কলকাতা, 15 অগস্ট : স্বাধীনতার ইতিহাসে বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলের গুরুত্ব অপরিসীম ৷ এখানেই স্বাধীনতার সকাল কাটিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি (Mahatma Gandhi) ৷ আজ 75তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে ভারত । করোনা আবহেই ভারতের রক্তক্ষয়ী স্বাধনীতা আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন বুকে এঁকে ফের উদ্বেল হতে চলেছে প্রতিটা ভারতবাসীর মন । নীল আকাশের বুক চিরে ফের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চলেছে তেরঙা পতাকা । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির অবদান অনস্বীকার্য ৷ অসহযোগ আন্দোলন (Non-cooperation movement, 1920), ভারত ছাড়ো আন্দোলনের (Quit India Movement, 1942) মতো দেশজোড়া একাধিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে কোণঠাসা করছিলেন ব্রিটিশদের ।
কংগ্রেসের হাত ধরে এগিয়েছিলেন অহিংস পথে । কিন্তু যেদিন পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশ শাসনের (British Raj) হাত থেকে মুক্তি পেতে চলেছে ভারত, হতে চলেছে পাকাপাকি ক্ষমতা হস্তান্তর, সেদিন দিল্লির বদলে কলকাতাতেই ছিলেন গান্ধিজি । ইতিহাসবিদদের মতে, বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা এল ৷ তার সূত্রপাত মাউন্টব্যাটনের (Louis Mountbatten) দেশভাগের পরিকল্পনার হাত ধরেই ।
সহজ করে বললে, 1947 সালের 15 অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা মিলেছিল দেশভাগের যন্ত্রণার বিনিময়ে । তৈরি হয়েছিল দু'টি পৃথক রাষ্ট্র- ভারত এবং পাকিস্তান ৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন শুধুই স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করছেন তখন বাঙালির কাছে তা বিস্বাদ হয় নয়া সীমান্তপারে কাঁটাতারের বেড়াজালের কারণে । স্বাধীনতার সেই পুণ্যলগ্নে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাক্ষী থেকেছিল গোটা বাংলা ।
1947 সালের 15 অগস্টের দিন স্বাধীনতার মূহূর্তে দেশের আর পাঁচজন নেতার মতো সেদিন দিল্লিতে উৎসবে মাতেননি মহাত্মা গান্ধি । বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের মুহূর্তে গান্ধিজি একাকি রইলেন দিল্লি থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে এই কলকাতাতেই । ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের আগুনে তখন জ্বলছে নোয়াখালি, কলকাতা ।
সেই সময় আগামী কয়েক দিনের জন্য গান্ধিজির নতুন ঠিকানা হয়ে উঠেছিল বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে (Hyderi Manzil) । এই হায়দরি মঞ্জিল পরে পরিচিত হয় বেলেঘাটার ‘গান্ধিভবন' (Gandhi Bhawan) বলে । মানুষকে বোঝাতে, দাঙ্গা ঠেকাতে কিছু কাছের মানুষ নিয়ে তিনি সেইসময় বেলেঘাটায় দাঙ্গা কবলিত এলাকা নিজে হেঁটে ঘুরেও দেখেন । এমনকি নোয়াখালিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধে উপবাসও করেন তিনি ।
ঘটনা হল, মুসলিম লিগের ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে (16 অগস্ট, 1946) কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তার রেশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে । দাঙ্গা নিবারণে গান্ধিজি দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে নোয়াখালিতে পৌঁছেছিলেন ওই বছরেরই নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে । শুধু তাই নয়, টানা চার মাস সেখানে ঘাঁটি গেড়ে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে ঘুরেছিলেন শান্তির জন্য ৷ 1947 সালে অগস্টের গোড়ায় তিনি চলে আসেন কলকাতায় । সোদপুর আশ্রমে কয়েক দিন থেকে 13 অগস্ট বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে ওঠেন । 1 সেপ্টেম্বর অনশন শুরু করেন, অনশন ভঙ্গ করেন 4 তারিখ । 7 সেপ্টেম্বর তিনি দিল্লি ফিরে যান । সেই তাঁর শেষ কলকাতা সফর ।
এ-তো গেল ইতিহাসের দিক ৷ আজ 75 বছর পর গান্ধিজির স্মৃতিধন্য সেই হায়দরি মঞ্জিলে যাই আমরা । কিন্তু গত বছর ছবিটা ছিল একটু অন্য ৷ এবছরও সম্ভবত ছবিটা বদলাল না ৷ করোনার কারণে লকডাউন ৷ তাই সংস্কারের কাজ সেখানে চলছে খুব ধীর গতিতে । পূর্ব কলকাতা গান্ধি স্মারক সমিতির সম্পাদক পাপড়ি সরকারের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, এই বাড়ির প্রত্যেকটা ইটের সঙ্গে কীভাবে গান্ধি আর 1947-এর সেই দিনগুলোর স্মৃতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে । পাপড়ি বলেন, "গান্ধিজির সঙ্গে বেলেঘাটার সম্পর্ক ইতিহাসের একটা সুবর্ণ অধ্যায় । স্বাধীনতার পর গান্ধিজির প্রথম ভাষণ ছিল এই বেলেঘাটাতেই । বেলেঘাটা রাসবাগান মাঠে গান্ধিজি স্বাধীনতার দিন বিকেলবেলায় প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন । সেদিন কলকাতা ছিল লোকে লোকারণ্য । গান্ধিভবন থেকে মাত্র কয়েক মিটার পথ যেতে সেদিন শহরের অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়েছিল মহাত্মাকে ৷ আসলে কলকাতার সঙ্গে গান্ধিজির সম্পর্ক ছিল এতোটাই নিবিড় যে তাঁকে স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ দিনটিতেও এখানে থাকতে হয়েছিল ।"
গান্ধিভবন সংরক্ষণ করা হয়েছে ৷ কিন্তু পাশের রাসবাগান মাঠটি পড়ে রয়েছে পুনরুদ্ধার এবং সংস্কারের অপেক্ষায় ৷ কলকাতায় গান্ধিজি সেখানেই তাঁর শেষ বক্তৃতা রাখেন ৷ তবু সেখানে তাঁর কোনও চিহ্ন দেখা যায় না আর ৷ এখন অপেক্ষা কবে হায়দরি মঞ্জিলের মতোই রাসবাগান মাঠটিও সংরক্ষণ হয় ৷
স্বাধীনতার আগের কিছুদিন সবচেয়ে কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল দু'টি রাজ্য ৷ একটা পঞ্জাব, অন্যটা বাংলা । গান্ধিজি বাংলাকে বেছে নিয়েছিলেন । এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা মুনির নানা মত ৷ বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রক্তিমা দত্তের ভাষায়, "কলকাতাকে বেছে নেওয়ার পিছনে গান্ধিজির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় বিল্পবী কাজকর্মের বাড়বাড়ন্ত । তখন গোটা দেশের নজর থাকত বাংলার দিকেই । বাংলার থেকে কোনও বার্তা খুব সহজেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ত ।"
অন্যদিকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশিস দাসের মতে, এই সময় কলকতাকে বেছে নেওয়ার পিছনে ছিল কলকাতার প্রতি তাঁর ভালবাসা । তাছাড়া 47-এর সেই দাঙ্গা কলকাতার পাশাপাশি নোয়াখালিতেও ভয়াবহ আকার নিয়েছিল ৷ গান্ধিজি চেয়েছিলেন নোয়াখালিতে যেতে । কিন্তু কলকাতার পরিস্থিতির কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত তিনি বেলেঘাটায় থেকে যান । এই দাঙ্গা থামাতে শেষ পর্যন্ত 31 অগস্ট থেকে 4 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বেলেঘাটার বাড়িতেই অনশন করেছিলেন তিনি । অনশন শেষে হিন্দু ও মুসলমানদের বড় অংশ এখানে মহাত্মা গান্ধির কাছে অস্ত্র ত্যাগ করে যায় । এরপর শান্ত হয় কলকাতা । 7 সেপ্টেম্বর দিল্লি যান মহাত্মা গান্ধি । এটাই তাঁর ছিল কলকাতা থেকে শেষ যাত্রা । কিন্তু যাওয়ার আগে গোটা দেশের মানচিত্রে বেলেঘাটাকে আলাদা জায়গা দিয়ে গেলেন ৷ কারণ শেষটায় কলকাতাকে তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছিলেন তিনি ।
75 বছর পর আজ সেই সমস্ত স্মৃতি ধুলো পড়া অতীত থেকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম আমরা ৷
আরও পড়ুন : Mahatma Gandhi : মার্কিন কংগ্রেসে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান গান্ধিজিকে দেওয়ার প্রস্তাব