ETV Bharat / bharat

75 Years of Independence: নেতাজির লক্ষ্মী-মাস্টারদার প্রীতি, স্বাধীনতার ইতিহাসে রামায়ণের ঊর্মিলারা

দোরগোড়ায় দেশের 75তম স্বাধীনতা দিবস (75 Years of Independence) ৷ বহু লড়াই-সংগ্রামের পর 1947 সালের 15 অগস্ট যে চারাগাছ মাথা তুলেছিল আজ তা 75 বছরের মহীরূহ ৷ কিন্তু, সেই চারাগাছে জল, আলো পৌঁছেছিলেন যারা, তাঁরা কতটা সমাদৃত ?

Independence day Special
Independence day Special
author img

By

Published : Aug 10, 2022, 1:24 PM IST

Updated : Aug 10, 2022, 8:03 PM IST

কলকাতা, 10 অগস্ট: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ডাকে লক্ষ্মী সেহগাল আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী ব্রিগেড 'ঝাঁসির রানি'র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশ থেকে বিতাড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতেও অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। উদ্বাস্তু শিবির পরিচালনাসহ কলকাতায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের চিকিৎসা, সবেতেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন । মাস্টারদার দলেও ছিলেন এরকমই এক বীরাঙ্গনা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ৷ ঝাঁসীর রানির বীরত্বের গল্প শুনেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন অকুতোভয় ৷ সূর্য সেনের এককথায় লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছিলেন তুখোড় ছাত্রী ৷ দু'জনকেই স্বচ্ছন্দে তুলনা করা যায় রামায়ণের ঊর্মিলার সঙ্গে (Remembering Lakshmi Sahgal-Pritilata Waddedar) ।

ঊর্মিলা ! রামের অনুজ লক্ষ্মণের স্ত্রী । রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনবাসকালে অযোধ্যায় একাকী কাটিয়েছেন ৷ অপেক্ষা করেছেন তাঁদের জন্য। সরাসরি যুদ্ধে অংশ না-নিলেও মহাকাব্যে তাঁর ভূমিকাও অপরিসীম । অথচ সীতাকে নিয়ে রামায়ণে যে বন্দনা, তার সিকিভাগও জোটেনি ঊর্মিলার কপালে। গোটা রামায়ণেই তিনি উপেক্ষিতা। ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে এই মহীয়সী নারীরাও অনেকটা সেরকম । যদিও ঊর্মিলার মত তাঁরা নতুন ভোরের অপেক্ষাই শুধু করেননি, নেতৃত্ব দিয়েছেন রাতের যুদ্ধেও ।

Independence day Special
নারী রেজিমেন্ট গঠনের কথা বলেন সুভাষচন্দ্র বসু

লক্ষ্মী সেহগালের জন্ম 24 অক্টোবর, 1914 সালে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই)। 1938 সালে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এক বছর পর গাইনোকোলজি এবং অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যান এলাকার সরকারি কস্তুর্বা গান্ধি হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। সাবালিকা অবস্থা থেকেই সামনে থেকে দেখেছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। বিশেষত প্রাক-স্বাধীনতা আন্দোলন সেই সময় সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে। ক্রমশ বাড়ছে ইংরেজদের অত্যাচার ! পাল্লা দিয়ে শহিদ হচ্ছেন দেশের একের পর এক সন্তান। ফলে, দেশসেবার বীজ তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল প্রায় শিশুকালেই। যদিও তা বৃক্ষের আকার নিল ভারতবর্ষের মাটিতে নয়, সিঙ্গাপুরে।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতার 75 বছর স্মরণে বিজ্ঞানের তিন তারা

1940 সালে সিঙ্গাপুরে সাক্ষাৎ হয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’র ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে। সেখানে ভারতবর্ষ থেকে আসা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে একটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। শুরু হয় ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। এর তিনবছর পর 1943 সালে সিঙ্গাপুর যান স্বয়ং নেতাজি। প্রস্তুতি শুরু করেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অভ্যুত্থানের। শুধু পুরুষরা নন, যাতে অংশ নিয়েছিল বহু মহিলারাও। এই প্রস্তুতিকালেই নারী রেজিমেন্ট গঠনের কথা বলেন সুভাষচন্দ্র বসু। লক্ষ্মী সেহগাল বিষয়টি শোনেন ৷ রেজিমেন্টের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন ৷ পরিচিত হন ‘ক্যাপ্টেন’ লক্ষ্মী সেহগাল নামে। পরে তাঁর এবং নেতাজির এই নারী বাহিনীই পরিচিতি পায় বিখ্যাত ঝাঁসির রাণী বাহিনী নামে। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল 1945 সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তী একবছর বার্মায় কারাগারে আটক ছিলেন। দিল্লিতে আইএনএ সদস্যদের বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন।

Independence day Special
সূর্য সেনের এককথায় লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছিলেন তুখোড় ছাত্রী

অন্যদিকে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ৷ স্কুলের প্রিয় শিক্ষিকা ঊষাদির 'ঝাঁসির রানি' বইটি পড়ে রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের জীবনী তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে । ততদিনে তাঁর মনে জায়গা করে নিয়েছেন মাস্টারদা ৷ তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী প্রীতিলতা । লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়ে ফেলেছেন 'দেশের কথা', 'বাঘা যতীন', 'ক্ষুদিরাম' আর 'কানাইলাল'। যদিও তারপরেই পড়াশোনা করতে কলকাতায় পাড়ি দেন ৷ 1930 সালে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে আসেন । দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র । 1932 সালে ডিসটিংশান নিয়ে বি.এ পাশ করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাশগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয় ।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতার 75 বছরে ফিরে দেখা সংগ্রামীদের ইতিহাস

ততদিনে ব্রিটিশ-মুক্তকরণের বীজ বপণ হয়ে গিয়েছে প্রীতিলতার বুকে ৷ অবশেষে মুখোমুখি হলেন প্রিয় মাস্টারদার ৷ 1932 সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন সূর্য সেন । এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলেন মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর । ইউরোপিয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন । তথ্য বলছে তিনিই প্রথম মহিলা বিপ্লবী যিনি দেশের জন্য শহিদ হয়েছিলেন ৷

1947 সালে লক্ষ্মী সেহগাল ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের স্বপ্ন সফল হয় ৷ স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ । সেই বছরেই লাহোরে কর্ণেল প্রেম সেহগালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লক্ষ্মী । বিয়ের পরেও সেবার কাজ থামাননি তিনি ৷ কানপুরে গড়ে তোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় । 1984 সালের ডিসেম্বরে ভূপালের গ্যাস দূর্ঘটনায় চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন। সেই বছরেই শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে জনসংযোগ করেন । 2002 সালে চারটি বামপন্থী দল তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনিত করে ৷ তবে তিনি এপিজে আব্দুল কালামের কাছে পরাজিত হন। 2012 সালের 19 জুলাই ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চারদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর প্রয়াণ ঘটে এই মহীয়সী নারীর । একই সঙ্গে কী আশ্চর্য সমাপতন ! সেই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে ৷ এই ডিগ্রি অর্জনে এসেই দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এক অষ্টাদশী ৷ পরাধীনতার গ্লানি মুছতে রক্তে রাঙিয়েছিলেন তেরঙ্গাকে ৷

স্বাধীনতার আন্দোলনে শহিদ হওয়া বিভিন্ন বিপ্লবীর কথা আমরা ইতিহাসে পড়ি ৷ তাঁদের বীরগাঁথা স্মরণও করি বিশেষ বিশেষ দিনে । প্রীতিলতা শহিদ হয়েছিলেন ৷ কিন্তু, এক বীরাঙ্গনাকে সামনে পেয়েও সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে দেশ। অনেকের মতে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়েই রাজনৈতিক বিভিন্ন নেতার বিরাগভাজন হয়েছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল । বিস্মৃত অতলে তলিয়ে গিয়েছেন প্রীতিলতাও ৷ ফলে সীতা নন, স্বাধীনতার ইতিহাসে ঊর্মিলা হয়েই রয়ে গিয়েছেন দেশের দুই মহীয়সী নারী ।

কলকাতা, 10 অগস্ট: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ডাকে লক্ষ্মী সেহগাল আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী ব্রিগেড 'ঝাঁসির রানি'র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশ থেকে বিতাড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতেও অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। উদ্বাস্তু শিবির পরিচালনাসহ কলকাতায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের চিকিৎসা, সবেতেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন । মাস্টারদার দলেও ছিলেন এরকমই এক বীরাঙ্গনা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ৷ ঝাঁসীর রানির বীরত্বের গল্প শুনেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন অকুতোভয় ৷ সূর্য সেনের এককথায় লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছিলেন তুখোড় ছাত্রী ৷ দু'জনকেই স্বচ্ছন্দে তুলনা করা যায় রামায়ণের ঊর্মিলার সঙ্গে (Remembering Lakshmi Sahgal-Pritilata Waddedar) ।

ঊর্মিলা ! রামের অনুজ লক্ষ্মণের স্ত্রী । রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনবাসকালে অযোধ্যায় একাকী কাটিয়েছেন ৷ অপেক্ষা করেছেন তাঁদের জন্য। সরাসরি যুদ্ধে অংশ না-নিলেও মহাকাব্যে তাঁর ভূমিকাও অপরিসীম । অথচ সীতাকে নিয়ে রামায়ণে যে বন্দনা, তার সিকিভাগও জোটেনি ঊর্মিলার কপালে। গোটা রামায়ণেই তিনি উপেক্ষিতা। ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে এই মহীয়সী নারীরাও অনেকটা সেরকম । যদিও ঊর্মিলার মত তাঁরা নতুন ভোরের অপেক্ষাই শুধু করেননি, নেতৃত্ব দিয়েছেন রাতের যুদ্ধেও ।

Independence day Special
নারী রেজিমেন্ট গঠনের কথা বলেন সুভাষচন্দ্র বসু

লক্ষ্মী সেহগালের জন্ম 24 অক্টোবর, 1914 সালে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই)। 1938 সালে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এক বছর পর গাইনোকোলজি এবং অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যান এলাকার সরকারি কস্তুর্বা গান্ধি হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। সাবালিকা অবস্থা থেকেই সামনে থেকে দেখেছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। বিশেষত প্রাক-স্বাধীনতা আন্দোলন সেই সময় সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে। ক্রমশ বাড়ছে ইংরেজদের অত্যাচার ! পাল্লা দিয়ে শহিদ হচ্ছেন দেশের একের পর এক সন্তান। ফলে, দেশসেবার বীজ তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল প্রায় শিশুকালেই। যদিও তা বৃক্ষের আকার নিল ভারতবর্ষের মাটিতে নয়, সিঙ্গাপুরে।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতার 75 বছর স্মরণে বিজ্ঞানের তিন তারা

1940 সালে সিঙ্গাপুরে সাক্ষাৎ হয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’র ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে। সেখানে ভারতবর্ষ থেকে আসা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে একটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। শুরু হয় ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। এর তিনবছর পর 1943 সালে সিঙ্গাপুর যান স্বয়ং নেতাজি। প্রস্তুতি শুরু করেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অভ্যুত্থানের। শুধু পুরুষরা নন, যাতে অংশ নিয়েছিল বহু মহিলারাও। এই প্রস্তুতিকালেই নারী রেজিমেন্ট গঠনের কথা বলেন সুভাষচন্দ্র বসু। লক্ষ্মী সেহগাল বিষয়টি শোনেন ৷ রেজিমেন্টের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন ৷ পরিচিত হন ‘ক্যাপ্টেন’ লক্ষ্মী সেহগাল নামে। পরে তাঁর এবং নেতাজির এই নারী বাহিনীই পরিচিতি পায় বিখ্যাত ঝাঁসির রাণী বাহিনী নামে। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল 1945 সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তী একবছর বার্মায় কারাগারে আটক ছিলেন। দিল্লিতে আইএনএ সদস্যদের বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন।

Independence day Special
সূর্য সেনের এককথায় লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছিলেন তুখোড় ছাত্রী

অন্যদিকে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ৷ স্কুলের প্রিয় শিক্ষিকা ঊষাদির 'ঝাঁসির রানি' বইটি পড়ে রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের জীবনী তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে । ততদিনে তাঁর মনে জায়গা করে নিয়েছেন মাস্টারদা ৷ তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী প্রীতিলতা । লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়ে ফেলেছেন 'দেশের কথা', 'বাঘা যতীন', 'ক্ষুদিরাম' আর 'কানাইলাল'। যদিও তারপরেই পড়াশোনা করতে কলকাতায় পাড়ি দেন ৷ 1930 সালে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে আসেন । দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র । 1932 সালে ডিসটিংশান নিয়ে বি.এ পাশ করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাশগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয় ।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতার 75 বছরে ফিরে দেখা সংগ্রামীদের ইতিহাস

ততদিনে ব্রিটিশ-মুক্তকরণের বীজ বপণ হয়ে গিয়েছে প্রীতিলতার বুকে ৷ অবশেষে মুখোমুখি হলেন প্রিয় মাস্টারদার ৷ 1932 সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন সূর্য সেন । এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলেন মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর । ইউরোপিয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন । তথ্য বলছে তিনিই প্রথম মহিলা বিপ্লবী যিনি দেশের জন্য শহিদ হয়েছিলেন ৷

1947 সালে লক্ষ্মী সেহগাল ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের স্বপ্ন সফল হয় ৷ স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ । সেই বছরেই লাহোরে কর্ণেল প্রেম সেহগালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লক্ষ্মী । বিয়ের পরেও সেবার কাজ থামাননি তিনি ৷ কানপুরে গড়ে তোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় । 1984 সালের ডিসেম্বরে ভূপালের গ্যাস দূর্ঘটনায় চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দেন। সেই বছরেই শিখবিরোধী দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে জনসংযোগ করেন । 2002 সালে চারটি বামপন্থী দল তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনিত করে ৷ তবে তিনি এপিজে আব্দুল কালামের কাছে পরাজিত হন। 2012 সালের 19 জুলাই ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগাল হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চারদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর প্রয়াণ ঘটে এই মহীয়সী নারীর । একই সঙ্গে কী আশ্চর্য সমাপতন ! সেই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে ৷ এই ডিগ্রি অর্জনে এসেই দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এক অষ্টাদশী ৷ পরাধীনতার গ্লানি মুছতে রক্তে রাঙিয়েছিলেন তেরঙ্গাকে ৷

স্বাধীনতার আন্দোলনে শহিদ হওয়া বিভিন্ন বিপ্লবীর কথা আমরা ইতিহাসে পড়ি ৷ তাঁদের বীরগাঁথা স্মরণও করি বিশেষ বিশেষ দিনে । প্রীতিলতা শহিদ হয়েছিলেন ৷ কিন্তু, এক বীরাঙ্গনাকে সামনে পেয়েও সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে দেশ। অনেকের মতে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়েই রাজনৈতিক বিভিন্ন নেতার বিরাগভাজন হয়েছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল । বিস্মৃত অতলে তলিয়ে গিয়েছেন প্রীতিলতাও ৷ ফলে সীতা নন, স্বাধীনতার ইতিহাসে ঊর্মিলা হয়েই রয়ে গিয়েছেন দেশের দুই মহীয়সী নারী ।

Last Updated : Aug 10, 2022, 8:03 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.