কলকাতা, 7 অগাস্ট : এই মিল্লি আল আমিন কলেজই তাঁদের 'কাছাকাছি' এনেছিল ৷ সময় যত এগিয়েছে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গীতে পরিণত হয়েছেন বৈশাখি বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ এ বার সেই আল আমিন কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছাড়লেন বৈশাখি ৷ ছাড়লেন কলেজের চাকরিও ৷ চাকরি ছাড়ার মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন ৷ তুললেন চক্রান্তের অভিযোগ ৷ আজ নিজের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করার সময় রীতিমতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন বৈশাখি ৷ সংবাদমাধ্যমের সামনে কেঁদেও ফেলেন ৷
আজ সাংবাদিক বৈঠক করে বৈশাখি দাবি করেন, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কাজ করা হচ্ছে ৷ পুরো কাজটাই করা হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে ৷ এর পরই অধ্যাপিকার অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রীকে এমন কাজ করতে নাকি নির্দেশ দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ অধ্যাপিকার অভিযোগ, এর আগেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার চেষ্টা করা হয়েছিল ৷ যদিও সে সময় ভাগ্যক্রমে গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন বলেও দাবি করেন বৈশাখি ৷ এমন কী, শোভনকে তৃণমূলে ফেরানোর জন্য পার্থ শর্ত দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন বৈশাখি৷ তাঁর অভিযোগ, অধ্যক্ষের পদ ছাড়ার জন্য পার্থ নাকি শর্ত দিয়েছিলেন বৈশাখিকে ৷ এমন কী, সোশাল মিডিয়ায় ভিডিয়ো ছড়ানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন বৈশাখি ৷ আজ যখন নিজের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করছেন বৈশাখি, তখন পাশে বসে শোভন চট্টোপাধ্যায় ৷ যদি একটি কথা শোনা যায়নি শোভনের মুখ থেকে ৷
বছর খানেকের বেশি সময় ধরে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈশাখি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেলামেশা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনার অন্ত নেই ৷ পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে, শেষ পর্যন্ত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ বৈশাখির সঙ্গ না ছাড়লে শোভনের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপের কথাও শোনা গেছিল মুখ্যমন্ত্রীর গলায় ৷ ইতিমধ্যেই মন্ত্রী-মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করেন শোভন ৷ ফাটল ক্রমেই বাড়তে থাকে দিদি-কানন সম্পর্কে ৷ রটতে শুরু করেছিল, তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরের দিকে পা বাড়াতে চলেছেন শোভন ৷
লোকসভা ভোটে দলের খারাপ ফলের পরই ক্ষত মেরামতের চেষ্টা শুরু হয় ৷ পার্থ চট্টোপাধ্যায় বার কয়েক দেখা করেন শোভনের সঙ্গে ৷ সূত্রের খবর, সে সময় বৈশাখিও ছিলেন সেখানে ৷ আজ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হলেও অনেকটাই শান্ত দেখাল তাঁকে ৷ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন শিক্ষামন্ত্রী ৷ কোনও সমস্যা হলে আলোচনার মাধ্যমে তা মেটানোর কথাও বলেন তিনি ৷ পার্থর কথায়, "মাথা ঠান্ডা করুন । যত দিন আল আমিন কলেজে আছেন নিয়ম মেনে চালান । শিক্ষা দপ্তর কেন হস্তক্ষেপ করতে যাবে ।
শুধু শুধু সাম্প্রদায়িক তাস খেলা ঠিক হচ্ছে না ।" উত্তেজনার মধ্যে কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য বৈশাখিকে অনুরোধও জানান শিক্ষামন্ত্রী ৷ শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে পার্থ বলেন, "দাদা হিসেবে ভাইকে বলেছিলাম সক্রিয় হতে । শোভনকে সক্রিয় করতে গেছিলাম৷"
নানা সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শোভনের সঙ্গে বৈশাখির প্রথম যোগাযোগ মিল্লি আল আমিন কলেজে গোলমালের সূত্রেই । শোভন তখন মেয়র । বৈশাখি তার আগে থেকেই ওই কলেজের শিক্ষক । তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ দিন মনোজিৎবাবু ও বৈশাখির পরিচিত । স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করিয়ে দেওয়ার জন্য কল্যাণবাবু বৈশাখিকে শোভনের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন । সেই যোগাযোগ খুব বেশি দূর এগোয়নি । বরং কিছুটা আড়ষ্টতাই ছিল । বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনা সভায় প্রয়োজনে বৈশাখি মেয়র হিসেবে শোভনের সমালোচনাও করতেন । সেই সময় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈশাখির যোগাযোগ ছিল বেশি ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রেসিডেন্সির স্নাতক এবং যাদবপুরে স্নাতকোত্তর ও Ph.D বৈশাখি । পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর বৈশাখি তৃণমূলের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন । মিল্লি আল আমিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষও করা হয় তাঁকে । তখনও তিনি শোভনের এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন না ।
সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভরতি থাকাকালীন বৈশাখি তাঁকে দেখতে যান । নোট বাতিল নিয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে তৃণমূলের বিক্ষোভ মঞ্চ এই দু'জনকে কাছে আনল । ধাপে ধাপে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল । বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করলেন শোভন । বৈশাখিকে বললেন তাঁর 'দুর্দিনের বন্ধু' ।
যোগাযোগ এতটাই নিবিড় হয়ে ওঠে যে, কলকাতা, দিল্লি সর্বত্র শোভনের সঙ্গে ছায়াসঙ্গীর মতো দেখা যায় বৈশাখিকে । শোভনের আইনগত যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন বৈশাখি । শোভন পরিবেশমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে জলাভূমি সংক্রান্ত একটি কমিটির সদস্যও করে নেন । শোভনের গোলপার্কের ফ্ল্যাটে যে কোনও সময়ে বৈশাখির গতিবিধি অবাধ ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৃণমূলের অধ্যাপক সংগঠনের পদ থেকে বৈশাখিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে । শোভন পরিবেশ দপ্তর হারানোর পর সেখানকার কমিটিতেও বৈশাখি আর নেই । আর এ বার অধ্যক্ষের পদ থেকেও সরে গেলেন বৈশাখি ৷
এখন প্রশ্ন একটাই, তৃণমূলের থেকে কি ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে শোভন-বৈশাখির? তৃণমূলের সঙ্গ ছেড়ে কি গেরুয়া শিবিরের দিকে পা বাড়াতে চলেছেন এই দু'জন?