মালদা, 12 মে : মালদাকে সবাই চেনেন আমের দেশ হিসাবে । কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না, এই জেলায় লিচুর চাষ ও মান যথেষ্ট ভাল ৷ এবার সেই লিচুই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে । ইতিমধ্যেই ভূমধ্যসাগরীয় বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ইউরোপের দু’একটি দেশ থেকেও লিচু রফতানির বরাত এসেছে । এখন তার প্রস্তুতি নিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ততা জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরে (Litchi of Malda is going to Export in Foreign Countries for the First Time)। জেলার লিচু বিদেশে রফতানি শুরু হলে এই জেলার অর্থনীতির মানচিত্রটাই বদলে যেতে পারে বলে মনে করছেন লিচু চাষি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা ।
মালদায় 1 হাজার 560 হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয় । কালিয়াচকের তিনটি ব্লকে লিচু চাষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । তবে এখন জেলার প্রায় প্রতিটি ব্লকেই কমবেশি লিচুর চাষ হচ্ছে । প্রতি বছর এই জেলায় লিচুর গড় উৎপাদন থাকে 15 হাজার 500 মেট্রিক টন । তবে এবার জেলায় লিচুর ফলন খুব ভাল হয়েছে । তাই চলতি মরশুমে লিচুর উৎপাদন আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিতে চলেছে বলেই মনে করছেন জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর সামন্ত লায়েক ।
আরও পড়ুন : Malda Fruit Cultivation : চায়না লিচু, লাল জামরুল, মাল্টা...মালদায় সাত নতুন ফলের চাষ
তিনি বলেন, "এই জেলায় আমের পরেই লিচুর স্থান । জেলার ফরাক্কা ব্যারেজ সংলগ্ন কালিয়াচকের তিনটি ব্লকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বোম্বাই জাতের লিচু উৎপাদন হয় । এই প্রজাতির লিচু অত্যন্ত উন্নতমানের । পাতলা খোসা, শাঁসও অনেক বেশি থাকে আর রসে ভরপুর । বাজারে এই লিচুর খুব ভাল চাহিদা রয়েছে । এই বেল্টের চাষ দেখে জেলার অন্যান্য ব্লকেও লিচু চাষ শুরু হয়েছে । বিশেষত চাঁচলের দুটি ও রতুয়ার দুটি ব্লকে ফুলহর নদীর বেসিনে বেশ ভাল লিচু চাষ হচ্ছে । লিচুর মুকুল সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে আসে । এই সময় 16 থেকে 22 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা মুকুলের পক্ষে উপযোগী । হালকা বৃষ্টি হলে মুকুলের আরও উপকার হয় । ফল ধরার সময় 24 থেকে 28 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উপযোগী । ফল পাকার সময় 27-28 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা থাকলে খুব ভাল হয় । এবার লিচু চাষের ক্ষেত্রে আবহাওয়া অনুকূল ছিল ৷"
আরও পড়ুন : মালদার আমে মজেছে ইংল্যান্ড-জার্মানি-ইতালি
লিচুর বিদেশ যাত্রা নিয়ে তাঁ বক্তব্য, "এবার আমরা প্রথম থেকেই আমের সঙ্গে জেলার লিচুও বিদেশে রফতানির জন্য চেষ্টা করছিলাম । তাতে সুফলও মিলেছে । ইতিমধ্যে কাতার, বাহারিনের মতো ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি দেশ এবং ইতালি, জার্মানির মতো কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশ থেকে 5-6 মেট্রিক টন লিচুর বরাত এসেছে । আর 15 দিনের মধ্যে লিচু গাছ থেকে পাড়া শুরু হয়ে যাবে । এর মধ্যেই আমরা রফতানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে বিদেশে লিচু রফতানির চেষ্টা চালাচ্ছি । আমাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় সংস্থা, সিআইএসএইচও এই কাজে সহযোগিতা করছে ৷ বিদেশে রফতানির আগে বেশ কয়েকদিন ভাল রাখতে লিচুকে সালফার ফিউমিগেশন করা হবে । আমরা আশাবাদী, এই জেলার লিচু পরবর্তীতে আরও অনেক দেশে পা রাখবে ।"
আরও পড়ুন : লিচু, আম থেকে ফুচকা; হরেক স্বাদের গরম চা...
কালিয়াচক 1 নম্বর ব্লকের খালতিপুর গ্রামের লিচু চাষি মহম্মদ আকিমুদ্দিন মোমিন বলেন, "আমি 12 বছর ধরে লিচু চাষ করছি । এই এলাকায় লিচুর ফলন বেশ ভাল হয় । এবার তো এখনও পর্যন্ত খুবই ভাল ফলন হয়েছে ৷ আমরা মূলত রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় লিচু বিক্রি করি । তবে খুব বেশি দাম পাই না তাতে । প্রতি হাজার লিচুর দাম 700-800 টাকার বেশি পাই না । চাষের খরচ আর গাড়ি ভাড়াতেই সব শেষ হয়ে যায় । হাতে তেমন কিছু থাকে না । শুনছি, এবার মালদার লিচু বিদেশে যাবে । তেমন হলে খুব ভাল হয় । আমরাও লিচুর ভাল দাম পাব । এলাকার অর্থনীতিও বদলে যাবে ।"
আরও পড়ুন : বংশীহারীতে বাড়ছে ড্রাগন ফল চাষ ; লিভারে উপকারী, বলছেন চিকিৎসকরা
একই বক্তব্য কালিয়াচকের লিচু চাষি মঞ্জুর মোমিনের । তিনি বলেন, "40 বছর ধরে লিচু চাষ করছি । কালিয়াচকের তিনটি ব্লকেই মূলত এই চাষ হয় । অনেক মানুষ এর সঙ্গে জড়িত । আমরা এখনও ভিনরাজ্যে লিচু বিক্রি করতে পারিনি । তবে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করি । প্রতি হাজার লিচুর দাম হাজার টাকার বেশি কখনও পাইনি । এই মরশুমে লিচুর ফলন খুব ভাল । বিঘায় দেড় লাখ লিচু হতে পারে । বিদেশে লিচু যাবে বলে শুনছি । তাহলে আমাদের মতো যারা লিচু চাষের উপর নির্ভর করি তাদের খুব ভাল হয় । তবে এখনও সরকারের তরফে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি ।"
আরও পড়ুন : Malda Mango Price : আমের ফলন কম তাই পকেট পুড়বে, আশঙ্কা মালদা উদ্যানপালন দফতরের
লিচুর বিদেশযাত্রা নিয়ে উচ্ছ্বসিত জেলার বণিকসভা, মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি জয়ন্ত কুণ্ডু । তিনি বলেন, "কয়েক বছর ধরে মালদার আম ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে অল্প হলেও গিয়েছে । রফতানিকারকদের মাধ্যমে এবার জেলার লিচু বিদেশে পাঠানোর বরাত মিলেছে । প্রায় 7-8 মেট্রিক টনের বরাত ইতিমধ্যেই চলে এসেছে । এই চাষের সঙ্গে 15-20 হাজার চাষি জড়িত রয়েছেন । আমরা যদি প্রথমবার ঠিকমতো বিদেশে লিচু পাঠাতে পারি, তবে জেলার পাশাপাশি রাজ্যও অর্থনীতিতে লাভবান হবে ৷ একইসঙ্গে গত দু’বছর আবহাওয়া আর করোনার জন্য যেসব চাষি এই চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাঁরাও ফের লিচু চাষে উৎসাহিত হবেন । তবে এর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের সহযোগিতাও প্রয়োজন ।"
আরও পড়ুন : কাতারের প্রদর্শনীতে নজর কাড়ল মালদার আম, এল আরও বরাত