কলকাতা, 31 মে : বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর কেটে গিয়েছে প্রায় এক মাস ৷ এই সময়ের মধ্যে বিজেপির অন্দরে ও বাইরে বারবার আলোচনায় এসেছে ভোটে দলের ভরাডুবির সম্ভাব্য কারণগুলি ৷ কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তরফে এই নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির অন্যতম হেভিওয়েট নেতা অমিত শাহের কাছে ৷ যা রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছে গেরুয়া শিবিরের অন্দরে ৷
স্বাভাবিক ভাবেই তাই প্রশ্ন উঠছে যে এমন কী রয়েছে ওই রিপোর্টে, যা নিয়ে বঙ্গ-বিজেপির অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে ৷ এমনকী, দলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে এ নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িও শুরু হয়েছে বলে বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে ৷ যদিও এই নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও নেতাই মুখ খুলতে চাইছেন না ৷ তবে গেরুয়া শিবিরের একটি সূত্রের খবর, ওই রিপোর্টে একাধিক বিস্ফোরক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে ৷ দলের একাধিক শীর্ষনেতার নাম উল্লেখ করে হারের কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে ৷
বিজেপির ওই সূত্র জানাচ্ছে যে 280 পাতার ওই রিপোর্টে উঠে এসেছে দলবদলুদের প্রসঙ্গ ৷ অন্য দল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়ে যাঁরা এবার পদ্ম-প্রতীকে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশকেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও জনপ্রিয়তাহীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে । সেই কারণেই মানুষ ওই নেতাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ৷ যা বিজেপির হারের অন্যতম কারণ বলে দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে ৷
এমনকী, বিজেপি নেতাদের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে অমিত শাহের কাছে জমা পড়া ওই রিপোর্টে ৷ সেখানে লেখা হয়েছে যে বিজেপির নেতাদের হুমকি, ধমকি এবং আস্ফালন দেখে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঘুরে যায় ।
রিপোর্টে উঠে এসেছে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির প্রসঙ্গও ৷ সেখানে লেখা হয়েছে, বাঙালি হিন্দুরা ‘জয় শ্রীরাম’ এর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারেননি ৷ কারণ, বাংলায় ভগবানের রামের পুজো করার চল সেভাবে নেই ৷ যে পুজোগুলি বাঙালির উৎসবের অন্যতম অঙ্গ, সেই দুর্গোৎসব ও শ্যামাপুজোকে গুরুত্বই দেয়নি বিজেপি ৷
ভোটের প্রচার-কৌশল নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওই রিপোর্টে ৷ আর সেগুলি হল, প্রার্থীরা প্রচারে নির্বাচনী তহবিলের অর্থ ঠিকভাবে খরচ করেননি ৷ কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার বাংলায় আসায় রাজ্য নেতাদের গুরুত্ব কমেছে ৷ তা নিচুতলার কর্মীরা ভালোভাবে নেননি ৷ প্রচারে লোক টানতে সেলিব্রিটিদের হাজির করানো হয়েছিল ৷ সেখানে ভিড় হলেও ভোটে তার ফল পাওয়া যায়নি ৷ অবাঙালি নেতাদের প্রচারে নামানো হয়েছিল ৷ কিন্তু মানুষ সভায় হাজির হয়েও তাঁদের কথা বুঝতে পারেননি ৷
তাছাড়া জেলাস্তরের নেতাদের একাংশের বিলাসবহুল জীবনযাপনও মানুষ ভালো ভাবে নেয়নি ৷ এর সঙ্গেই দলের রাজ্যস্তরের 30 জন শীর্ষনেতার জীবনযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই রিপোর্টে ৷ সেই তালিকায় তৃণমূল থেকে আসা দুই নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৷ সেই দুই নেতার একজন আবার ভোটের আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ৷ পাশাপাশি রিপোর্টে আরএসএস ভোটের সময় নিষ্ক্রিয় ছিল বলে দাবি করা হয়েছে ৷ এমনকী, কোথাও কোথাও আরএসএসের সঙ্গে বিজেপির নেতাদের সরাসরি সংঘাত হয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে ৷
ভোটে হারের কারণ যেমন ওই রিপোর্টে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তেমনই আগামিদিন নিয়েও কিছু আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ৷ তার মধ্যে অন্যতম হল দলে ভাঙন ৷ বিজেপির বিধায়কদের একাংশ তৃণমূলে যোগ দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে ওই রিপোর্টে ৷
আর এই বিষয়টি সামনে আসার পরই দলের নেতৃত্ব দুই ভাগে ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে বলে খবর ৷ বিজেপি সূত্রের দাবি, একটি দল বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে ৷ অন্য একটি পক্ষ আবার দিলীপ ঘোষকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি বলে প্রশ্ন তুলেছে ৷ এমনকী, প্রার্থী তালিকা তৈরিতেও দিলীপ ঘোষের মতামত নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ৷ তাই রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ ভোটে হারের দায় কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপিয়েছেন ৷
সম্প্রতি বিজেপির সাংসদ সৌমিত্র খাঁ দলের ভরাডুবির জন্য মুখ খুলেছিলেন । তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের জন্যই এই পরাজয় বলে অভিযোগ করেছিলেন ৷
এই পরিস্থিতিতে বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, "দলের পরাজয় নিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা পেয়েছি । তবে বিজেপির ভরাডুবির জন্য একটা বা দুটো কারণ থাকতে পারে না । এই হারের জন্য একাধিক কারণ আছে । দল সব বিষয়গুলি নিয়েই আলোচনা করছে । হারের কারণগুলিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে । যাতে পরবর্তী নির্বাচনে দল এই বিষয়গুলি থেকে শিক্ষা নিতে পারে ৷"
আরও পড়ুন : মমতার কাছে ক্ষমা চেয়ে তৃণমূলে ফিরতে খোলা চিঠি দীপেন্দুর