কলকাতা, 27 মে : ঘূর্ণিঝড় আমফানে বিধ্বস্ত দক্ষিণবঙ্গে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনে ভিক্ষে করতে রাজি, এমনই জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷
আজ নবান্নে জেলাশাসক ও পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সর্বনাশা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছি ৷’’ বিধ্বংসী আমফানে তছনছ হয়ে যাওয়া জেলাগুলিতে যাতে ত্রাণ সামগ্রী বিলি নিয়ে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য জেলাশাসকদের কড়া নির্দেশ দেন ৷ তিনি বলেন, ‘‘মানুষ যেন অভুক্ত না থাকে ৷ প্রয়োজনে ধার করব, ভিক্ষে করব ৷’’ একদিকে আমফান, অন্যদিকে রাজ্যে কোরোনার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ যেসব পরিযায়ী শ্রমিক রাজ্যে ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে 25 শতাংশ কোরোনা পজ়িটিভ ৷ এর জন্য রেলমন্ত্রককে একহাত নিয়ে মমতার বার্তা, ‘‘দয়া করে রাজনীতি করতে গিয়ে দেশের পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করবেন না ৷’’ তাঁর অভিযোগ, রেলমন্ত্রকের তরফে রাজ্য সরকারকে কিছু না জানিয়ে একসঙ্গে বহু ট্রেন পাঠানো হচ্ছে ৷ ট্রেনে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না ৷ ফলে কোরোনা সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন ৷ তিনি আরও বলেন, ‘‘অমিত শাহকে বলেছিলাম, রাজ্য সরকার যখন সবটা সামলাতে পারছে না, তখন কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করুক ৷ কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁরা রাজ্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না ৷ রেলমন্ত্রকের কোনও দায়িত্ব নেই ৷ রাজনৈতিক মর্জি মতো গায়ের জোরে কাজ করছে ৷ মানুষের দুর্ভোগ সামলাব না রাজনীতি সামলাব?’’
গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি ও চেন্নাই থেকে এরাজ্যে যারা আসবেন, তাঁদের কোয়ারানটিন সেন্টারে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৷ তবে কোয়ারানটিনে সেন্টারে ঘরের খাবার খাওয়া যাবে ৷ 14 দিন সেন্টারে থাকার পর তাঁদের পরীক্ষা হবে ৷ তারপর সোয়াব টেস্ট হবে ৷ এই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘পাঁচ-ছ’লাখ মানুষ ভিন রাজ্য থেকে এসেছেন ৷ এত মানুষকে কোয়ারানটিনে রাখা অসম্ভব ৷ মাছ-মাংস দিতে পারব না ৷ দু’বেলা ভাত-ডাল দিতে পারব ৷ কোনওদিন না জোটাতে পারলে দিয়ে দেব ৷’’
আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতে জল ও বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে ৷ আজ নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী এর জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেন, ‘‘CESC বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিকের ক্ষেত্রে কয়েক জায়গায় দেরি করেছে ৷ এর জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী ৷ বিপদের সময় লোক ছাড়তে নেই ৷ যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে ৷ 90 শতাংশ বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু হয়েছে ৷ WBSEDCL ভালো কাজ করেছে ৷ হাওড়ায় ওদের 2-3 শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে ৷’’ ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে সাড়ে চার লাখ বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে ৷ সেইসব পুনরায় ঠিক করতে গেলে সময় লাগবে বলে আগেই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ যেসব জায়গায় জল জমে রয়েছে, সেখানে জল না সরলে বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক হতেও সময় লাগবে ৷ উপকূলে নিচু এলাকায় নোনাজল ঢুকে পানীয়জলের সবথেকে বেশি সমস্যা হয় ৷ আমফান পরবর্তীতে মানুষের যাতে জলের কষ্ট না হয়, তার জন্য 100 কোটি টাকা খরচ করে নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার ৷
আমফানের পরে সাড়ে 10 লাখ হেক্টর চাষের জমি নষ্ট হয়ে গেছে ৷ 1 লাখ পানের বরজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে ৷ নোনাজল চাষের জমিতে ঢুকে গেলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় ৷ এর জন্য রাজ্য সরকার নতুন একটি প্রকল্প আনতে চলেছে ৷ মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘‘নোনাজলে বিশেষ ধান ও মাছ চাষ করা যায় ৷ এর জন্য নোনাস্বর্ণ প্রকল্পের মাধ্যমে নোনাজলে ধান ও মাছ চাষ করা হবে ৷ তার জন্য পেটেন্ট করতে হবে ৷’’ আমফানে 160 কিলোমিটার নদীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷ সামনেই পূর্ণিমা এবং তখন ভরা কোটাল থাকবে ৷ বাঁধে ফাটল থাকলে চাষজমিতে নোনাজল ঢুকে যাবে ৷ তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেগুলি সারাই করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷
ন’লাখ পশু ও পাখি মারা গিয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপে ৷ এর থেকে যাতে কোনও রোগ না ছড়ায় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, ‘‘58 হাজার হেক্টর ফিশারি ও পুকুর নষ্ট হয়ে গেছে ৷ এটা বড় ক্ষতি ৷ সুন্দরবন একেবারে শেষ হয়ে গেছে ৷’’ আমফানের জেরে রাজ্যে 21টি জেটি, 300টি সেতু ও PWD-র 317 কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷ শুধু সুন্দরবন দপ্তরের অধীনে নষ্ট হয়েছে 700 কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা ৷ ঘূর্ণিঝড়ের আগে সাড়ে আট লাখ মানুষকে সরানো হয়েছিল ত্রাণ শিবিরে ৷ তার মধ্যে দু’লাখ মানুষ এখনও শিবিরে রয়েছেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ছ’কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমফানের জেরে ৷ 87 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ আমফানে মৃত্যু হলে আড়াই লাখ, গুরুতর আহতদের 50 হাজার ও অল্প আহতদের 25 হাজার সাহায্য দেবে রাজ্য সরকার ৷ 10 লাখ বাড়িকে 20 হাজার টাকা করে সাহায্য দেওয়া হবে ৷’’ হাওড়ায় এক দমকল কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় শোকপ্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘দমকল কর্মীর মৃত্যুর তদন্ত হবে ৷ মৃতের পরিবারকে 10 লাখ দেওয়া হবে ৷ পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়া হবে ৷’’ এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারির নির্দেশ দিয়েছেন তিনি ৷
আমফান পরিস্থিতিতে নজরদারি চালাতে একটি টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ টাস্কফোর্সের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকা পর্যবেক্ষণ করবেন ৷ প্রতিদিন সন্ধে ছ’টায় টাস্কফোর্সের একটি বৈঠক হবে ৷