কলকাতা, 2 ডিসেম্বর : ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরি নির্ণায়নের চারটি ক্ষেত্রীয় মাপকাঠি রয়েছে । এই চারটি ক্ষেত্র হল কৃষিক্ষেত্র (General Agriculture Workers), উদ্যানপালন ক্ষেত্র (Horticulture Workers), নির্মাণশিল্প ক্ষেত্র (Construction Workers) এবং অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্র (Other Non-Agricultural Workers) । রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (Reserve Bank of India) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একমাত্র উদ্যানপালন ক্ষেত্র ছাড়া বাকি তিন ক্ষেত্রীয় মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম ।
সম্প্রতি "Handbook of statistics on Indian States, 2020-21" নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ৷ রিপোর্টে শেষ আর্থিক বছর 2020-21 পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণের উপর বিশদ পরিসংখ্যান দেওয়া আছে । সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 2020-21 আর্থিক বছরে উদ্যানপালনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল 335.70 টাকা ৷ যা জাতীয় গড় 309.10 টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি । 2019-20 আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ছিল 339.10 টাকা । অর্থাৎ 2020-21 আর্থিক বছরে জাতীয় গড়ের থেকে এগিয়ে থাকলেও পরিমাণটি এর আগের আর্থিক বছরের তুলনায় কমেছে।
আরও পড়ুন : Mamata at Mumbai YPO Summit : মুম্বইয়ের সম্মেলনে বাংলায় বিনিয়োগের আহ্বান মমতার
2020-21 আর্থিক বছরে কৃষিক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল 288.60 টাকা ৷ যা জাতীয় গড় 309.90 টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা কম । যদিও 2019-20 আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরির পরিমাণ ছিল 267.50 টাকা । এই ক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বামশাসিত রাজ্য কেরালাতে, যেখানে দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল 706.50 টাকা ।
নির্মাণশিল্পর ক্ষেত্রে 2020-21 আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল 300.20 টাকা ৷ যা জাতীয় গড় 340.70 টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা কম । যদিও এই ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির পরিমাণ এর আগের 2019-20 আর্থিক বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে । 2019-20 আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরির পরিমাণ ছিল 290.50 টাকা । এই ক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি কেরালাতে ৷ যেখানে দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল 829.70 টাকা ।
আরও পড়ুন : Governor on KMC Election 2021 : কলকাতার ভোটে কি দায়িত্বে কেন্দ্রীয় বাহিনী, রাজ্যপালের টুইট ঘিরে জল্পনা
অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্রে 2020-21 আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ 305.8 টাকা ৷ যা জাতীয় গড় 315.30 টাকার তুলনায় কিছুটা কম । যদিও 2020-21আর্থিক বছরে এই ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির পরিমাণ এর আগের 2019-20 আর্থিক বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে । 2019-20 আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরি ছিল 291.10 টাকা । অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি কেরালাতে, 677.60 টাকা ।
এই প্রসঙ্গে ইটিভি ভারত একাধিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে । তাঁদের প্রত্যেকের গলাতেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে উদ্বেগের সুর শোনা গিয়েছে ।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ কুণাল বোস বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রতি কৃষিজমির মালিকদের হাতে জমির পরিমাণ এতটাই কম, চাষ করে কৃষি শ্রমিকদের বেতন দেবার মতো পর্যাপ্ত টাকা তাঁদের হাতে থাকে না । ঠিক সেই কারণেই এই রাজ্যে কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এত কম । আর ঠিক একই কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঠিক করে হচ্ছে না । তাই অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন অকৃষি ক্ষেত্র এবং নির্মাণশিল্প ক্ষেত্রেও গ্রামীণ বাংলায় দৈনিক মজুরি কম । রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির পক্ষে যা খুবই উদ্বেগজনক বিষয় ৷’’
আরও পড়ুন : SSC Group C Recruitment Case : 350 জনের নথি খতিয়ে দেখে চারদিনের মধ্যে বেতন বন্ধের নির্দেশ হাইকোর্টের
অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জন দে ইটিভি ভারতকে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে হবে যাতে গ্রামীণ বাংলার এই বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি জাতীয় গড়ের অন্তত কিছুটা কাছাকাছি আনা যায় । কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে সরকার এর আগে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়নি । এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে কয়েক বছরের মধ্যেই এর সুফল আমরা দেখতে পাই ৷’’
প্রাক্তন সাংবাদিক এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ শান্তনু সান্যাল বলেন, ‘‘কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে যেটা প্রাথমিক দরকার সেটা হল সরকারের নিয়মিত তদারকি । সেই নিয়মিত তদারকি না থাকলে ন্যূনতম মজুরিও নিশ্চিত হবে না ৷ সেইসঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়ন না হলে কৃষির উন্নতি হবে না এবং বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশও হবে না ৷’’
এই ঘটনায় ইটিভি ভারত যোগাযোগ করে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নার সঙ্গে । তিনি জানিয়েছেন যে, বহু ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় রিপোর্টের মিল থাকে না ৷ বাম আমলের তুলনায় তৃণমূল সরকারের আমলে কৃষকদের আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে । অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের জন্য বর্তমান সরকার একাধিক প্রকল্প নিয়ে এসেছে । এমনকি লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদেরও পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁদের সরকার । তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে শ্রমজীবী মানুষদের অবস্থা জাতীয় ক্ষেত্রের থেকে খারাপ, একথা ঠিক নয় । বরং 100 দিনের কাজ থেকে শুরু করে প্রতিক্ষেত্রেই আমরা প্রশংসিত । ডেইলি ওয়েজের ক্ষেত্রেও চা শ্রমিকদের আয় বেড়েছে এই সরকারের আমলে । আপনারা কিসের ভিত্তিতে এসব বলছেন আমার জানা নেই । তবে বর্তমান সময়ে আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান রয়েছে তাতে এটাই বলতে পারি এই বক্তব্য সত্যি নয় ।’’