কলকাতা, 29 অগস্ট : ধরা যাক, আপনি কোনও আর্ট এগজিবিশনে গিয়েছেন । একের পর এক ছবি দেখে বাক্যিহারা দশা ! ভাবছেন, একজন শিল্পী কীভাবে এমন অনায়াস তুলির টান রপ্ত করেন ! সত্যি বলতে কী, এই মুগ্ধতায় দোষের কিছু নেই । শিল্পীর মুন্সিয়ানাও অবশ্য প্রশংসনীয় । কিন্তু, কখনও ভেবে দেখেছেন কি, কোন তুলির টানে জীবন্ত হয়ে ওঠে রঙের আঁচড় ? কী তার রহস্য ? আপনি যদি ছবিপ্রেমী হন, তাহলে অবশ্যই এগুলো ভাবুন । কারণ, ভাবাটা ভীষণ দরকার । আপনার, আমার বেঁচে থাকার জন্যই এটা জরুরি ।
প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব ধরন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে নিজের পছন্দ । তাঁরা সকলে একইরকম তুলি দিয়ে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ নন । তথ্য বলছে, শিল্পী মহলে এক বিশেষ ধরনের তুলির কদর বাদবাকিদের থেকে বেশি । কী এই তুলির বিশেষত্ব ? আজ হঠাৎ এ নিয়েই বা আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন ?
আরও পড়ুন : 'মগজখেকো অ্য়ামিবা'র শিকার 36-এর যুবক ! প্রাণ গেল ইজরায়েলি নাগরিকের
বিষয়টি কিছুটা খোলসা হল অয়ন বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের কথায় । ছবি আঁকা এবং মূর্তি তৈরি তাঁর পেশা । একইসঙ্গে, বন্যাপ্রাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাও রয়েছে । তিনি জানালেন, তুলির মান যত উন্নত হবে, শিল্পীর পক্ষেও সেই তুলির ততটাই সাবলীল ব্যবহার সম্ভব হবে । একটা সময় এইসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিশেষ কয়েক ধরনের বন্যপ্রাণীর শরীরের লোম ব্যবহার করা হত । কিন্তু, বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ বন্যপ্রাণীই সংরক্ষণের আওতাভুক্ত । তাদের শিকার বেআইনি । ফলত, আঁকার কাজে ব্যবহারের যোগ্য তুলি তৈরি করতে এখন সিন্থেটিক বিভিন্ন সামগ্রীর উপরেই ভরসা করতে হয় । তবে, সেইসব তুলির কাজ প্রাকৃতিক তুলির (প্রাণীর লোম থেকে তৈরি) মতো সূক্ষ হয় না । তাহলে কি, ভালো কাজ করার তাগিদে আজও এই ধরনের প্রাকৃতিক তুলি ব্যবহার করছেন শিল্পীরা ? আর সেইসব তুলির ছোঁয়াতেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে কাগজে আঁকা অবয়ব ? না । এই প্রশ্নের উত্তর আমরা অয়নের কাছে পাইনি । তিনি জানিয়েছেন, তিনি নিজে সবসময় সিন্থেটিক তুলিতেই কাজ করেন । অন্য কেউ এই তুলি ব্যবহার করেন কিনা, সেটাও তাঁর জানা নেই । তিনি শুধুমাত্র তুলির গুণাগুণ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । অগত্যা আমরা দ্বারস্থ হলাম এমন দু'জনের, যাঁদের এই সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে । শিল্পের সঙ্গে তাঁদের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও শিল্পের আড়ালে বন্যপ্রাণ আইন ভাঙা হলে, তা নিয়ে তাঁদের মাথা ঘামাতে হয় বইকী !
এঁরা দুজনেই ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস (Indian Forest Sevice) বা আইএফএস (IFS) অফিসার । একজনের নাম সন্তোষ জি আর এবং অন্যজন সাকেত বাডোলা । এঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকায় একটি বিশেষ ধরনের তুলির বিরাট বাজার রয়েছে । এটি হল, সেবল হেয়ার ব্রাশ (Sable Hair Brush) । অর্থাৎ সেবল নামক একটি প্রাণীর লোম থেকে তৈরি তুলি । তথ্য বলছে, সেবল নামক এই প্রাণীটি আমাদের দেশের বাসিন্দা নয় । তবে, ইউরোপ এবং এশিয়ার কিছু অংশের বনাঞ্চলে এদের দেখা পাওয়া যায় । এই সেবলদের লোম থেকে তৈরি তুলি নাকি সবথেকে উৎকৃষ্ট শ্রেণির ! সেবলকে দেখতে অনেকটা আমাদের অতি পরিচিত বেজির মতো । অথচ সেবল আদতে ভোঁদরর নিকট আত্মীয় । সেবল এবং ভোঁদর, দু'টোই আদতে মাস্টেলিডি পরিবারের (Mustelidae Family) অন্তর্ভুক্ত । শোনা যায়, তুলির চাহিদা মেটাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সেবল চাষ করা হয় । পশুপ্রেমীরা এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ করলেও তাতে বিশেষ লাভ হয়নি ।
এখন ঘটনা হল, আমাদের দেশে সেবল পাওয়া যায় না । তাই তার বদলে শুয়োর, কাঠবেড়ালি এবং বেজির লোম ব্যবহার করে তুলি তৈরি করা হয় । এগুলির মধ্যে আবার বেজির লোমের তুলি হল সেরা মানের । অথচ বেজি শিকার এদেশে নিষিদ্ধ । কারণ, ছোট্ট, ছটফটে এই প্রাণীটি বন্যপ্রাণ আইন অনুসারে সংরক্ষণের (শিডিউল-২) আওতাভুক্ত । এই বিষয়টি শিল্পীদেরও অজানা নয় । সত্যি বলতে কী, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আইন মেনে সিন্থেটিক তুলিতেই কাজ করেন । কিন্তু, ব্যতিক্রম এখানেও আছে । সন্তোষ এবং সাকেতের আক্ষেপ, সবকিছু জানার পরও কিছু শিল্পী আজও গোপনে বেজির লোমের তৈরি তুলি ব্যবহার করে চলেছেন । আর তাঁদের চাহিদা মেটাতেই প্রতিদিন ভারতের সর্বত্র গোপনে বেজি নিধন চলছে ।
ভারতে মূলত দুধরনের বেজির লোম দিয়ে তুলি তৈরি করা হয় । একটি হল, ইন্ডিয়ান গ্রে মঙ্গুস (Indian Grey Mongoose) এবং অন্যটি স্মল ইন্ডিয়ান মঙ্গুস (Small Indian Mongoose) । এদেশের সর্বত্রই এদের দেখা মেলে । আকারে ছোট হওয়ায় এক-একটি বেজির শরীর থেকে খুব বেশি হলেও 50 থেকে 60 গ্রাম লোম পাওয়া যায় । সুতরাং, বহু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি তুলি তৈরি করার জন্যই একাধিক বেজি মারতে হয় ! সাকেত জানালেন, শুধুমাত্র ছবি আঁকার জন্য নয় । রূপচর্চায় ব্যবহৃত, আরও স্পষ্ট করে বললে মেকআপের জন্য যেসব ব্রাশ বা তুলি ব্যবহার করা হয়, সেখানেও বেজির লোমের কদর সবথেকে বেশি ! বন্যপ্রাণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো (Wildlife Crime Control Bureau) বা ডাব্লিউসিসিবি (WCCB) সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি বছর ভারতে অন্তত 50 হাজার বেজি শিকার করা হয় (Mongoose Hunting for Paint Brush) ! কোনও কোনও বছর সংখ্য়াটা পৌঁছে যায় 1 লক্ষের কাছাকাছি ! আর এই কাজ করা হয় শুধুমাত্র চিত্রশিল্পী এবং মেকআপ আর্টিস্টদের একাংশের চাহিদা পূরণ করতে !
সাম্প্রতিককালে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ-সহ ভারতের বিভিন্ন অংশে অভিযান চালিয়ে বেজির লোমের তৈরি তুলির বিরাট কনসাইনমেন্ট উদ্ধার করা হয়েছে । কখনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে 50 হাজার তুলি, আবার কখনও মিলেছে 20 কেজি লোম ! সুতরাং, ভারতে যে কী হারে বেজি নিধন চলছে, তা এর থেকেই স্পষ্ট ।
সাকেত জানালেন, নিয়মিত অভিযান চললেও বেজি শিকার সম্পর্কে ভারতব্যাপী কোনও নির্দিষ্ট তথ্যাবলী নেই । আসলে যাঁরা বেজি শিকার করেন, তাঁরা সাধারণত বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন । কখনও তারের ফাঁদ পেতে, কখনও জাল বিছিয়ে বেজি ধরা হয় । তারপর প্রাণীগুলিকে মেরে লোম ছাড়িয়ে নেওয়া হয় । এভাবেই রোজ একটি-দু'টি করে বেজি মারেন শিকারিরা । অনেকটা পরিমাণে লোম জমে গেলে তা শিকারিদের কাছ থেকে কিনে নেন দালালরা । তারপর তা চালান হয়ে যায় তুলি তৈরির কারখানায় । উত্তরপ্রদেশের বিজনৌরে এমন অনেক কারখানা রয়েছে ।
পিছিয়ে নেই আমাদের রাজ্যও । দক্ষিণ 24 পরগনার বন বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালীন সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সন্তোষের । আমাদের কলকাতার কাছেই বেহালা, ফলতা এবং ভাঙড়ে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা বেজি শিকার এবং তার লোম থেকে তুলি তৈরির কাজ করেন । এই বেআইনি কারবার ঠেকাতে ধরপাকড় কম হয়নি । কিন্তু, লাভ খুব বেশি হয়েছে বলে মনে করেন না বনাধিকারিকরা । আর এখানেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশপ্রেমী ও পশুপ্রেমীরা । তাঁরা বলছেন, এই প্রবণতা মারাত্মক । বাঘ, হাতি বা গন্ডারের মতো বিরাট জন্তুদের নিয়ে মানুষ যতটা সচেতন, বেজির মতো ছোট্ট প্রাণীর ক্ষেত্রে তেমনটা নয় । অথচ, বেজির বংশ ধ্বংস হলে তার প্রভাব হবে মারাত্মক । বস্তুত, আমাদের চারপাশের পরিবেশের ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে ।
ভয়ের কারণ আরও আছে । অতিমারি কী ভয়ঙ্কর জিনিস, করোনার দৌলতে আজ তা আমাদের সকলেরই জানা । মানবদেহে করোনার সংক্রমণের সূচনা নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক রয়েছে । তবে, বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, বাদুড় বা ওই জাতীয় কোনও প্রাণীর মাংস থেকেই এই বিভীষিকার সূত্রপাত । চিন্তার কথা হল, লোমের লোভে বেজি শিকারের পর অধিকাংশ শিকারিই তার মাংসটা ফেলে দেন । কেউ কেউ সেই মাংস খান বলেও শোনা গিয়েছে । তবে, প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউই মুখ খোলেন না । কিন্তু, এই তথ্য সঠিক হলে আগামী দিনে আমরা যে নতুন কোনও প্রাণঘাতী ভাইরাসের কবলে পড়ব না, তেমন গ্যারান্টি কিন্তু কেউ দিচ্ছেন না ।
তবে, আশার কথা হল, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকস্তরে শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে । তাঁদের বোঝানো হচ্ছে, পরিবেশের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, তাঁরা যেন বেজির লোমের তুলি ব্যবহার না করেন । ইতিমধ্যে তার সুফলও মিলতে শুরু করেছে । কিন্তু, তারপরও ভারত তথা বিদেশের বাজারে ভারতীয় বেজির লোম দিয়ে তৈরি তুলির চাহিদা সমূলে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি ।