ETV Bharat / bharat

রাম নামেই কি হুগলি সেতু পার হওয়ার অক্সিজেন মিলছে... - Jay Shri Ram

এমনিতে একটি বড়সড় সমাজতাত্বিক অভিযোজনকে কখনই নির্দিষ্ট করে দেগে দেওয়া যায় না। তবু, চাইলেই বিজেপি-রামানন্দ সাগর-রামায়ণ-রামের সম্পর্কের যোগ খেয়াল করা যায়। 1980 সালের 6 এপ্রিল জনতা দলের অবলুপ্তির পর জনসংঘের সদস্যরা গড়ে তুললেন ভারতীয় জনতা পার্টি । এরপর 1984-র সাধারণ নির্বাচনে বাজপেয়ীদের দল পায় মাত্র 2টি আসন ।

west-bengal-assembly-election-2021-is-jay-shri-ram-is-slogan-of-bjp
west-bengal-assembly-election-2021-is-jay-shri-ram-is-slogan-of-bjp
author img

By

Published : Feb 9, 2021, 10:52 PM IST

Updated : Feb 9, 2021, 11:09 PM IST

একরকম করে ভাবলে রাজ্যের আগামী বিধানসভা ভোটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডার 'রাম' ! এতদিনে পরিষ্কার, মূলত দুই বিষয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রাক নির্বাচনী গঙ্গাপাড়ের দলীয় রাজনীতি । এক, দলবদল । যা মূলত তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার হিড়িক । (সেখানে যেমন চুনোপুটিরা আছে, তেমনই আছেন শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো রাঘব বোয়ালরাও ।) দ্বিতীয়টি অবশ্যই 'রাম' । রাম না বলে 'জয় শ্রী রাম' বললে নির্ভুল বলা হয় । এবং প্রশ্ন উঠছে, এই যে বিজেপির 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান, তা রাজনৈতিক না ধর্মীয় ধ্বনি ? এইসঙ্গে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যে অস্ত্রে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্প্রতিককালে 'ঘায়েল' করে চলেছে বিজেপি, সেই 'জয় শ্রীরাম' কবে থেকে বিজেপির স্লোগান হয়ে উঠল ?

দুই প্রশ্নের উত্তর এক

যেহেতু একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত । কথা হল, বাজপেয়ী-আডবানি, মোদি-শাহদের দলের অফিসিয়াল স্লোগান মোটেই 'জয় শ্রীরাম' নয় । শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসংঘ, পরবর্তীতে জনতা দলের সঙ্গে 'জয় শ্রীরাম'-এর সরাসরি যোগ ছিল না । অন্যদিকে আরএসএস-এর অফিসিয়াল স্লোগান হল গিয়ে 'ভারতমাতা কী জয়' । কার্যক্ষেত্রে ভারত মাতার মূর্তি গড়ে যাঁরা পুজো করেন তাঁরা যে 'ভারত মাতা কী জয়' স্লোগান তুলবেন, সেটা স্বাভাবিক । জনসংঘ (1951) থেকে জনতা পার্টি হয়ে 1980 নাগাদ গড়ে ওঠা ভারতীয় জনতা পার্টিও কিন্তু স্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছিল আরএসএস-এর 'ভারত মাতা কী জয়'-কেই। এইসঙ্গে ছিল 'বন্দেমাতরম'ও। তবে আদর্শগতভাবে গান্ধি-জওহরলাল-সুভাষচন্দ্রের জাতীয় কংগ্রেসের 'বন্দেমাতরম' থেকে বরাবরই খানিক আলাদা মুরলি মনোহর যোশিদের 'বন্দেমাতরম' । মোদি-শাহদের 'বন্দেমাতরম' কি সরাসরি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে লেখা বঙ্কিমের আনন্দমঠের গোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণের স্লোগান ? রামচন্দ্র গুহর মতো ইতিহাসবিদরা তেমনটাই মনে করেন । এখানে উল্লেখ্য, যদিও বন্দেমাতরমের উৎস বঙ্কীমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত আনন্দমঠের ভূভারত খ্যাত সঙ্গীতটিই, তথাপি তার মেটাফরফোসিস ঘটে গিয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির হাতে । এখনে মনে পড়বে "রাম"-ভক্ত গান্ধির প্রিয় গান 'রঘুপতি রাঘব রাজা রাম/ পতিত পাবন সীত-রাম'-এর কথা। যার পরবর্তিত পরের দুই লাইন কিন্তু 'ঈশ্বর-আল্লা তেরো নাম/ সব কো সম্মতি দে ভগবান' । এর ফলেই হয়তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গোটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বীজমন্ত্র হয়ে উঠেছিল 'বন্দেমাতরম'। অপরপক্ষে হিন্দুত্বই যে তাদের অন্যতম মতাদর্শ, তা কখনই লোকায়নি আরএসএস, জনসংঘ, জনতা দল কিংবা পরবর্তীকালের বিজেপিও । ফলে 2021 সালের উইকিতেও জ্বলজ্বল করে, বিজেপির মতাদর্শ হল 'হিন্দুত্ব', 'হিন্দু জাতীয়তাবাদ', 'ভারতীয় জাতীয়তাবাদ' ইত্যাদি । তবে সেখানেও 'জয় শ্রীরাম'-কে বিজেপির 'অফিসিয়াল' স্লোগান বলে দেগে দেওয়া হয়নি । এইখানে হয়তো বিশেষ ভূমিকা রয়েছে রামায়ণ টেলি সিরিয়াল খ্যাত কিংবদন্তি প্রযোজক পরিচালক রামানন্দ সাগরের !

বিজেপি-রামানন্দ সাগর-রামায়ণ-রাম

এমনিতে একটি বড়সড় সমাজতাত্বিক অভিযোজনকে কখনই নির্দিষ্ট করে দেগে দেওয়া যায় না। তবু, চাইলেই বিজেপি-রামানন্দ সাগর-রামায়ণ-রামের সম্পর্কের যোগ খেয়াল করা যায়। 1980 সালের 6 এপ্রিল জনতা দলের অবলুপ্তির পর জনসংঘের সদস্যরা গড়ে তুললেন ভারতীয় জনতা পার্টি । এরপর 1984-র সাধারণ নির্বাচনে বাজপেয়ীদের দল পায় মাত্র 2টি আসন। ওই 1984 সালেই লালকৃষ্ণ আডবানি হলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। হয়েই রাম মন্দির আন্দোলনের ধুয়ো তুললেন। (1980-র গোড়ায় যে আন্দোলন শুরু করেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ।) অন্যদিক বছর তিন বাদে 1987 সালের 25 জানুয়ারি দিনটা ছিল ভারতের টেলিভিশনের ইতিহাসের যুগান্তকারী দিন। এদিন সকালেই দূরদর্শনের পর্দায় সম্প্রচারিত হয় রামানন্দ সাগর প্রযোজিত পরিচালিত টেলি সিরিয়াল রামায়ণের প্রথম এপিসোড । এপিসোড সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসমুদ্র হিমাচলের বসার ঘর উষ্ণ হয়ে ওঠে লঙ্কা জয়ের সোপান বানর সেনার উল্লসিত 'জয় শ্রীরাম ধ্বনি'-তে।

সমাজতাত্বিক বাস্তবতা হল, পর পর দুটি মহাকাব্যের অতি জনপ্রিয় টিভি সম্প্রচার নতুন করে দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। দুই মহাকাব্যের নায়করা, যেমন রাম-হনুমান, কৃষ্ণ-অর্জুনদের একপ্রকার "নবজন্ম" ঘটেছিল ভারতীয় হিন্দু মনস্তত্ত্ব। এই ঘটনাক্রম যখন চলেছে (রামায়ণ: 1987-88, মহাভারত:1988-90) তখনই বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি ক্রমশ ফ্রন্টফুটে খেলতে শুরু করেছে। এবং তার 'সুফল'ও পেতে শুরু করে তারা । রাম মন্দির আন্দোলনকে সামনে রেখে আডবানির নেতৃ্ত্ব 1989-এর নির্বাচনে 89টি সিট পায় বিজেপি । বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের জাতীয় ফ্রন্ট সরকারের গুরত্বপূর্ণ সহকারি হয়। এবং ঐতিহাসিক 1990-এর সেপ্টেম্বর। লালকৃষ্ণ আডবাণী রাম মন্দির আন্দোলনের সমর্থনে অযোধ্যার উদ্দেশে 'রথযাত্রা' কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। কাট টু ক্ল্যাইম্যাক্স--- 1992 সালের 6 ডিসেম্বর। সেদিন কী ঘটেছিল সবার জানা। আসল কথা সেদিন কিন্তু করসেবকদের মুখে ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম ধ্বনি 'জয় শ্রীরাম'। বাবরি ধ্বংস পরবর্তী হিংসাতেও সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় দেখা গিয়েছিল হাতে অস্ত্র অনেকের ছবি৷ যাঁদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল, তাঁদের মাথায় জয় শ্রীরাম ফেট্টি বাঁধা৷ সেই ছবি উঠে এসেছিল সংবাদপত্রে । ঐতিহাসিক সত্যি হল, এরপরই আসমুদ্রহিমাচল স্পষ্ট করে জানল, আরএসস, বিশ্বহিন্দু পরিষদ, এমনকী বিজেপি মানে (স্লোগান) 'জয় শ্রীরাম'। তারপরেও 'জয় শ্রীরাম' কী বিজেপির আমদানি করা ধ্বনি? কিংবা বিজেপিই কি তাকে ভারতীয় সমাজে সম্মোক প্রতিষ্ঠা দিল?

আরও পড়ুন : ঠাকুরের চেয়ারে কে বসেছিলেন ? শাহি-তরজা গণতন্ত্রের মন্দিরে

রামায়ণ-মহাভারতের দেশ

প্রতিষ্ঠার হিসেব অন্য। কারণ, ভারতে, এমনকী ভারতীয় উপমহাদেশে রাম ও জয় শ্রীরাম বহু যুগের আত্মীয় । বাল্মীকি রামায়ণের বাইরে বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণের মতো প্রায় অধিকাংশ ভারতীয় ভাষায় লিখিত হয়েছে রামায়ণ । এমনকী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জাভা, বালির মতো অঞ্চলেও রয়েছে রামায়ণের নিজস্ব পাঠ । ভাষা বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাতে ঢুকেছে স্থানীয়তা । অতএব, সে আপনি জন্মগতভাবে যে ধর্ম অনুসারিই হোন, ভারত কিন্তু মজ্জায় মজ্জায় রামায়ণ-মহাভারতের দেশ । আচার সর্বস্ব সঙ্কীর্ণ ধর্মের ঊর্ধ্বে লোকজীবনের দেবতা দশরথ নন্দন। তাই যাত্রায়, নাটকে, সিনেমায় রামের উপস্থিতি। এমনকী 'বাংলা সাহিত্যে রাম', এই শিরোনামে লেখা হতে পারে আলাদা সন্দর্ভ। একই কারণে এ দেশের একটা বিরাট অংশর মানুষের সম্বোধনসূচক শব্দ 'জয় শ্রীরাম', 'জয় সিয়া-রাম', 'জয় রামজি কি'। শেষ যাত্রার ধ্বনি 'রাম নাম সত্য হ্যায়'। সাধারণ বাঙালি জীবনের ছত্রে ছত্রেও ঢুকে বসে আছে 'রাম' শব্দ ।

'রাম' মানে গ্র্যান্ড

'রাম' মানে বড় বা গ্র্যান্ড কিছু । তাই 'রাম' দা কিংবা 'রাম' ছাগল। পদ্মাপাড়ের বাঙালির রংধনু করে নিলেও গঙ্গাপাড়ে অধিকাংশের কাছে তা আজও 'রাম'ধনু । এমনকী 'রাম' নামে ভূত পর্যন্ত পালায়, জানে ছোটোবেলা, ভিক্টোরিয়ার অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণ বয়কট করায় যা বলে মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছেন দিলীপ ঘোষ ! তবে, দিলীপ ঘোষরাও বোধ হয় মানবেন 'জয় শ্রীরাম'কে তাঁরা এদেশে প্রতিষ্ঠা দেননি, এমনকী 'জয় শ্রীরাম' তাদের অফিসিয়াল স্লোগানও নয় ।

তবে রাজনৈতিক মানচিত্রে 'জয় শ্রীরাম'-এর ব্যবহারে ফুল মার্কস পাবে বিজেপি । আর এখন একুশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বড় প্রশ্ন হল, 'মরা' 'মরা' করতে করতে যেমন 'রাম' উচ্চারণে পৌঁছেছিলেন রামায়ণের রূপকার, সেভাবেই কী 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি তুলতে তুলতে 'রাম কে নাম' করতে করতে বাংলার মসনদ দখল করবে বিজেপি ?

সময়ই দেবে উত্তর ।

একরকম করে ভাবলে রাজ্যের আগামী বিধানসভা ভোটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডার 'রাম' ! এতদিনে পরিষ্কার, মূলত দুই বিষয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রাক নির্বাচনী গঙ্গাপাড়ের দলীয় রাজনীতি । এক, দলবদল । যা মূলত তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার হিড়িক । (সেখানে যেমন চুনোপুটিরা আছে, তেমনই আছেন শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো রাঘব বোয়ালরাও ।) দ্বিতীয়টি অবশ্যই 'রাম' । রাম না বলে 'জয় শ্রী রাম' বললে নির্ভুল বলা হয় । এবং প্রশ্ন উঠছে, এই যে বিজেপির 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান, তা রাজনৈতিক না ধর্মীয় ধ্বনি ? এইসঙ্গে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যে অস্ত্রে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্প্রতিককালে 'ঘায়েল' করে চলেছে বিজেপি, সেই 'জয় শ্রীরাম' কবে থেকে বিজেপির স্লোগান হয়ে উঠল ?

দুই প্রশ্নের উত্তর এক

যেহেতু একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত । কথা হল, বাজপেয়ী-আডবানি, মোদি-শাহদের দলের অফিসিয়াল স্লোগান মোটেই 'জয় শ্রীরাম' নয় । শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসংঘ, পরবর্তীতে জনতা দলের সঙ্গে 'জয় শ্রীরাম'-এর সরাসরি যোগ ছিল না । অন্যদিকে আরএসএস-এর অফিসিয়াল স্লোগান হল গিয়ে 'ভারতমাতা কী জয়' । কার্যক্ষেত্রে ভারত মাতার মূর্তি গড়ে যাঁরা পুজো করেন তাঁরা যে 'ভারত মাতা কী জয়' স্লোগান তুলবেন, সেটা স্বাভাবিক । জনসংঘ (1951) থেকে জনতা পার্টি হয়ে 1980 নাগাদ গড়ে ওঠা ভারতীয় জনতা পার্টিও কিন্তু স্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছিল আরএসএস-এর 'ভারত মাতা কী জয়'-কেই। এইসঙ্গে ছিল 'বন্দেমাতরম'ও। তবে আদর্শগতভাবে গান্ধি-জওহরলাল-সুভাষচন্দ্রের জাতীয় কংগ্রেসের 'বন্দেমাতরম' থেকে বরাবরই খানিক আলাদা মুরলি মনোহর যোশিদের 'বন্দেমাতরম' । মোদি-শাহদের 'বন্দেমাতরম' কি সরাসরি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে লেখা বঙ্কিমের আনন্দমঠের গোড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণের স্লোগান ? রামচন্দ্র গুহর মতো ইতিহাসবিদরা তেমনটাই মনে করেন । এখানে উল্লেখ্য, যদিও বন্দেমাতরমের উৎস বঙ্কীমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত আনন্দমঠের ভূভারত খ্যাত সঙ্গীতটিই, তথাপি তার মেটাফরফোসিস ঘটে গিয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির হাতে । এখনে মনে পড়বে "রাম"-ভক্ত গান্ধির প্রিয় গান 'রঘুপতি রাঘব রাজা রাম/ পতিত পাবন সীত-রাম'-এর কথা। যার পরবর্তিত পরের দুই লাইন কিন্তু 'ঈশ্বর-আল্লা তেরো নাম/ সব কো সম্মতি দে ভগবান' । এর ফলেই হয়তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গোটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বীজমন্ত্র হয়ে উঠেছিল 'বন্দেমাতরম'। অপরপক্ষে হিন্দুত্বই যে তাদের অন্যতম মতাদর্শ, তা কখনই লোকায়নি আরএসএস, জনসংঘ, জনতা দল কিংবা পরবর্তীকালের বিজেপিও । ফলে 2021 সালের উইকিতেও জ্বলজ্বল করে, বিজেপির মতাদর্শ হল 'হিন্দুত্ব', 'হিন্দু জাতীয়তাবাদ', 'ভারতীয় জাতীয়তাবাদ' ইত্যাদি । তবে সেখানেও 'জয় শ্রীরাম'-কে বিজেপির 'অফিসিয়াল' স্লোগান বলে দেগে দেওয়া হয়নি । এইখানে হয়তো বিশেষ ভূমিকা রয়েছে রামায়ণ টেলি সিরিয়াল খ্যাত কিংবদন্তি প্রযোজক পরিচালক রামানন্দ সাগরের !

বিজেপি-রামানন্দ সাগর-রামায়ণ-রাম

এমনিতে একটি বড়সড় সমাজতাত্বিক অভিযোজনকে কখনই নির্দিষ্ট করে দেগে দেওয়া যায় না। তবু, চাইলেই বিজেপি-রামানন্দ সাগর-রামায়ণ-রামের সম্পর্কের যোগ খেয়াল করা যায়। 1980 সালের 6 এপ্রিল জনতা দলের অবলুপ্তির পর জনসংঘের সদস্যরা গড়ে তুললেন ভারতীয় জনতা পার্টি । এরপর 1984-র সাধারণ নির্বাচনে বাজপেয়ীদের দল পায় মাত্র 2টি আসন। ওই 1984 সালেই লালকৃষ্ণ আডবানি হলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। হয়েই রাম মন্দির আন্দোলনের ধুয়ো তুললেন। (1980-র গোড়ায় যে আন্দোলন শুরু করেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ।) অন্যদিক বছর তিন বাদে 1987 সালের 25 জানুয়ারি দিনটা ছিল ভারতের টেলিভিশনের ইতিহাসের যুগান্তকারী দিন। এদিন সকালেই দূরদর্শনের পর্দায় সম্প্রচারিত হয় রামানন্দ সাগর প্রযোজিত পরিচালিত টেলি সিরিয়াল রামায়ণের প্রথম এপিসোড । এপিসোড সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসমুদ্র হিমাচলের বসার ঘর উষ্ণ হয়ে ওঠে লঙ্কা জয়ের সোপান বানর সেনার উল্লসিত 'জয় শ্রীরাম ধ্বনি'-তে।

সমাজতাত্বিক বাস্তবতা হল, পর পর দুটি মহাকাব্যের অতি জনপ্রিয় টিভি সম্প্রচার নতুন করে দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। দুই মহাকাব্যের নায়করা, যেমন রাম-হনুমান, কৃষ্ণ-অর্জুনদের একপ্রকার "নবজন্ম" ঘটেছিল ভারতীয় হিন্দু মনস্তত্ত্ব। এই ঘটনাক্রম যখন চলেছে (রামায়ণ: 1987-88, মহাভারত:1988-90) তখনই বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি ক্রমশ ফ্রন্টফুটে খেলতে শুরু করেছে। এবং তার 'সুফল'ও পেতে শুরু করে তারা । রাম মন্দির আন্দোলনকে সামনে রেখে আডবানির নেতৃ্ত্ব 1989-এর নির্বাচনে 89টি সিট পায় বিজেপি । বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের জাতীয় ফ্রন্ট সরকারের গুরত্বপূর্ণ সহকারি হয়। এবং ঐতিহাসিক 1990-এর সেপ্টেম্বর। লালকৃষ্ণ আডবাণী রাম মন্দির আন্দোলনের সমর্থনে অযোধ্যার উদ্দেশে 'রথযাত্রা' কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। কাট টু ক্ল্যাইম্যাক্স--- 1992 সালের 6 ডিসেম্বর। সেদিন কী ঘটেছিল সবার জানা। আসল কথা সেদিন কিন্তু করসেবকদের মুখে ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম ধ্বনি 'জয় শ্রীরাম'। বাবরি ধ্বংস পরবর্তী হিংসাতেও সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় দেখা গিয়েছিল হাতে অস্ত্র অনেকের ছবি৷ যাঁদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল, তাঁদের মাথায় জয় শ্রীরাম ফেট্টি বাঁধা৷ সেই ছবি উঠে এসেছিল সংবাদপত্রে । ঐতিহাসিক সত্যি হল, এরপরই আসমুদ্রহিমাচল স্পষ্ট করে জানল, আরএসস, বিশ্বহিন্দু পরিষদ, এমনকী বিজেপি মানে (স্লোগান) 'জয় শ্রীরাম'। তারপরেও 'জয় শ্রীরাম' কী বিজেপির আমদানি করা ধ্বনি? কিংবা বিজেপিই কি তাকে ভারতীয় সমাজে সম্মোক প্রতিষ্ঠা দিল?

আরও পড়ুন : ঠাকুরের চেয়ারে কে বসেছিলেন ? শাহি-তরজা গণতন্ত্রের মন্দিরে

রামায়ণ-মহাভারতের দেশ

প্রতিষ্ঠার হিসেব অন্য। কারণ, ভারতে, এমনকী ভারতীয় উপমহাদেশে রাম ও জয় শ্রীরাম বহু যুগের আত্মীয় । বাল্মীকি রামায়ণের বাইরে বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণের মতো প্রায় অধিকাংশ ভারতীয় ভাষায় লিখিত হয়েছে রামায়ণ । এমনকী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জাভা, বালির মতো অঞ্চলেও রয়েছে রামায়ণের নিজস্ব পাঠ । ভাষা বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাতে ঢুকেছে স্থানীয়তা । অতএব, সে আপনি জন্মগতভাবে যে ধর্ম অনুসারিই হোন, ভারত কিন্তু মজ্জায় মজ্জায় রামায়ণ-মহাভারতের দেশ । আচার সর্বস্ব সঙ্কীর্ণ ধর্মের ঊর্ধ্বে লোকজীবনের দেবতা দশরথ নন্দন। তাই যাত্রায়, নাটকে, সিনেমায় রামের উপস্থিতি। এমনকী 'বাংলা সাহিত্যে রাম', এই শিরোনামে লেখা হতে পারে আলাদা সন্দর্ভ। একই কারণে এ দেশের একটা বিরাট অংশর মানুষের সম্বোধনসূচক শব্দ 'জয় শ্রীরাম', 'জয় সিয়া-রাম', 'জয় রামজি কি'। শেষ যাত্রার ধ্বনি 'রাম নাম সত্য হ্যায়'। সাধারণ বাঙালি জীবনের ছত্রে ছত্রেও ঢুকে বসে আছে 'রাম' শব্দ ।

'রাম' মানে গ্র্যান্ড

'রাম' মানে বড় বা গ্র্যান্ড কিছু । তাই 'রাম' দা কিংবা 'রাম' ছাগল। পদ্মাপাড়ের বাঙালির রংধনু করে নিলেও গঙ্গাপাড়ে অধিকাংশের কাছে তা আজও 'রাম'ধনু । এমনকী 'রাম' নামে ভূত পর্যন্ত পালায়, জানে ছোটোবেলা, ভিক্টোরিয়ার অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণ বয়কট করায় যা বলে মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছেন দিলীপ ঘোষ ! তবে, দিলীপ ঘোষরাও বোধ হয় মানবেন 'জয় শ্রীরাম'কে তাঁরা এদেশে প্রতিষ্ঠা দেননি, এমনকী 'জয় শ্রীরাম' তাদের অফিসিয়াল স্লোগানও নয় ।

তবে রাজনৈতিক মানচিত্রে 'জয় শ্রীরাম'-এর ব্যবহারে ফুল মার্কস পাবে বিজেপি । আর এখন একুশে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বড় প্রশ্ন হল, 'মরা' 'মরা' করতে করতে যেমন 'রাম' উচ্চারণে পৌঁছেছিলেন রামায়ণের রূপকার, সেভাবেই কী 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি তুলতে তুলতে 'রাম কে নাম' করতে করতে বাংলার মসনদ দখল করবে বিজেপি ?

সময়ই দেবে উত্তর ।

Last Updated : Feb 9, 2021, 11:09 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.