কলকাতা, 7 জানুয়ারি : 2019-এর লোকসভা নির্বাচনের (Loksabha Election 2019) ফলাফলে সকলকে চমকে দিয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ পশ্চিমবঙ্গের 42টি লোকসভা আসনের মধ্যে 18টিতে জয় পেয়েছিল গেরুয়া শিবির ৷ তারপর 2021-এর বিধানসভা ভোট (West Bengal Assembly Election 2021) যত এগিয়েছে, ততই তাদের ঘিরে প্রত্যাশার পারদ চড়েছে ৷ কিন্তু বিধানসভায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তারা ৷ আর তার পর থেকে সময় যত এগিয়েছে, ততই বিজেপির অন্দরে ফাটল ক্রমশ চওড়া হতে শুরু করেছে (Faction Feuds in Bengal BJP) ৷ বর্তমানে বঙ্গ-বিজেপি কার্যত দ্বিখণ্ডিত ৷
বিজেপির বঙ্গ শাখায় সাম্প্রতিক সাংগঠনিক রদবদলের পর থেকেই এই কোন্দল ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে ৷ কলকাতা পৌরনিগমের নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে গোহারা হেরে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির অন্দরেও টেনশনের চোরাস্রোত বেড়েছে ৷
আরও পড়ুন : State BJP Plan: লক্ষ্য 2024 লোকসভা ভোট, রাজ্য বিজেপি'তে নতুন মুখেদের প্রাধান্য
কিন্তু বঙ্গ বিজেপির নবনির্বাচিত সভাপতি সুকান্ত মজুমদার (Bengal BJP Chief Sukanta Majumder) আন্দাজ করতে পারেননি যে বিষয়টি ওপর থেকে যেমন মনে হচ্ছে, ভিতরে তার থেকে অনেক বেশি খারাপ ৷
কলকাতা পৌরনিগমের নির্বাচনে (KMC Election 2021) 144টি আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছে মাত্র তিনটিতে ৷ আর তার পর যখনই দলের নতুন কমিটি ও সহ-সভাপতিদের নাম ঘোষণা হল, তার পরই শুরু হল বিদ্রোহ ৷
গত 22 ডিসেম্বর বঙ্গ-বিজেপির তরফে 11 জন নতুন সহ-সভাপতি, পাঁচজন সাধারণ সম্পাদক, এবং 12 জন সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয় ৷ একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়৷ সাতটি মোর্চার সভাপতির নামও ৷ এছাড়া মিডিয়া ইনচার্জ, আইটি সেল ও সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও নাম সেদিন ঘোষণা করা হয় ৷ এমনকী, সেদিন ঘোষণা করা হয় দলের মুখপাত্রদের নামও ৷
সেই তালিকায় নাম ছিল না দীর্ঘদিনের বিজেপি নেতা বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরী, রাজকমল পাঠক, রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়প্রকাশ মজুমদার, প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, রীতেশ তিওয়ারি, দেবাশিস মিত্রদের ৷ সহ-সভাপতি পদ থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া হয় ৷ সায়ন্তন বসুর নাম সাধারণ সম্পাদকের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় ৷ সায়ন্তন ও বিশ্বপ্রিয়, দু’জনেই গেরুয়া রাজনীতির পরিসরে পশ্চিমবঙ্গে অন্যতম পরিচিত মুখ ছিলেন ৷
আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ নাম, যাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি হলেন সৌমিত্র খাঁ ৷ সৌমিত্র ছিলেন বিজেপির যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি ৷ বিষ্ণুপুরের দু’বারের সাংসদকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আনা হয় ইন্দ্রনীল খানকে ৷ তিনি অতি সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করেছিলেন কসবা থেকে ৷ কিন্তু জিততে পারেননি ৷ তবে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা সৌমিত্রকে বঙ্গ-বিজেপির সহ-সভাপতি করা হয়েছে ৷
মহিলা মোর্চাতেও বদল এনেছে বঙ্গ-বিজেপি ৷ আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রাকে বাদ দিয়ে মহিলা মোর্চার সভানেত্রী করা হয়েছে তনুজা চক্রবর্তীকে ৷ অগ্নিমিত্রাকে সাধারণ সম্পাদক করে রাজ্য কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে ৷
আপাতভাবে নতুনদের নিয়ে কোনও সমস্যা থাকার কথাই নয় ৷ কিন্তু এই নিয়ে সমস্যার শিকড় যে কতটা গভীরে, তা হয়তো বুঝতে পারেননি বঙ্গ-বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কিংবা তাঁর সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী ৷ উত্তর 24 পরগনা, নদীয়া কিংবা বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলি, যেখানকার একটা বড় অংশে বিজেপির ভিত শক্ত, সেখানেই সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ তৈরি হয়েছে দলের অন্দরে৷ মতুয়া নেতারাও ক্ষুব্ধ ৷
বিপর্যয়?
সাংগঠনিক রদবদলের তিনদিনের মধ্যে মতুয়া-শক্তিশালী এলাকার পাঁচ বিজেপি বিধায়ক দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করেন ৷ সেই তালিকায় ছিলেন - বনগাঁ উত্তরের অশোক কীর্তনিয়া, হরিণঘাটার অসীম সরকার, কল্যাণীর অম্বিকা রায়, রানাঘাট দক্ষিণের মুকুটমনি অধিকারী এবং গাইঘাটার সুব্রত ঠাকুর৷ প্রত্যেকেই একই সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করেন ৷
পরের দিন একই ছবি দেখা যায় বাঁকুড়ায় ৷ সেখানে ওন্দার অমরনাথ শাখা, সোনামুখীর দিবাকর ঘরামি, ইন্দাসের নির্মল ধাড়া ও বাঁকুড়ার নীলাদ্রিশেখর দানা, সকলে একসঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করেন ৷
আরও পড়ুন : Tathagata Roy Tweets : ‘‘তৃণমূল চুরমার হয়ে যাবে, বিজেপিও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে’’, টুইটারে ফের বিস্ফোরক তথাগত
এর পরই ঘটে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বিদায় নেওয়ার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ৷ এবার গ্রুপ ছাড়েন শান্তনু ঠাকুর (Union MoS Santanu Thakur) ৷ তিনি বনগাঁর সাংসদ৷ তার উপর কেন্দ্রে বন্দর, জাহাজ ও জলপথ পরিবহণের রাষ্ট্রমন্ত্রী ৷ এছাড়া তাঁর আরও একটা পরিচয়, তিনি মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি ৷ এর পরই তিনি দলের চার মতুয়া বিধায়কের সঙ্গে বৈঠক করেন ৷ তার পর নিজের দাবি দলের কাছে তুলে ধরেন ৷ সেই দাবির মধ্যে রয়েছে, বিজেপির নবদ্বীপ, বনগাঁ ও নদীয়া সাংগঠনিক জেলার পদাধিকারীদের বদল করতে হবে ৷ আর সম্পাদক ও সহ-সভাপতিদের তালিকায় মতুয়াদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে ৷
মতুয়ারা হল হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ ৷ বাংলাদেশের ফরিদপুরে এই মতুয়া মহাসঙ্ঘের (Matua Mahasangha) প্রতিষ্ঠা করেন হরিচাঁদ ঠাকুর ৷ পরে তিনি চলে আসেন উত্তর 24 পরগনার ঠাকুরনগরে ৷ মতুয়ারা মূলত নমঃশূদ্র৷ তাঁরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে এসে বসবাস শুরু করেন ৷ ভারতে দু’কোটির মতো মতুয়া থাকেন বলে জানা যায় ৷ যদি মহাসঙ্ঘের দাবি, ভারতে পাঁচ কোটি মতুয়া রয়েছেন ৷ আর এই পার্থক্যের কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে শরণার্থী হওয়ায় অনেকের নাম ভোটার তালিকায় নেই ৷ কিন্তু তা নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ অথবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ওই অংশের মানুষকে নিজেদের পক্ষে টানা থেকে বিরত করতে পারেনি ৷ যদিও এই মহাসঙ্ঘই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংক্রান্ত তিনটি লোকসভা আসন ও অন্তত চার ডজন বিধানসভা আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করে ৷
আরও পড়ুন : Tathagata Roy slams BJP leaders : কলকাতা পৌরভোটে ভরাডুবি, বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বকে ‘একহাত’ নিলেন তথাগত
তার পর বঙ্গ-বিজেপির অস্বস্তি বাড়িয়েছেন হিরণ্ময় চট্টোপাধ্যায় ৷ অভিনেতা থেকে নেতা হওয়া খড়গপুরের বিধায়ক হিরণ (Hiran Chatterjee) মেদিনীপুরের একমাত্র গেরুয়া জনপ্রতিনিধি ৷ তিনি তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে আসেন বিধানসভা ভোটের আগে ৷ তার আগে তৃণমূলের যুব সংগঠনে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ৷ খড়গপুরে তিনি হারান তৃণমূলের বিধায়ক প্রদীপ সরকারকে ৷
কিন্তু তার পরও তাঁর সঙ্গে মেদিনীপুরের সাংসদ তথা বঙ্গ-বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষের (Bengal BJP Former President Dilip Ghosh) দূরত্ব সর্বজনবিদিত ছিল ৷ এবার তিনিও বিজেপির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়েছেন ৷ আর তৃণমূলে ফেরার ইঙ্গিতও দিয়েছেন ৷
তাহলে বিজেপির বঙ্গ-নেতৃত্ব দলের অন্দরের অসন্তোষ থামাতে ব্যর্থ ? দলের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বিএল সন্তোষ, এমনকী জাতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার বারবার হস্তক্ষেপও কি পরিস্থিতি শান্ত করতে পারছে না ? নাকি দলের পুরনো কর্মীদের উপর ও সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠদের উপর ভরসা না করে দলবদলুদের উপর ভরসা করার খেসারত দিচ্ছে বিজেপি ? বাংলায় গেরুয়া শিবিরের ভাগ্য কাদের হাতে, তা কার্যত অধরাই থেকে যাচ্ছে (bengal bjp current situation is not well for organisation) ৷
আরও পড়ুন : MLA Swapan Majumder on Shantanu Thakur : শান্তনুর বক্তব্যের বিরোধিতায় মতুয়া বিধায়ক