশ্ন উঠছে তাহলে আগামী দিনে উত্তরবঙ্গ থেকে আর কতজন বিধায়ক শাসক শিবিরে নাম লেখাতে পারেন । সবচেয়ে বড় কথা, গত কয়েক বছরে উত্তরবঙ্গকে বিজেপির গড় হিসাবে দেখানো হলেও বাস্তবে সেখানে বিজেপির শক্তি কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে । এই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের প্রাক্তন বিধায়ক তথা কোচবিহার তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারম্যান উদয়ন গুহ । তিনি বলেন, "খাতায়-কলমে উনিশ সাল থেকে উত্তরবঙ্গে বিজেপির উত্থানের চিত্র দেখেছেন রাজ্যবাসী ৷ তবে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই ।" তাঁর মতে, "নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের মানুষকে বাহারি স্বপ্ন দেখিয়ে মিথ্যে প্রচার করে কিছু আসন জিতলেও যত সময় যাচ্ছে মানুষ ওদের মিথ্যাচার বুঝতে পারছে । তাই মানুষ ক্রমেই ওদের পাশ থেকে সরে যাচ্ছে । প্রবীণ এই তৃণমূল নেতা মনে করেন উত্তরবঙ্গের বিজেপির হাওয়া আসলে তাৎক্ষণিক ।"
তাঁর বক্তব্য, "2019 সালে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে একটা হাওয়া তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল । বিশেষ করে যাঁরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের নানাভাবে প্ররোচিত করা হয়েছিল সে সময় ৷ মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বা ওদের কথায় ভুল বুঝে বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন । পরবর্তীতে মানুষ তাঁদের ভুলটা বুঝতে পারছেন । তাঁরা মনে করছেন ধর্মীয় ভাবাবেগে এভাবে বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটা ঠিক হবে না । এখন আবার আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্যের কথা বলে ওরা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহের আবহ তৈরি করেছে । এতে মানুষ ওদের উপর ক্ষুব্ধ । ফলে অতীতে কিছু মানুষের আস্থা ও ভরসা বিজেপির উপর হয়েছিল, তাঁরাও এখন আস্তে আস্তে সরে আসছেন ।"
এদিনের দলত্যাগকেও সাধারণ মানুষের বিশ্বাসভঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেই আখ্যা দিয়েছেন উদয়ন । তিনি বলেন, "সাধারণ মানুষের পালস দেখেই তো নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।" এদিন বিজেপির ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে উদয়ন তৃণমূলের কিছু সাংগঠনিক সমস্যার কথা বলেন । যদিও সে সমস্যাগুলো কী তা তিনি খোলাসা করেননি । তবে তাঁর মত, "যদি এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়, তাহলে আগামী দিনে আবার উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে পুরনো চেহারায় দেখা যেতে পারে ।"
আরও পড়ুন : Tanmay Ghosh: গেরুয়া শিবিরে বড় ভাঙন, তৃণমূলে যোগ দিলেন বিষ্ণুপুরের বিজেপি বিধায়ক
যদিও এক সময় উদয়নবাবুর সতীর্থ এবং বর্তমানে বিজেপি বিধায়ক মিহির গোস্বামী তৃণমূল কংগ্রেসের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন । তিনি বলেন, "বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বকে না ভাবলেও চলবে । উত্তর বাংলার মানুষ বিজেপিকে মন দিয়ে ভালবাসে বলেই এখানকার বেশিরভাগ আসনেই বিজেপি জিতেছে । সুতরাং, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই, দুই-একজন স্বার্থান্বেষী মানুষ, নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে যদি তাঁদের পথ পরিবর্তন করেন তাতে বিজেপির খুব একটা ক্ষতি হবে। উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে বিজেপির যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে । আমরা তাঁদের পাশে আছি । কাজেই এসব নিয়ে ভাববার সময় নেই ।"
দলবদলের উপর কি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের শক্তিবৃদ্ধি ?
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দলবদলের এই প্রবণতাকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন না । বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র এই প্রবণতা সম্পর্কে বলেছেন, "নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতা-নেত্রীদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি তৈরি হয়েছিল নেতাদের উচ্চাশা থেকেই । সেই উচ্চাশা অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়নি । অসম বা অন্য রাজ্যে দলবদলের সুফল বিজেপি পেলেও এরাজ্যে তা সফল হয়নি । উচ্চাশা পূরণ না হওয়ার কারণেই অনেকে আবার পুরানো দলে ফেরত আসছেন ।" শুভাশিসবাবুর কথায়, "এই নেতারা আর অপেক্ষা করতে রাজি নন ৷ কারণ আবার কবে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে, আদৌ আসবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে । সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা ফেরত আসছেন ।" ফলে দুই বঙ্গেই বিজেপির বর্তমান অবস্থা আগামী দিনে অনেকটাই পরিবর্তন হবে বলেই মত তাঁর ।
আরও পড়ুন : BJP North Bengal Meeting : কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ডাকা বৈঠকে অনুপস্থিত বিজেপির 5 বিধায়ক
অপর রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের মতে, মতাদর্শের অভাবই এরাজ্যে দলবদলের প্রধান কারণ । শাসকদলের সঙ্গে থাকলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় বলেই মনে করছেন তিনি । আর সে কারণেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতা-নেত্রী বিধায়কেরা শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন । মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়াই এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের দস্তুর হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন তিনি ।
আরও পড়ুন : TMC Joining : বহিষ্কারের 24 ঘণ্টার মধ্যে তৃণমূলে যোগ বনগাঁ বিজেপির মহিলা মোর্চার সভানেত্রীর
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতিতেও হিন্দি বলয়ের ছোঁয়া লেগেছে । দলবদলের প্রবণতা তথা আয়ারাম গয়ারামদের ধারাটা মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছে । এরাজ্যে দলবদলের প্রবণতা বিষয়টি এসেছে তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরে । যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার জন্য দলবদল করেনি । বরং তারা ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক দলবদল করিয়েছে । তবে বিজেপি ক্ষমতায় আসার জন্য দলবদলকে অন্যতম প্রধান অস্ত্র করতে চেয়েছিল । অন্য রাজ্যে তা সফল হলেও এরাজ্যে হয়নি ।
আরও পড়ুন : Biswajit Das : তৃণমূলে ফিরলেন বাগদার বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু দল বদলের উপর দাঁড়িয়েই এই রাজ্যে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি, কাজেই বিজেপির শক্তি কোনটা আর দুর্বলতা কোনটা তা এভাবে হয়তো বিচার করা সম্ভব নয় । আর এই শক্তিকে স্থায়ী হিসাবে বিবেচনা করাও হয়তো ঠিক নয় ।
আরও পড়ুন : Suvendu Adhikari : বাঁকুড়ায় বিধায়কদের তৃণমূলে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে পুলিশ, অভিযোগ শুভেন্দুর