একাধিক কারণে প্রতি বছর মানসিক অসুস্থতার সংখ্যা বাড়তেই থাকে । কিন্তু এর মধ্যে অন্যতম নির্দিষ্ট এবং সঙ্গত কারণ যা মানসিক স্বাস্থে্যর উপর এবার প্রভাব ফেলেছে, তা হল কোভিড 19 প্যানডেমিক । এই রোগের সংক্রমণের ভয় থেকে শুরু করে বেকারত্ব, আর্থিক সংকট এবং মহামারির জেরে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা প্রভৃতি সব কিছুই বিশ্বে প্রায় প্রতে্যককেই অবসাদ, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপে ভুগতে বাধ্য করেছে । একই সময়ে আবার নির্দিষ্ট কিছু নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় আক্রান্ত যাঁরা, যেমন পারকিনসন্স, আলঝাইমার্স, ডেমেনশিয়া প্রভৃতি, তাঁরাও প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন লকডাউনে অপর্যাপ্ত ওষুধের যোগানের কারণে । এছাড়াও, দাম্পত্য কলহ এবং গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনাও সামনে এসেছে এবং মানুষ মনোবিদের কাছে ছুটে গিয়েছেন সাহায্য চেয়ে । সুতরাং, এখানে তেমনই কিছু মানসিক অবস্থার উল্লেখ করা হল যা এ বছর মানুষকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছে।
মানসিক চাপ এবং অবসাদের ঘটনার বাড়বাড়ন্ত
চলতি বছরের গোড়া থেকে, যখনই কোভিড 19-এর প্রকোপ শুরু হয়েছিল, সংক্রমণের ঘটনা বাড়তে শুরু করে দেয় এবং দেশগুলি লকডাউনের আওতায় চলে যায় । মানুষের মধে্য স্বাস্থ্য এবং আর্থিক অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ ক্রমশ বাড়তে থাকে । এছাড়াও লকডাউনের সময়, যখন কারও বাইরে বেরোনোর অনুমতি ছিল না, মানুষ ভাবতে শুরু করে যেন তারা জেলে আটকে রয়েছে । এই সব কিছুর জেরেই মানুষের মধে্য অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দ্রুত অনেকটা বেড়ে যায় ।
যারা ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের অনেকের মধে্যও অবসাদের বাড়বাড়ন্ত দেখা গিয়েছে । ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, কোভিড 19 আক্রান্তদের অন্তত 30 শতাংশই অবসাদ এবং উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগেছেন । এছাড়াও যেহেতু মানুষকে কার্যত বাধ্য করা হয়েছিল বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকতে, তাই তাদের সকলের মধে্যই অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়ার জেরে পারিবারিক কলহ এবং গার্হস্থ্য হিংসা বেড়ে গিয়েছিল । এটাও মানুষের মধে্য মানসিক চাপ এবং অবসাদ বৃদ্ধি করেছিল ।
আশ্চর্য্যজনকভাবে, শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্করাই নয়, শিশুরাও উদ্বেগ এবং অবসাদের শিকার হয়েছিল । স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, অনলাইনে ক্লাস করা, জোর করে সারাক্ষণ বাড়িতে থাকতে বাধ্য করার ফলে তাদের মধে্য উদ্বেগ, অস্থিরতা, চাপ বেড়ে যাওয়া, অবসাদ প্রভৃতি দেখা দেয় । সেই পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর ছিল যে বহু রাজ্য সরকার উদে্যাগী হয়ে শিশুদের জন্য অনলাইনে কাউন্সিলিং সেশন শুরু করে ।
আরও পড়ুন: আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর খাবারদাবার কীভাবে প্রভাব ফেলে?
আত্মহত্যার ঘটনার বৃদ্ধি
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে অন্তত 8 লাখ মানুষ এবং আমাদের দেশে অন্তত 2-3 লাখ মানুষ প্রতি বছর সুইসাইড করেন । কিন্তু এ বছর আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে । এর কারণ অবসাদ, আশাহীনতা এবং অনিশ্চয়তা, যা বয়স নির্বিশেষে যে কোনও মানুষের মধে্যই আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা উসকে দিয়েছে এবং এই তালিকায় কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের তারকারাও রয়েছেন । সুইসাইডের সংখ্যায় এই বৃদ্ধি দেখে রাজ্য তথা জাতীয় স্তরে অনেক মনোবিদই একজোট হয়ে, মানুষকে অনলাইন কাউন্সিলিং এবং মনো চিকিৎসাজনিত পরামর্শ দিতে এগিয়ে এসেছেন যাতে তারা আত্মঘাতী হওয়ার তাড়ণা ত্যাগ করতে পারে ।
আগের থেকেও পরিস্থিতি খারাপ
অনেক দেশে পুরোপুরি লকডাউন চলছে, আর তারই ফলে যাঁরা অ্যালঝাইমার্স, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ডেমেনশিয়া এবং পারকিনসনস-এর মতো রোগে ভুগছেন, তাঁরা অনেক বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন ওষুধপত্র এবং অন্যান্য চিকিৎসা পরিষেবা না মেলার কারণে । এর সঙ্গে আবার, মনোচিকিৎসাজনিত প্রতিষ্ঠানগুলির বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ওষুধপত্রের অপর্যাপ্ত যোগান প্রভৃতির জেরে মানসিক চিকিৎসায় আক্রান্ত যাঁরা, তাঁদের যথাযথ চিকিৎসায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে ।
অনিদ্রার সমস্যায় বৃদ্ধি হয়েছে
বাড়িতে, কাজের জায়গায় এবং ব্যক্তিগত জীবনে বর্ধিত মানসিক চাপই বয়স নির্বিশেষে অনেক মানুষের অনিদ্রার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা 10 শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে 33 শতাংশ, যা তিনগুণেরও বেশি ।
আরও পড়ুন: কোভিড 19 বাড়াচ্ছে মানসিক চাপ, জেনে নিন কীভাবে ভালো থাকবেন
ভয়ভীতি বেড়েছে
এই বছর বিরূপ পরিস্থিতির কারণে, মানুষ আরও বেশি ভীতিপ্রবণ হয়ে পড়েছে এবং তাদের মধে্য নানা ধরনের ফোবিয়া তৈরি হয়েছে, তা সে ব্যবহারের আগে সব কিছু স্যানিটাইজ করার ফোবিয়াই হোক বা বাড়ির বাইরে যাওয়ার ভয় । রোগটি যেহেতু বিপজ্জনক, তাই মানুষ আগের তুলনায় এখন আরও বেশি ভয় পাচ্ছে ।
সুতরাং এই বছর প্রায় সকলেই এক বা একাধিক মানসিক সমস্যার শিকার হয়েছে তা সে মৃদু হোক বা গুরুতর পর্যায়ে । মানুষ সব কিছু পরিষ্কার করা এবং বার বার স্যানিটাইজ করার প্রতিও অতি উন্মুখ হয়ে পড়েছে কারণ তারা নিশ্চিত করতে চায়, কোনওভাবেই যাতে ভাইরাস ঘরে প্রবেশ না করে । এমনকী, বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পরও অনেকেই বাড়িতে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করেছে, যার ফলে তারা একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেছে এবং অলস, জবুথবু হয়ে পড়েছে । যদিও আশা করা যায়, 2021 সাল অনেকটাই আনন্দ-উল্লাসে পরিপূর্ণ থাকবে ।