সেকালে বাংলা বই হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হত ৷ এপাড়া ওপাড়ার গ্রন্থাগারগুলোও ছিল জীবিত ৷ কেবল সাহিত্য মনস্করাই নয়, সাধারণ বাঙালির সঙ্গেও বঙ্গ সাহিত্যের শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল ৷ তাই বিয়ের উপহারের অন্যতম ছিল বাংলা বই ৷ আজ যা শুনে অলীক লাগে ৷ এর অন্যতম কারণ, সেকালে বিনোদনের অনুসঙ্গ আজকের মতো বিস্তৃত ছিল না৷ ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ছিল না ৷ এমনকী কয়েকশো টিভি চ্যানেলও না ৷ একথা সত্যি ৷ তবে, আরও একটা কারণ গুরুত্বপূর্ণ ৷ তা হল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উঠে আসা অসংখ্য গুণি বাঙালি সাহিত্যিক ৷ সেভাবেই গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শিকার, বন, বন্যপ্রাণ, প্রেম, নারী-পুরুষের সম্পর্কের অতল কাহিনি নিয়ে এসে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ ৷ অরণ্য তাঁর যে কোনও রচনার অন্যতম সম্পদ ৷ হবে নাই বা কেন, একদিকে যেমন পূর্বভারতের অরণ্য, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গে ছিল নিবিড় সম্পর্ক । তেমনই ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, পূর্ব আফ্রিকা, ওদিকে কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ডের জঙ্গলও তাঁর দেখা ৷
বুদ্ধদেব গুহর জন্ম 29 জুন, 1936 সালে কলকাতায় ৷ উজ্জ্বল ছাত্র বুদ্ধদেবের পড়াশুনো সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ৷ পরবর্তীতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ৷ এই পেশার জীবনেও রীতিমতো সফল ৷ দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ডের নিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টাও ছিলেন একটা সময় ৷ যদিও তাতে সাহিত্য রচনায় ভাটা পড়েনি ৷ তাই বুদ্ধদেব গুহ মানে 'চান ঘরে গান', 'হলুদ বসন্ত', 'কোজাগর', 'কোয়েলের কাছে', 'একটু উষ্ণতার জন্য', 'বাবলি', 'নগ্ন নির্জন' এবং অবশ্য অবশ্যই 'মাধুকরী' ৷
একজন সফল বাঙালি লেখকের অন্তত একটি এমন বই থাকেই, যা চট করে ভুলতে পারে না পাঠক ৷ বিভূতিভূষণের যেমন পথের পাঁচালি, মানিকের যেমন পদ্মানদীর মাঝি, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেমন অলৌকিক জলযান, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের যেমন ঘুণপোকা ৷ অসংখ্য সাহিত্যকৃতি থাকলেও বুদ্ধদেব গুহ বলতেই তেমন মাধুকরী-র কথা মনে হয় পাঠকের ৷ মাধুকরী যেমন বেস্টসেলার, তেমনই লেখকের অন্যতম বিতর্কিত উপন্যাস ৷ মাধুকরী-র নায়ক পৃথু ঘোষকে ভুলতে পারবে না বাঙালি সাহিত্য রসিক ৷ বুদ্ধদেবের যে নিজস্বতায় বারবার মজেছে বাঙালি, সেই প্রেম, সাহসী পুরুষ ও অন্যন্য নারী চরিত্র এবং অরণ্য গন্ধময় জীবন গাঁথায় অপূর্ব মাধুকরী ৷ 'বড়'-দের উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও সমানতালে লিখেছেন বুদ্ধদেব ৷ কে ভুলবে 'ঋভু'-র ভূবন, ঋজুদার অ্যাডভেঞ্চার ৷
যখন তিনি প্রবীণ তখন সংগীত শিল্পী বুদ্ধদেব গুহকে চিনেছে বাঙালি ৷ যদিও সংগীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রবল পুরাতনী, নিধুবাবুর টপ্পার মতোই ! বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ঋতু গুহ বুদ্ধদেব গুহ-র স্ত্রী, একথা অনেকেই জানেন ৷ তবে কম লোকে জানেন, বুদ্ধদেব গুহ নিজেও একজন উচ্চমানের রবীন্দ্রসংগীত গাইয়ে ৷
আরও পড়ুন: প্রয়াত বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ
অতএব, আজ, 30 আগস্ট, 2021-এ করোনা আক্রান্ত বিষাদ পৃথিবী ছেড়ে যিনি চলে গেলেন, তিনি একজন বহুমুখী বিরল প্রতিভা বললেও সবটা বলা হয় না ৷ যিনি চলে গেলেন তিনি আসলে বন, বন্যপ্রাণ, মানুষ ও মহাজগতের মাঝখানে সুতো টেনে সম্পর্কের এক মালা গাঁথতে চেয়েছিলেন ৷ জীবনের সেই গহন সবুজ-উৎসবের কথা বলে গেলেন বুদ্ধদেব গুহ, যেখানে আদিম শিকার কাহিনি যেমন আছে, তেমনই আছে বুনোফুলের মন কেমন করা গন্ধ ৷ যে ফুল পুরুষের হাত ঘুরে নারীর খোঁপায় ফুটে উঠলেই সম্পূর্ণ হয় আবর্তন ৷