কলকাতা, 30 অগাস্ট : ক্রমেই বাড়ছে কোরোনায় আক্রান্তের সংখ্যা । প্রায় প্রতিদিন নতুন রেকর্ড গড়ছে একদিনে কোরোনার সংক্রমণ । এই অবস্থায় বাড়িতে থেকেও অনেক COVID-19 রোগীর চিকিৎসা চলছে । শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে না বাড়ছে, নিজেই তা পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব । কিন্তু, যদি পালস অক্সিমিটার না থাকে, তা হলে এই লাং ফাংশন টেস্ট কীভাবে করবেন ?
ফুসফুসের কোনও অসুখে যাঁরা আক্রান্ত, সাধারণত তাঁদের জন্য পালস অক্সিমিটার প্রেসক্রাইবড করতেন চিকিৎসকরা । তবে, COVID-19-এর এই আবহের মধ্যে অন্য বিভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা এখন এই চিকিৎসা-যন্ত্র প্রেসক্রাইবড করছেন । যার জেরে, এই চিকিৎসা-যন্ত্রের চাহিদা বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে । এমনও দেখা যাচ্ছে, কোনও চিকিৎসক প্রেসক্রাইবড না করলেও অনেকে ঘরে রাখছেন এই চিকিৎসা-যন্ত্র । চিকিৎসকরা বলছেন, এই চিকিৎসা-যন্ত্রের মাধ্যমে রোগী নিজেই দ্রুত তাঁর লাং ফাংশন টেস্ট করে নিতে পারেন । কারণ, পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ এবং হার্টবিট দেখে নেওয়া যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ।
COVID-19-এর এই আবহের মধ্যে পালস অক্সিমিটার কেন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ? দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট চিকিৎসক মহুয়া ভট্টাচার্য বলেন, "অনেক COVID-19 রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্বাসকষ্ট নেই, কাশি নেই, শুধুমাত্র তাঁর জ্বর হয়েছিল । তার পরে অক্সিজেন মেপে দেখা যাচ্ছে, তাঁর শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ নেমে 80-85 শতাংশ হয়ে গেছে। এমনও দেখা গেছে অক্সিজেনের পরিমাণ 60 শতাংশে নেমে গেছে।"
তিনি বলেন, "এই COVID-19 অসুখ থেকে এই কথাটি এসেছে, হ্যাপিলি হাইপক্সিক । অর্থাৎ, কষ্ট নেই অথচ, শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কম রয়েছে । COVID-19-এর এই পরিস্থিতির মধ্যে এই জন্য পালস অক্সিমিটারের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে । সাধারণত কী হয়, শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেনের পরিমাণ মেপে দেখা হয় । কিন্তু, COVID-19-এর ক্ষেত্রে অতটা শ্বাসকষ্ট নেই অথচ, অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, এটা দেখা যাচ্ছে । এই জন্য পালস অক্সিমিটার এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ।"
পালস অক্সিমিটার একটি ছোটো যন্ত্র যেটা দিয়ে লাং ফাংশন টেস্ট করা হয় । পালস অক্সিমিটার ডিটেক্ট করে বলে দেবে শরীরে কতটা অক্সিজেন রয়েছে বা, আরও কতটা অক্সিজেনের প্রয়োজন রয়েছে। যাঁদের অ্যাজ়মা, COPD কিংবা, ফুসফুসের কোনও অসুখ রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয় । কিছু মানুষের বাড়িতে এই ইন্সট্রুমেন্ট আগে ব্যবহার করা হত । এ কথা জানিয়ে ইনফেকশাস ডিজ়িজ়েস অ্যান্ড বেলেঘাটা জেনেরাল (ID&BG) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, চিকিৎসক তপন বিশ্বাস বলেন, "COVID-19-এর ভাইরাস প্রধানত আমাদের ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে । এই জন্য লাং ফাংশন অ্যাসেসমেন্ট করাটা খুবই দরকারি । COVID-19-এর ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় রোগীর শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ 94 শতাংশের নিচে নেমে যাচ্ছে, তা হলে তখন রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে ।"
কলকাতার ID&BG হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন এই প্রধান বলেন, "COVID-19-এর প্যানডেমিকের এই পরিস্থিতিতে যেহেতু বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং হাসপাতালে বেডের ক্রাইসিস রয়েছে, তাই রোগীকে বাড়িতে রেখে কীভাবে তার লাং ফাংশন টেস্ট বা অক্সিজেনের পরিমাণ মনিটর করা যায়, তার জন্য চিকিৎসকরা অনেক চিন্তা-ভাবনা করে অনেক রোগীর ক্ষেত্রে এই পালস অক্সিমিটার এখন প্রেসক্রাইবড করছেন।"
তিনি বলেন, "এই যন্ত্রের মাধ্যমে পালস অর্থাৎ হার্ট রেট কত রয়েছে আর শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কত রয়েছে, এই দুটো বিষয় ডিটেক্ট করা যায়। COVID-19-এর ক্ষেত্রে পালসের উপর অতটা গুরুত্ব না দিয়ে অক্সিজেনের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারণ COVID-19 ফুসফুসকেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য পালস অক্সিমিটার খুব উপকারী একটি ইন্সট্রুমেন্ট। COVID-19-এর এই পরিস্থিতির মধ্যে এই ইন্সট্রুমেন্টের গুরুত্ব অনেক বেড়ে চলেছে ।"
কিন্তু, যাঁদের কাছে পালস অক্সিমিটার নেই অথবা, পালস অক্সিমিটার কেনার মতো যাঁদের সামর্থ্য নেই, COVID-19-এর এই পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে তাঁরা নিজেদের শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ দেখে নিতে পারবেন ? পালস অক্সিমিটার ব্যবহার না করে অন্য উপায়ে কীভাবে বাড়িতে লাং ফাংশন টেস্ট করা যায়? ID&BG হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, চিকিৎসক তপন বিশ্বাস বলেন, "এটা হল সিঙ্গল ব্রিদ কাউন্ট টেস্ট । কোনও COVID-19 রোগীর কাছে যদি পালস অক্সিমিটার না থাকে এবং তিনি যদি বাড়িতে থেকে ট্রিটমেন্ট করাতে চান, তা হলে তাঁর লাং ফাংশন ঠিক আছে কি না, তিনি কীভাবে বুঝবেন? এর জন্য তাঁকে ছোটো একটি টেস্ট করতে হবে, যাকে আমরা বলি সিঙ্গল ব্রেইদ কাউন্ট টেস্ট ।"
কীভাবে এই সিঙ্গেল ব্রেইদ কাউন্ট টেস্ট করা যায়? চিকিৎসক তপন বিশ্বাস বলেন, "জোরে শ্বাস নিয়ে এক থেকে কতটা পর্যন্ত গুনতে পারবেন, সেটা ওই রোগীকে দেখতে হবে । সাধারণ কোনও মানুষ 30 থেকে 40 পর্যন্ত এভাবে গুনতে পারেন । যাঁদের ক্ষেত্রে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এভাবে 20 পর্যন্ত গুনতে পারাকে আমরা ক্রিটিক্যাল হিসাবে ধরি । 20-র বেশি যদি কেউ গুনতে পারেন, তাহলে বোঝা যাবে তাঁর লাং ফাংশন ঠিক আছে। 20-র কম কেউ যদি গোনেন, তাহলে তাঁর লাং ফাংশন কম্প্রোমাইজ়ড অর্থাৎ, যদি কেউ 10-12 পর্যন্ত গুনতে পারেন, তখন তাঁর ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটর অথবা, রেসপিরেটরি সাপোর্টের অবশ্যই দরকার । তিনি বলেন, "যাঁদের ক্ষেত্রে পালস অক্সিমিটার কেনার সামর্থ্য রয়েছে, তাঁরা পালস অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেপে দেখতে পারেন। যাঁদের ক্ষেত্রে পালস অক্সিমিটার কেনার সামর্থ্য নেই, তাঁরা সিঙ্গল ব্রেইদ কাউন্ট টেস্ট করে লাং ফাংশন অ্যাসেসমেন্ট করে নিতে পারেন, বিশেষ করে COVID-19-এর এই প্যানডেমিক পরিস্থিতির মধ্যে ।"
বেসরকারি এক হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "যিনি COVID-19-এ আক্রান্ত হয়ে হোম কোয়ারানটিনে আছেন এবং, যিনি খুব সিভিয়ারলি অ্যাফেক্টেড নন, তিনি কীভাবে অ্যাসেসমেন্ট করবেন যে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না অবনতি হচ্ছে? এর জন্য সহজ একটি উপায় হল পালস অক্সিমেট্রি । কিন্তু, এমন হতেই পারে পালস অক্সিমিটার কেনার জন্য হয়ত তাঁর সামর্থ্য নেই । তিনি কী করবেন? উপায় হল সিঙ্গল ব্রেইদ কাউন্ট বা ব্রেইদ হোল্ডিং টেস্ট।" এই টেস্ট করার জন্য কোনও যন্ত্র লাগছে না । খুব বেশি হলে একটি ঘড়ির প্রয়োজন হচ্ছে । তবে, ঘড়ি না থাকলেও চলবে । তিনি বলেন, "একটি বড় শ্বাস নিয়ে ধরে রেখে ধীরে ধীরে এক থেকে গুনতে শুরু করতে হবে । একজন যদি নিয়মিত করতে থাকেন, তা হলে তিনি বুঝতে পারবেন তাঁর ফুসফুসের অবস্থা ভালো হচ্ছে না কি খারাপ হচ্ছে ।"
চিকিৎসা কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "এর সঙ্গে আরও কতগুলি বিষয় হচ্ছে, COVID-19 হলেই যে শুধুমাত্র শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন কিন্তু নয় । COVID-19-এ অনেক সময় পেটের সমস্যাও দেখা দেয় । এক্ষেত্রে বার বার লুজ় স্টুল হচ্ছে কি না, সেটা নজরে রাখা উচিত ।"
COVID-19-এ কারও হয়ত প্রথমে জ্বর এসেছিল, তার পরে জ্বর চলে গেল, তিনি মনে করলেন সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু তাঁর যদি আবার কয়েকদিন গ্যাপ দিয়ে নতুন করে জ্বর আসা শুরু হয়, সেটাও কিন্তু একটা ওয়ার্নিং সাইন যে হয়ত তাঁর সাইটোকাইন স্টর্ম হচ্ছে। এই কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, "সাইটোকাইন স্টর্ম হল, রোগের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে যে কেমিকেল শরীর তৈরি করে কিন্তু যে কেমিকেল আলটিমেটলি শরীরের ক্ষতি করে, এই কেমিকেলগুলিকে বলা হয় সাইটোকাইন।"
চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "সাইটোকাইন স্টর্ম COVID-19-এর প্রথম দিকে হয় না। একটু পরের দিকে হয়। ব্লাড টেস্ট করে এটা জানা যেতে পারে তবে তা খরচসাপেক্ষ। এখন অনেক জায়গায় এই ব্লাড টেস্ট করা হচ্ছে । তবে এখনও সকলের নাগালের মধ্যে নয়। হোম কোয়ারানটিনে থাকা রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে ব্লাড টেস্ট করা মুশকিল।" তিনি বলেন, "বাড়িতে যে রোগী আছেন, পালস অক্সিমিটার যদি না থাকে তা হলে তিনি অন্তত সিঙ্গল ব্রেইদ কাউন্ট করতে পারেন। সিঙ্গল ব্রেইদ কাউন্ট কমে যাচ্ছে কি না, নতুন করে জ্বর আসছে কি না, বা লুজ স্টুল বেড়ে গেল কি না, বা গলা খুব চোকড হয়ে আসছে সঙ্গে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা বা গা-হাত-পা প্রচণ্ড ব্যথা এবং উইকনেস। অনেক সময় ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়ার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে উইকনেসের বিষয়টি। COVID-19-এ একটু সিরিয়াস হলে অনেকের ক্ষেত্রে ব্লাড প্রেসার ফল করে। এটাও একটা ওয়ার্নিং সাইন। এ সব থেকে বোঝা যেতে পারে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না অবনতি হচ্ছে।"