কলকাতা, 5 মার্চ: ঋণের ভারে জর্জরিত রাজ্য়ের ঘাড়ে নতুন করে বিধান পরিষদের খরচ চাপলে তা হবে দুর্ভাগ্য়জনক ও লজ্জার ৷ এমনটাই মত তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ৷ শুক্রবার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের দলীয় প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ৷ জানান, এবারের তালিকায় বহু প্রবীণ দাবিদারকেই জায়গা দিতে পারছে না নেতৃত্ব ৷ বদলে এগিয়ে আনা হচ্ছে নবীনদের ৷ করোনা আবহে প্রবীণদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানান মমতা ৷ আর এই প্রসঙ্গেই তাঁর আশ্বাস, ভোটে লড়ার সুযোগ না পেলেও প্রাপ্য় সম্মান থেকে বঞ্চিত হবেন না প্রবীণরা ৷ প্রয়োজনে শুধুমাত্র তাঁদের জন্যই ফিরিয়ে আনা হবে রাজ্যের বিধান পরিষদ ৷
তৃণমূলনেত্রীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারছে না ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ ৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রবীণ অধ্যাপক তথা প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্য়ায় মমতার এই সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জার বলে আখ্যা দিয়েছেন ৷ তাঁর সাফ কথা, ‘‘কেউ যদি আদর্শগতভাবে বিধান পরিষদ ফিরিয়ে আনতে চান, তাহলে অবশ্যই সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হবে ৷ কিন্তু মমতার উদ্দেশ্য তা নয় ৷ আর সেটাই দুর্ভাগ্য়ের ৷’’
প্রসঙ্গত, সংসদের দুই কক্ষের মতোই রাজ্য়স্তরেও বিধানসভার পাশাপাশি অপর একটি কক্ষের অস্তিত্ব রয়েছে ৷ একেই বলে বিধান পরিষদ ৷ সংসদের উচ্চকক্ষ তথা রাজ্যসভার মতোই বিধান পরিষদের সদস্যরাও কেউ নির্বাচিত নন ৷ সকলেই মনোনীত ৷
আমাদের রাজ্যে বিধান পরিষদের দরজা খুলেছিল 1952 সালে ৷ বিভিন্ন সময়ে সমাজের নানা স্তরের জ্ঞানীগুণীরা বিধান পরিষদের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন ৷ এমনকী, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্য়ায়ের মতো প্রখ্য়াত ভাষাবিদও বহু বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের চেয়ারম্য়ানের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন ৷ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিধান পরিষদের বড় কোনও ভূমিকা না থাকলেও বিভিন্ন জরুরি বিল-সহ নানা ইশুতে আরও একবার আলোচনার অবকাশ থাকত বিধান পরিষদে ৷ কিন্তু 1969 সালের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে বিধান পরিষদের অবলুপ্তি ঘটানো হয় ৷
আরও পড়ুন: কথা রেখে নন্দীগ্রামে চললেন মমতা
সমালোচকদের যুক্তি ছিল, রাজ্য প্রশাসনে বিধান পরিষদের তেমন কোনও ভূমিকা না থাকলেও খরচ ছিল বিপুল ৷ তাই সরকারি খরচে বাঁধ লাগাতে বিধান পরিষদের অবলুপ্তি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত ৷ প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও 1969 সালেই অসম, মধ্যপ্রদেশ এবং পঞ্জাব বিধান পরিষদেরও অবলুপ্তি ঘটানো হয় ৷ এই ঘটনার 9 বছর আগে 1960 সালে বন্ধ হয়ে যায় বম্বে বিধান পরিষদ ৷ এছাড়া, 1986 সালে তামিলনাড়ু বিধান পরিষদ এবং সব শেষে 2019 সালে জম্মু-কাশ্মীর বিধান পরিষদের দরজা বন্ধ হয়ে যায় ৷
এই মুহূর্তে দেশের মাত্র ছ’টি রাজ্য়ে বিধান পরিষদের সক্রিয় অস্তিত্ব রয়েছে ৷ এই রাজ্যগুলি হল অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র (বম্বে বিধান পরিষদের বদলে), তেলেঙ্গানা এবং উত্তরপ্রদেশ ৷ তথ্য বলছে, এর প্রত্য়েকটির পিছনেই বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে ৷ তাই পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ ফেরানো হলে বাড়বে খরচের বোঝা ৷ বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ রাজ্য়ে নতুন করে বিধান পরিষদের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হলে সবার আগে নতুন ভবন তৈরি করতে হবে ৷ যা অত্যন্ত ব্য়য়বহুল ৷ তাছাড়া, বিধান পরিষদের সদস্যদের প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব তেমন না থাকলেও তাঁদের প্রায় বিধায়কদের সমপরিমাণই বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে ৷ এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য় পরিকাঠামো তৈরি এবং কর্মী, আধিকারিকদের খরচ ৷ সব মিলিয়ে যা হবে হাতি পোষার সমান ৷
এদিকে, রাজ্য়ের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বারবার অভিযোগ করেন, কেন্দ্রের কাছে ঋণে জর্জরিত তাঁর সরকার ৷ এই অবস্থায় শুধুমাত্র দলের প্রবীণদের খুশি করতে বিধান পরিষদের প্রত্য়াবর্তন কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্ন থাকবেই ৷