কলকাতা, 6 অক্টোবর : মহালয়া শুধু দেবীপক্ষের আবাহনে চণ্ডীবন্দনা নয় ৷ গীতিআলেখ্যটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দ্যোতনাও বটে ৷ উত্তর কলকাতার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাগবাজারের বাণীকুমার এবং পঙ্কজ মল্লিকের ত্রিবেণী সঙ্গমে গড়ে ওঠা মহিষাসুরমর্দিনী বাঙালির শারোদৎসবের সূচনা ৷ পিতৃপুরুষকে তর্পন করে হিন্দুরা অকালবোধনের আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠা শুরু করে ৷ দেবীর চক্ষুদান হয় এদিনই ৷
ধর্ম নিজের উৎসব সবার ৷ এই কথাটি শারোদৎসবের ছত্রে ছত্রে রয়েছে ৷ শিল্পীর যেমন জাত, ধর্মের সীমানা নেই, তেমনই উৎসব সীমানা ছাড়িয়ে ৷ ‘মহা’ শব্দটির মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে উদাত্ত আহ্বান ৷ তাই মহালয়ার ভোরে বীরেনবাবুর সংস্কৃতি স্তোত্রপাঠ হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসবের ঘোষণা হলেও তা ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করে সর্বধর্মের মিলনের কথা বলে ৷ এই ধারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলেছে ৷ ফিউশনের যুগেও যা অপরিবর্তনীয় ৷ বদলানোর চেষ্টা যে হয়নি, তা নয় ৷ কিন্তু, সেই চেষ্টায় মহানায়ক উত্তমকুমারকে জড়িয়েও সাফল্য আসেনি ৷
আরও পড়ুন : Mahalaya 2021 : গঙ্গার ঘাটগুলিতে জনসমুদ্র, "ভগবানের উপর বিশ্বাস রেখে এসেছি", বলছেন পুণ্যার্থীরা
1976-এর ‘দেবী দুর্গতিহারিণী’তে উত্তম কুমার প্রথম এবং শেষবার অংশ নিয়েছিলেন ৷ চিরাচরিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সৃষ্টিকে নতুনভাবে মেলে ধরতেই তারকাখচিত শিল্পীর মেলায় ভিন্ন আঙ্গিক তুলে ধরা হয়েছিল ৷ কিন্তু শ্রোতারা মেনে নেননি ৷ ফলে সেবার ষষ্ঠীর দিন বীরেনবাবুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ৷ তবে বাঙালি যে মহালয়ার সকালে অন্য আরও একজনের কণ্ঠেও চণ্ডীপাঠ শুনেছে, সেই তথ্যটা খুব কম মানুষই জানেন ৷ সেবার নাজির আহমেদের গলায় উদাত্ত চণ্ডীপাঠ শুনে বাঙালির মহালয়ার ভোর শুরু হয়েছিল ৷
দেশ তখন পরাধীন ৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র উচ্চারণ নিয়েই অনেক মানুষের আপত্তি ছিল ৷ ফলে ভারতের স্বাধীনতার আগের শেষ পাঁচ বছর একটানা আকাশবাণীর সদর থেকে গোটা বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একজন অব্রাহ্মণ তথা অহিন্দুর কণ্ঠ ৷ দেশ ভাগ না হলে আজও হয়তো সেটাই শুনতাম আমরা ৷ সালটা ছিল 1982 ৷ সেবার মহালয়ার ভোরে স্টুডিয়োয় আসতে দেরি করছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ৷ সময়ের চাপে সেদিনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেই জন্য বিপদতাড়ন হয়েছিলেন তরুণ বাচিক শিল্পী নাজির আহমেদ ৷ আয়োজকরা পঙ্কজ মল্লিকের কাছে এসে প্রস্তাব দিয়েছিলেন চণ্ডীপাঠ করার ৷ সেকালের ম্যাট্রিকে সংস্কৃতে লেটার পাওয়া নাজির অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারার কথা বলেছিলেন ৷
সময়ের চাপে উপায়ন্তর না পেয়ে, কোনও রাস্তা না পেয়ে পঙ্কজ মল্লিক রাজি হয়েছিলেন ৷ আর তাতেই ইথার তরঙ্গে ম্যাজিক ঘটেছিল ৷ হন্তদন্ত হয়ে কিছুটা সময় পর স্টুডিয়োয় এসে হাজির হয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ৷ নাজিরের স্তোত্র উচ্চারণ শুনে তিনিও মুগ্ধ হয়েছিলেন ৷ আশীর্বাদ করে চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন ৷ উঠতি শিল্পীর স্বরক্ষেপণের মুগ্ধতা তাঁকে এতটাই গ্রাস করেছিল যে কিন্তু কিন্তু করতে থাকা পঙ্কজ মল্লিকের দ্বিধা কাটানোর ভার বীরেন ভদ্র নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ৷ বীরেনবাবু নিজে নতুনকে স্বাগত জানাতে পছন্দ করতেন ৷ উত্তমকুমারও তাঁর কাছে গিয়েছিলেন ৷ তাঁকে নিরাশ বা সমালোচনা করেননি তিনি ৷ বদলে উৎসাহিত করেছিলেন। এরপর থেকে 1946 সাল পর্যন্ত মহালয়ার দায়িত্ব সামলেছিলেন নাজির আহমেদ ৷ মাঝে অবশ্য বড় বদল ঘটে গিয়েছিল।
1944-45 সালের মধ্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের জন্য দ্বায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক ৷ বদলে দায়িত্ব বর্তেছিল শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উপর ৷ প্রথম বছর একই সুরে মহালয়ার অনুষ্ঠান করলেও দ্বিতীয় বছরে নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ৷ কিন্তু তা শ্রোতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ৷ 1946 এ পঙ্কজবাবুর প্রত্যাবর্তন এবং পুরনো মেজাজে মহিষাসুরমর্দিনী ফের সম্প্রচারিত হয় ৷
আরও পড়ুন : Locket Chatterjee: নিহত বিজেপি কর্মীদের নামে তর্পণ সাংসদ লকেটের
এরপর আসে 1947 ৷ দেশভাগের অভিশাপে নাজির আহমেদ ফিরে যান ওপার বাংলায় ৷ ঢাকা রেডিয়োয় যোগ দেন তিনি ৷ ফলে আবার পুরনো জায়গায় ফিরতে হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে ৷ শুধু বাচিক শিল্পীরাই নন, যন্ত্র শিল্পীদের মধ্যেও ছিল সম্প্রীতির সুর ৷ সারেঙ্গি নিয়ে বসতেন মুন্সী, চেলো নিয়ে তাঁর ভাই আলী আর হারমোনিয়ামে মহম্মদ ৷ এঁরা তিনজন তো হিন্দু ননই, উপরন্তু উর্দুভাষী ইসলামধর্মালম্বী ৷
রিহার্সাল শুরুর আগে সবাইকে বোঝানো হয়েছিল বাংলা পাঠ চলাকালীন তারা আবহ বাজাবেন ৷ সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারণ শুরু হলে থেমে যেতে হবে ৷ কিন্তু যাঁদের সেকথা বোঝানো হয়েছিল, ভাষাজনিত সমস্যায় তাঁরা তা বোঝেননি ৷ ফলে বীরেন ভদ্র বাংলা থেকে সংস্কৃততে চলে গেলেও যন্ত্রীরা থামেননি ৷ বাজাতেই থাকেন ৷ কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তিনজন বাজিয়ে গেলেও ভাষ্যের সঙ্গে বিচ্যুতি হয়নি ৷ ভুল কখনও কখনও আশীর্বাদ ৷ পঙ্কজকুমার মল্লিক এই ‘ভুল’ থেকেই শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা বদল করেছিলেন ৷ সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারণের মাঝেও যন্ত্রানুসঙ্গ যোগ করেছিলেন তিনি ৷