নদীর জলে বর্জ্য ফেলা যাবে না । সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । এর ফলে আবার নতুন করে নদীর দূষণের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে । ভারতের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের নেতৃত্বাধীন ডিভিসন বেঞ্চ জানিয়েছে, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যমুনা নদীর দূষণ নিয়ে মামলা শুরু করল । দিল্লি জল বোর্ড (ডিজেবি)-এর তরফে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করা হয় । ওই মামলায় হরিয়ানা সরকারকে নদীতে দূষিত পদার্থ ফেলা থেকে বিরত থাকার আবেদন করা হয়েছিল । তার পরই শীর্ষ আদালত দ্বিতীয়বারের জন্য এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । শীর্ষ আদালত উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকারকে সতর্কতার বার্তা দিয়েছে ।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেক নদীর ভাগ্যই যমুনার মতো একই । গোদাবরী, কৃষ্ণা, মঞ্জিরা, মুসি পেন্না, তুঙ্গভদ্রা, নাগাভালি এবং বামসাধারা দূষিত পদার্থে ভরতি । কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (সিপিসিবি)-এর হিসেব অনুযায়ী, ভারতের 450টি নদীর মধ্যে 350টি দূষিত । 10 বছর আগে এই সংখ্যাটা ছিল 121 । 2015 সালে দেওয়া সিপিসিবি-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের নগর ও শহর থেকে যে বর্জ্য-জল বের হয় তার পরিমাণ 6194.8 কোটি লিটার । দেশে যত জল পরিশোধন কেন্দ্র আছে, সেখানে মাত্র 38 শতাংশ দূষিত জল পরিশোধন করা সম্ভব । এর ফলে 3800 কোটি লিটারের অপরিশোধিত জল নদী, হ্রদ ও অন্য জলাশয়ে পড়ে । কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুরসভাগুলিকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে অনেক বেশি পরিমাণে জল পরিশোধন কেন্দ্র তৈরি করা যায় । জলাশয়গুলিতে বর্জ্য নিষ্কাশনের কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে । আর তা থেকে বোঝা যায় যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে । অন্যদিকে জল সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্প, যেমন– ন্যাশনাল রিভার কনজারভেশন প্ল্যান (এনআরসিপি), অটল মিশন (অমরুত) ও নমামি গঙ্গে প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে ।
আরও পড়ুন: জল আছে সর্বত্র, কিন্তু ভালো জল ?
সিপিসিবি জানিয়েছে যে দেশের ভূতলের উপরে থাকা জলের অধিকাংশই ব্যবহার যোগ্য নয় । পবিত্র গঙ্গা নদীকে পরিশোধন করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার শুরু করেছিল নমামি গঙ্গে প্রকল্প । 20 হাজার কোটি টাকায় তৈরি এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা 2020 সালে । শুধুমাত্র 37 শতাংশ কাজ এখনও পর্যন্ত শেষ হয়েছে । উন্নয়নমূলক প্রকল্প শেষ করতে সরকারি ব্যবস্থা কতটা বদ্ধপরিকর এর থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায় । বিশাল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না । উৎসকে রক্ষা করতে হলে কড়া আইন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে নমামি গঙ্গে প্রকল্পের অধীনে 11 হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটি জল পরিশোধন কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল । ওই কেন্দ্র থেকে রোজ 117 কোটি লিটার দূষিত জল পরিশোধন করার কথা ছিল । তার পর গঙ্গা পরিশোধনের জন্য তৈরি ন্যাশনাল মিশন জানিয়েছে, নিকাশি নালা থেকে রোজ 290 কোটি লিটার দূষিত জল গঙ্গায় পড়ে । কেন্দ্রীয় সরকার দেশের 13টি নদীকে নতুন করে জীবন দান করতে চাইছে । ওই প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত হওয়া নদীগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল গোদাবরী ও কৃষ্ণা ।
আরও পড়ুন: দূষিত জল অন্য সব কিছুর থেকে বেশি বিপজ্জনক
ফসফেটের মতো বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি জলাশয়কে ভরাট করে তোলে । যে ঘটনা যুমনার সঙ্গে মিলে যায় । অতীতে ইউরোপীয় দেশগুলি নদীতে ফোম জমে যাওয়া আটকাতে ফসফেট ডিটারজেন্ট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল । গঙ্গা বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত নদীগুলির মধ্যে একটি । বাকি সর্বাধিক দূষিত নদীগুলি হল, ইতালির সারনো নদী, ইন্দোনেশিয়ার সিটারাম নদী, নিউ জার্সির প্যাসায়িক নদী এবং আর্জেন্টিনার মাতাঞ্জা নদী । আর এই সমস্ত ক্ষেত্রেই সরাসরি নর্দমা থেকে অপরিশোধিত জল নদীতে ফেলাই দূষণের প্রধান কারণ । 2020 সালের সেপ্টেম্বরে সিপিসিবি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে একটি রিপোর্ট জমা দেয় । সেই রিপোর্ট অনুসারে, 19টি নদীর জলের নমুনা পরীক্ষা করা হয় । তাতে দেখা গিয়েছে যে কমপক্ষে 14টি নদীতে দূষণের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে । তবে বিশেষজ্ঞরা এই গবেষণার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন । জল সংরক্ষণ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ ও তার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । জলাশয়ে স্নান করা, কাপড় ধোওয়া ও যানবাহন ধোওয়ার মতো কাজ একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে । নদী ও অনান্য জলাশয়ের নতুন জীবন দান তখনই সম্ভব, যখন শিল্পক্ষেত্র থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্যজল ও দূষিত জল নদীতে ফেলে দেওয়া বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করা হবে ।