কলকাতা, 24 মার্চ : শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘঠিত যৌন অপরাধ প্রতিরোধ আইন বা পকসো কতদূর কার্যকর হয়েছে ? সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, দেশে কি আদৌ বিশেষ আদালত গড়ে উঠেছে ? আদালত সূত্র থেকে যে তথ্য উঠে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, 2018 সালের 1 মে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন অলোক শ্রীবাস্তব নামে এক ব্যক্তি । সেই মামলায় বিচারপতি দীপক মিশ্র বলেন, ‘‘পকসোর জন্য আলাদা করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে ।’’ আলাদা আদালত তৈরি করার কথা বলেছিলেন তিনি । শুরুটা হয়েছিল এ ভাবেই ।
পরে 2019 সালে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত একটি মামলায় জানায়, দেশের যে সব জেলায় 100 টির বেশি যদি পকসো মামলা হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য আলাদা করে বিশেষ আদালত তৈরি করে ওই মামলার শুনানি করতে হবে ।
কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ প্রত্যেক রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানান যে প্রত্যেক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই রাজ্যের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় বিশেষ আদালত তৈরি করবেন । সেখানে কেন্দ্র সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ থাকবে না ।
আরও পড়ুন : নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুন, যুবককে ফাঁসির সাজা দিল বোলপুর আদালত
একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে 2019 সালে মোট 1 লক্ষ 66 হাজার 882টি এই সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন ছিল । এর পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে মোট 1023 টি বিশেষ আদালত গড়ে তোলার পরিকল্পনা হয় । কিন্তু এখনও পর্যন্ত মোট 664 টি এরকম আদালত রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে । এবং 2020 সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই সমস্ত আদালতে প্রায় 2 লক্ষ 40 হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে ।
পশ্চিমবঙ্গের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে রাজ্যে এখনও পর্যন্ত 23 টি জেলায় 23 টি এইরকম বিশেষ আদালত রয়েছে । যেখানে বর্তমানে 12748 টি মামলা বিচারাধীন । এছাড়াও জেলা বিচারকের নির্দেশে অন্যান্য আদালতেও এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি করা হয় । আদালত সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ধরনের একটি বিশেষ আদালত তৈরি করতে এবং চালাতে এক বছরে প্রায় 75 লক্ষ টাকা খরচ হয় ।
আরও পড়ুন : ধর্ষণে অভিযুক্ত ওই নাবালিকাকে বিয়ে করতে রাজি কি না, জানতে চাইল শীর্ষ আদালত !
এই যে এতো যাগ-যজ্ঞ বাস্তবে কাজ কতটা হচ্ছে ? সত্যিই কি বিচার পাচ্ছেন পকসো অপরাধে জড়িতরা ?
এ ব্যাপারে আইনজীবী আশীষ কুমার চৌধুরী বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বলা হয়েছিল এই সংক্রান্ত মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করে দোষীরা যাতে শাস্তি পায় তার জন্য একটা করে বিশেষ আদালত গঠন করতে হবে । এপ্রিল 2019 সাল পর্যন্ত গোটা দেশে 664 টি এরকম আদালত কাজ করছে । কিন্তু মামলা যে হারে বাড়ছে সেই অনুযায়ী পর্যাপ্ত আদালত এখনও গড়ে ওঠেনি । যাঁরা এই বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বিশেষ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা উচিত কেন্দ্র রাজ্যের । কারণ, এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণের অভাব ভীষণভাবেই লক্ষ্য করা যায় । এক একটা আদালত তৈরি করতে এবং চালাতে বছরে প্রায় 75 লক্ষ টাকা খরচ সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার কথা বলা হয়েছে ৷ কিন্তু আদালতের পরিকাঠামোতে এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেলা আদালতের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এই আদালতগুলো । বিচারপ্রার্থীরা যাতে বুঝতে না পারেন যে তারা আদালতে এসেছেন । এবং একটা সহানুভূতি পূর্ণ পরিবেশের অভাব রয়েছে । তার জন্যই হয়তো নিষ্পত্তি না হওয়া মামলার সংখ্যা দিনে দিনে এত বাড়ছে ।"
আরও পড়ুন : আপত্তিকর ভিডিয়ো দেখিয়ে নাবালিকা নির্যাতনের অভিযোগ
আরেক আইনজীবী ফিরদৌস শামীম বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট যখন এই নির্দেশ দিয়েছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর প্রদেশের অবস্থা সবথেকে খারাপ ছিল । এই রাজ্যে পকসো আদালত তৈরি করা হয়েছে । কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি । শিশুদের মন অত্যন্ত কোমল হয় । বিচারালয়ে সত্য উদঘাটনের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন সেটার অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাই আমরা । একটি শিশু তার নির্যাতনের কথা একজন পুরুষ ডাক্তারের কাছে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, মহিলা হলে হয়তো সুবিধা হয়- এই ধরনের সমস্যা আকছার দেখা যায় । তাছাড়া প্রয়োজনীয় নথিপত্র জোগাড় করতে অনেক দেরি হয়ে যায় । ফলে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রভূত সমস্যার সৃষ্টি হয় । পাশাপাশি রাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গিগত একটা পার্থক্য রয়েছে । কারও উপর যৌন নির্যাতন হলে এরাজ্যে টাকা দিয়ে মিটিয়ে দেওয়া হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন, সেটা কোথাও এই সমস্যার সুরাহা নয় । সামাজিক ব্যাধিকে এই ভাবে দূর করা যায় না । শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন এই বিষয়টিকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন যাতে একটি শিশু তার নিজের পরিবারের লোকজন কে বলতে পারে । এটা শেখানো দরকার । সেই পাঠ্যক্রম আমাদের রাজ্যে তৈরি হয়নি ।"
তিনি আরও বলেন, "সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রেও দেখা যায় অনেক সময় অসংবেদনশীল প্রশ্ন করা হয় । এটা থেকে বিরত থাকা দরকার । এমন পরিবেশ তৈরি করা দরকার যেখানে শিশু মনে করবে, আমার একজন কাছের মানুষকে আমি আমার যন্ত্রণার কথা জানাচ্ছি । এই পরিবেশের অভাব ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায় । সমাজের মধ্যেও এই সংবেদনশীলতা একেবারেই তৈরি হয়নি ।"