যদিও গোটা পৃথিবী বর্তমানে একজোট হয়ে কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে এবং আমরা এই অনিশ্চিত পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে ওঠার চেষ্টা করছি, সেখানেই দক্ষিণ এশিয়ায় এমন একটি অঞ্চল আছে, যেখানে এর কোনও প্রভাবই পড়েনি । প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকায় ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সেনার মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এখনও চলছে । ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মার্চ মাসে 411 বার অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন হয়েছে, যা 2019 সালে এই সময়ের তুলনায় 50 শতাংশ বেশি আর 2018 সালে এই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ।
5 এপ্রিল, কেরান সেক্টর দিয়ে অনুপ্রবেশে উদ্যত পাঁচ জন জঙ্গিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয় এবং সেই ঘটনায় বিশেষ বাহিনীর পাঁচ জওয়ান শহিদ হন । পাঁচ দিন পর, ভারতীয় সেনার তরফে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করা হয়, যেখানে দেখানো হয় কীভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জঙ্গিদের লঞ্চপ্যাডে হামলা চালানো হচ্ছে এবং কীভাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গিরা অস্ত্র, বিস্ফোরক মজুত করে রেখেছে । দু’দিন পর একই স্থানে পাকিস্তানের সেনার গুলিতে তিন জন ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যু হয় এবং আরও সাত জন জখম হন । মৃতদের মধ্যে আট বছরের এক জন শিশুও ছিল ।
এই সময় তাই নিশ্চিতভাবেই কিছু প্রশ্ন মনে জাগে । এমন সংকটে যেখানে ভারত এবং পাকিস্তান, উভয় দেশই জর্জরিত, সেখানে সীমান্তে কি কিছু সময়ের জন্য হলেও শান্তি থাকতে পারে না? বর্তমানে দুই দেশেরই শক্রু এক, সুতরাং সেই শত্রুর মোকাবিলা করার দিকে কি আমরা মনোযোগ দিতে পারি না? এই দুই প্রশ্নেরই উত্তর হল ‘হ্যাঁ’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিটা এটাই যে নৈতিক মূল্যবোধ সবসময় জাতীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে না ।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গুলি চালনার ঘটনাকে প্রায়শই দু’দেশের সেনার মুখপাত্রগণ খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন । এক্ষেত্রে সাধারণভাবে যে বয়ান দেওয়া হয়, তা হল অন্য পক্ষের ‘অনর্থক গুলিচালনা’–র ‘কড়া জবাব’ দিতেই পাল্টা গুলি চালানো হয়েছে । যদিও সত্যিটা কিন্তু ভিন্ন । অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা কিন্তু সব সময় ‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে’–জনিত বিবাদ নয়, বরং তা হল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকায় বৃহত্তর নিরাপত্তা পরিস্থিতির যথাযথ প্রতিফলন ।
2003 সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া অস্ত্রবিরতি চুক্তি 2012 সাল পর্যন্ত দু’পক্ষই মেনেছিল । কিন্তু 2013 সালটা শুরু হল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকায় নজরদারি চালানোর সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলের উপর হামলার ঘটনা দিয়ে, যেখানে একজন ভারতীয় জওয়ান, ল্যান্সনায়েক হেমরাজকে মারার পর অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছিল । সেই সময় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকায় মাইন এবং ID পুঁতে রাখার ঘটনারও বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল । আগস্ট মাসে, পুঞ্চ সেক্টরে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে থাকা ভারতীয় সেনার উপর হামলা চালায় পাকিস্তানি বর্ডার অ্যাকশন টিম । ঘটনায় পাঁচ ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল ।
সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এইভাবে মুখ থুবড়ে পড়ায় উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় । সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনা বাড়তে বাড়তে এতটাই চড়া আকার ধারণ করে যে শেষ পর্যন্ত দু’দেশের মিলিটারি অপারেশনসের ডিরেক্টর জেনারেল গত 14 বছরের ইতিহাসে সেই প্রথম মুখোমুখি বৈঠকে বসতে রাজি হয় । যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল, তবু তাতে বিশেষ কোনও লাভ হয়নি বরং 2014 সালে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ।
আমি 2013 সালের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি এটা বোঝানোর জন্য যে, যদি কেউ মনে করেন 2003 সালের চুক্তি মানার ব্যাপারে দুই পক্ষের সম্মতির (যদি বাস্তবে নিয়ম–নীতি মেনে, কাগজে–কলমে তা হয়েও থাকে) অর্থ এই যে, তার ফলে সীমান্তে শান্তি ফিরবে, তবে সেই ভাবনা বালখিল্যতা । যদি সত্যি সত্যিই কোনও সুরাহা হত, তবে তার জন্য পাকিস্তানকে নিজেদের দিক থেকে আগে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হত । যদি অনুপ্রবেশ চলতেই থাকে আর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতীয় জওয়ানরা পর পর শহিদ হতেই থাকেন, তাহলে সেখানে শান্তি কখনওই ফিরতে পারে না ।
শান্তি ফেরানোর জন্য পাকিস্তানি ‘ডিপ স্টেট’–এর কাশ্মীরের প্রতি মনোভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বদল আনার প্রয়োজন । একইভাবে ওই এলাকায় ভারতের কতৃত্ব চলছে––এমন প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধেই যে তারা রুখে দাঁড়াতে চায়, সেই মানসিকতারও পরিবর্তন প্রয়োজন। একটা সময় এমনও আসে যখন বছরের পর বছর ধরে লালিত ইচ্ছাকে ছাপিয়ে সত্যিটাকেই মেনে নিতে হয় কিন্তু তাতেও এক্ষেত্রে কোনও লাভ হয়নি। আবার প্রায়ই এটাও বলা হয় যে, আশাবাদী হওয়া কোনওভাবেই পরিকল্পনা হতে পারে না আর সময় এসেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এই সরল সত্যিটাকে মেনে নেওয়ার ।
জম্মু–কাশ্মীরকে নিয়ে গৃহীত 2019 সালের আগস্ট মাসে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ভারত–পাকিস্তান–কাশ্মীর নামক ত্রিভুজটিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তের ফলে গোটা সমীকরণ থেকে পাকিস্তানকে কার্যত মুছে ফেলা হয়েছে। 370 ধারা ভারতীয় সংবিধানের একটি বিধান, দ্বিপাক্ষিক কোনও বিষয় নয় আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে এর বিরুদ্ধে গিয়ে অভিযোগ জানালে নামমাত্র সমর্থন ছাড়া আর কিছুই মিলবে না । বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে ।
কাশ্মীর ইস্যুকে ভারত সরকার যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে কিন্তু আবারও মনে রাখতে হবে, এটা আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় আর এক্ষেত্রে পাকিস্তানের গঠনগত কোনও ভূমিকা নেই । জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখের মানুষের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া, স্থানীয় বাসিন্দাদের পরিচয় হারানোর আতঙ্ক, আর্থিক বিকাশ এবং যুবসমাজের চাহিদা মেটানো––এই সব বিষয় কেবল ভারতই সিদ্ধান্ত নিতে পারে । কারগিল যুদ্ধের পর পাকিস্তানের ভিতরেই এই আত্মবিশ্লেষণ করা হয়েছিল যে আদৌ তাদের এই ভয়ঙ্কর পথে এগোনো উচিত ছিল কি না । প্রবীণ কূটনীতিক, শাহিদ এম আমিন লিখেছিলেন, “দেশটির উচিত, নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং অগ্রাধিকারগুলি সম্পর্কে ভয়ঙ্কর রকম বাস্তববাদী হওয়া । সবার প্রথমে গুরুত্ব পাওয়া উচিত পাকিস্তানের অস্তিত্ত্বরক্ষার বিষয়টি, আর তা কাশ্মীর ইস্যুর প্রতি আমাদের টানের কথা মাথায় রেখেই বলছি ।” এবার কোরোনা ভাইরাস নিয়ে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আবারও আগের মতো আত্মনিরীক্ষণের পথে হাঁটে কি না, এখন সেটাই দেখার ।
এটা মনে হতেই পারে যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর শান্তি বজায় রাখার জন্য আমি সব দায়িত্বভার পাকিস্তানের কাঁধেই তুলে দিচ্ছি, কিন্তু সেটাই বাস্তব । সীমান্ত নিয়ে ভারতীয় সেনার অবস্থান আক্রমণাত্মক নয়, যদিও অনুপ্রবেশ রোখার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করতেই শাস্তির বিধান পালন করে তারা । কাজেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনার তীব্রতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে বল এখন পাকিস্তানের কোর্টে । যদিও ভারতের উচিত, নিজেদের ‘আলোচনা নয়’–এর অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা এবং যদি পাকিস্তানের তরফে, নিষ্ঠা সহকারে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে তাতে সাড়া দেওয়া । কোভিড–19 এর মোকাবিলায় SAARC–এর উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালন করেছিলেন, এই সময়ে সেটাই দরকার ।
উভয় দেশই জম্মু–কাশ্মীরের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল কিন্তু এই গোলাগুলির ঘটনায় সীমান্তের দুই পাশে থাকা নিরীহ বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি গোটা মানবসমাজ যে চরম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার দিকে তাকিয়ে ভারত এবং পাকিস্তান, কোনও দেশেরই উচিত নয়, অন্য কোনও সমস্যা যোগ করে, তা আরও বাড়ানো । তবে যদি কোনওভাবে দু’দেশের মধ্যে ফের বিশ্বাসের সেতু সফলভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যায়, তবে তা শুরু করতে হবে দু’পক্ষের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে । আর সেই সেতু গড়ে তুলতে হলে অতীতের সব ধ্যানধারণা ত্যাগ করে এগোতে হবে । আমরা আইস্যাক অ্যসিমোভের পরামর্শ মানতে পারি––“তোমার ধ্যানধারণাগুলি হল বিশ্ব সম্পর্কে তোমার জানলা । কখনও কখনও সেগুলো ঘষে পরিস্কার করা জরুরি, নচেৎ আলো ভিতরে ঢুকতে পারবে না ।”
প্রতিবেদনটি লিখেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ডি এস হুডা (যিনি ২০১৬ সালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন)