প্রস্তাব
অন্ধ্রপ্রদেশ বিকেন্দ্রীকরণ ও সমস্ত অঞ্চলকে অন্তর্ভূক্তকরণ (APDIDAR) বিল, 2020 অনুযায়ী অন্ধ্রপ্রদেশ এবার তিনটি রাজধানী পাবে ৷ বিশাখাপটনম মেট্রোপলিটন হবে প্রধান রাজধানী ৷ সেখানেই বসবে বিধানসভার গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন ৷ থাকবে রাজভবন, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর, সচিবালয় । সমস্ত সরকারি দপ্তরের প্রধান কার্যালয় থাকবে বিশাখাপটনমে৷ উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চও থাকবে৷ অমরাবতী-মালকানগিরি কমপ্লেক্সে থাকবে স্থায়ী বিধানসভা ৷ এছাড়া থাকবে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর অস্থায়ী অফিস ৷ উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চও থাকবে সেখানে ৷ বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন এখানে বসবে ৷
কুরনুল হবে বিচারবিভাগীয় রাজধানী ৷ সেখানে থাকবে উচ্চ আদালত ৷ এভাবেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে একটি ভৌগোলিক মাত্রা দেওয়া হয়েছে ৷ আরও একাধিক প্রশাসনিক আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৷ এর মধ্যে তৈরি হবে আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিষদ এবং আঞ্চলিক রাজস্ব আদায় কমিশনারের অফিস ৷ জেলার সংখ্যা বাড়িয়ে 13 থেকে 25 করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৷ গ্রাম ও ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে গ্রাম ও ওয়ার্ড সচিবালয় তৈরি করা হবে৷
সমান্তরালভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজধানী আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (APCRDA) রদ বিল, 2020 তে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে APCRDA বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ৷ এর বদলে তৈরি হবে অমরাবতী মেট্রোপলিটন আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (AMRDA) ৷ এর পিছনে যুক্তি, বছরের পর বছর ধরে অন্ধ্রপ্রদেশে ভারসাম্যহীনভাবে উন্নয়ন হয়েছে ৷ এর জেরেই তেলাঙ্গানা আন্দোলনের সূচনা ৷ ফলে 2014 সালে রাজ্য ভাগ হয়ে যায় ৷ এই নতুন ব্যবস্থা পেশাদার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী করা হয়েছে ৷
মূল বিষয়
20 হাজার কৃষক (এর মধ্যে 70 শতাংশ ছোটো ও প্রান্তিক) তাঁদের 33 হাজার একর জমি একত্রিত করে ফেলেছেন বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুবিধা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ৷ কিন্তু অমরাবতীর বদলে যদি তিনটি রাজধানী হয়ে যায়, তাহলে ওই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার সম্ভাবনা সেভাবে থাকবে না ৷ সরকার অবশ্য কৃষকদের বার্ষিক ভাতা বাড়িয়ে 10 থেকে 15 বছর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ ভূমিহীন দরিদ্রদের মাসিক ভাতা 2500 টাকা থেকে বাড়িয়ে 5 হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ৷ যদিও কৃষকরা মনে করছেন তিন রাজধানী তৈরির প্রস্তাব আসলে বিশ্বাসভঙ্গের সমান ৷ তাঁরা প্রতিশ্রুতি মতো চাকরি পাবেন না ৷ সামাজিক ও শারীরিক পরিকাঠামো সেভাবে উন্নত হবে না ৷ জমির দামও সেভাবে আর বাড়বে না ৷
একই সঙ্গে এটাও দাবি করা হয়েছে যে অমরাবতী গুন্টুর বা বিজয়ওয়াড়া নয় ৷ এই দু’টো জায়গায় প্রধান রাজধানী ও উচ্চ আদালত তৈরির জন্য প্রধান দাবিদার ছিল ৷ যে পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, তার জন্য খরচ পড়বে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ৷ অন্যদিকে জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনাল ও নদী সংরক্ষণ আইনের আওতায় যদি কিছু জমি নিয়ে আপত্তি ওঠে, তখন অমরাবতীতে রাজধানী তৈরির পরিকাঠামো তৈরি করতে মাত্র পাঁচ হাজার একর জমি পড়ে থাকবে ৷ তবে এর মধ্যেও অতিরিক্ত খরচকে কেন্দ্র করে কিছু বাস্তবিক চিন্তার বিষয় রয়েছে৷ কারণ, অমরাবতীতে যে পরিকাঠামো ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তা আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে বিশাখাপটনম ও কুরনুলে ৷ অমরাবতীতে রাজধানী পরিকাঠামো তৈরির জন্য 33 হাজার কোটি টাকা প্রকল্প খরচ ধরা হয়েছিল ৷ সরকারি হিসেবে তার মধ্যে 5500 কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে ৷ যদিও বিরোধীদের দাবি, এই খাতে খরচ হয়েছে দশ হাজার কোটি টাকা ৷ নতুন পরিকাঠামো তৈরিতে আর্থিক খরচ ছাড়াও আরও কিছু অপচয় সংক্রান্ত আশঙ্কা রয়েছে ৷
লজিস্টিকের বিষয়টিও নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত ৷ বিশাখাপটনম ও অমরাবতীর মধ্যে দূরত্ব 367 কিলোমিটার ৷ আবার বিশাখাপটনম ও কুরনুলের মধ্যে দূরত্ব 692 কিলোমিটার ৷ কুরনুল ও অমরাবতীর মধ্যে দূরত্ব 343 কিলোমিটার ৷ এই তিন রাজধানীর মধ্যে সংযোগরক্ষা করা সাধারণ মানুষ, সরকারি আধিকারিক ও বিধায়কদের জন্য সময় সাপেক্ষ বিষয় । একইসঙ্গে সরকারের খরচও একটি ভাবনা-চিন্তার বিষয় । পাশাপাশি শিল্প সংস্থাগুলির প্রতিনিধিদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে ৷ সরকারি কর্মচারি যারা মাত্র দু’বছর আগে হায়দরাবাদ থেকে অমরাবতীতে গিয়ে থাকা শুরু করেছেন, তাঁদের অনেককেই এবার বিশাখাপটনম ও কুরনুলে গিয়ে নতুন করে বাসস্থান তৈরি করতে হবে ৷ যদিও রাজ্য সরকার এ বিষয়ে কিছু ছাড় দিয়েছে, তা সত্ত্বেও শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা এড়ানো যাবে না ৷ এছাড়া সরকারি ক্ষেত্রে অনেক দপ্তরের প্রধান অংশ নিয়ে সমস্যা হতে পারে ৷ যদি সব সরকারি অফিস বিশাখাপত্তনমে সরে যায়, তাহলে বিকেন্দ্রীকরণের সুফল অন্য অঞ্চলগুলি কীভাবে পাবে ?
গোপন উদ্দেশ্য
অমরাবতী প্রকল্পকে হত্যা করার জন্য এই স্থানান্তর বলে দাবি করেছে বিরোধীরা ৷ অভিযোগ যে, শাসক দল চায় না নতুন রাজধানী তৈরির পুরো কৃতিত্ব পান চন্দ্রবাবু নাইডু, যিনি এই পুরো কর্মকাণ্ডের প্রধান স্থপতি ৷ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নাইডু ও তাঁর অনুগামীদের উপকূল অঞ্চলের কাম্মা জাতি এবং রয়ালসীমার রেড্ডিদের মধ্যে জাতপাতের লড়াই এই জটলিতার আসল কারণ ৷ অমরাবতীর উন্নতিতে কাম্মাদের আখেরে লাভ হত ৷ কিন্তু জগনমোহন রেড্ডি তাঁর নিজের রেড্ডি সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করছেন ৷
আর কোনও বিকল্প আছে কী?
বিকেন্দ্রীকরণ ও সরকারি অফিসগুলিকে রাজ্যের নানা অংশে বণ্টনের ভাবনাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না ৷ আবার এটা একেবারে নতুনও নয় ৷ এক জায়গায় প্রধান কার্যালয় ও বিধানসভা রাখা এবং অন্য জায়গায় বিচারব্যবস্থাকে সরিয়ে নেওয়া যাওয়াও অস্বাভাবিক নয় ৷ উত্তর প্রদেশের প্রধান কার্যালয় ও বিধানসভা লখনউতে অবস্থিত ৷ আর এলাহাবাদ উচ্চ আদালত অবস্থিত প্রয়াগরাজে ৷ একই ছবি দেখা যায় রাজস্থান (জয়পুর ও যোধপুর) ও মধ্যপ্রদেশে (ভোপাল ও জব্বলপুর) ৷ একই বছরে দু’টো শহরে বিধানসভার অধিবেশন বসার নজির এর আগেও হয়েছে কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে ৷ তবে স্থায়ী বিধানসভা প্রধান রাজধানী থেকে দূরে রাখার এমন প্রচেষ্টা ভারতে এর আগে হয়নি ৷ সর্বস্তরের উন্নয়নের জন্য রাজ্যজুড়ে সরকারি অফিস ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও নতুন নয় ৷ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে মধ্যপ্রদেশের নাম ৷ ওই রাজ্যের প্রধান ও বিধানসভাগত রাজধানী ভোপাল ৷ আর গোয়ালিয়রে রয়েছে রাজস্ব বোর্ড, আবগারি কমিশনার, পরিবহণ কমিশনার ও ভূমি তথ্য কমিশনারের অফিস ৷ অন্যদিকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বাণিজ্যিক কর কমিশনার ও শ্রম কমিশনারের অফিস রয়েছে ইন্দোরে ৷ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও অন্যান্য দিক খতিয়ে দেখার পরও এই বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনা সফল হতে পারে, যদি কেন্দ্রীয়স্থানে অবস্থিত এমন কোনও জায়গায় স্থায়ী বিধানসভা ও সচিবালয় থাকবে ৷ মধ্যপ্রদেশের মতো বিভিন্ন দপ্তর প্রধান কার্যালয়গুলি রাজ্যের নানা অংশে সমবণ্টন করা যেতেই পারে ৷ বিধানসভা ও উচ্চ আদালত সেভাবে আঞ্চলিক উন্নয়নে কোনও প্রভাব ফেলে না ৷ সম্প্রতি একজন বড় ব্যবসায়ী কর্পোরেট প্রশাসনের নিরিখে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে তিনটি ইঞ্জিন দিয়ে কখনও একটি সংস্থা সফলভাবে চলতে পারে না ৷