ETV Bharat / bharat

অনুপ্রবেশের চেষ্টায় রাশ টানতে হবে পাকিস্তানকে, তবেই কমবে প্রত্যাঘাত

ভয়াবহ বাস্তব এই যে, অদূর ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে কোনওরকম পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শেষ কথা বলবে বন্দুকই। একটা পদক্ষেপ অবশ্য হতে পারে। দু'পক্ষ থেকে লোক দেখানো কথাবার্তা যদি কমানো যায়।

অনুপ্রবেশের চেষ্টায় রাশ টানতে হবে পাকিস্তানকে, তবেই কমবে প্রত্যাঘাত
author img

By

Published : Oct 24, 2019, 1:27 AM IST

ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর রক্তাক্ত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল ২০ অক্টোবর। সেনা জওয়ান এবং গ্রামবাসী মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৯। যদিও নিয়ন্ত্রণরেখার দু'পার থেকেই দাবি করা হয়েছে প্রতিপক্ষের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি করেছে তারা। পাকিস্তানি পোস্ট, জঙ্গিদের লঞ্চ প্যাড গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনার গোলন্দাজ বাহিনী। জেনেরাল বিপিন রাওয়াত বলেছেন, ভারতের প্রত্যাঘাতে "ছয় থেকে দশজন পাকিস্তানি জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে এবং ধ্বংস করা হয়েছে তিনটি জঙ্গিঘাঁটি।" স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান অবশ্য এই বিবৃতিকে নস্যাৎ করেছে । উলটে তাদের দাবি, নয়জন ভারতীয় জওয়ানকে মেরেছে তারা।

প্রতিবার সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ভারত ও পাকিস্তান। ধ্বংস হওয়া সেনাঘাঁটি এবং হতাশাগ্রস্ত সেনাজওয়ানদের ভুয়ো ভিডিও নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে উভয়পারের টুইটার যোদ্ধারা। এই মুহূর্তে সত্যিকারের যে মারণ-দ্বন্দ্বে ফুঁসছে নিয়ন্ত্রণরেখা, এতে করে সেই বাস্তবতা অস্পষ্ট হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গোলাগুলির পরে ২০০৩ সালে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সংঘর্ষবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। এর জেরে এর পরের দশবছর শান্তি আসে। সীমান্তে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ স্বস্তির শ্বাস নেয়। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি তার কারণ যে কোনও সংঘর্ষবিরতিতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা এবং সবথেকে কম সুরক্ষিত থাকে। ২০১৮ সালের মে মাসে পাকিস্তান থেকে গোলাগুলি বর্ষণের জেরে আর্নিয়া সেক্টরে ৭৬ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসীকে তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল। একই ছবি দেখা গিয়েছিল সীমাপারের এলাকাগুলিতে।

আমার মতে, ২০১৩ সালটাতেই সবকিছু পালটে যায়। তার কারণ কাশ্মীরে নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির উন্নতিতে অস্বস্তিতে ছিল পাকিস্তানি সেনা। পাশাপাশি আর একটা কারণ নওয়াজ় শরিফের জয়, যাঁকে ভারতের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন হিসেবে দেখা গিয়েছিল। এই সময়ই সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সংখ্যা বাড়িয়ে; হীরানগর, সাম্বা এবং জ্য়াংলোটে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে আরও ঘোরালো করে তোলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোনও শক্তি।

২০১৪ সালে এমন একটি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, যাদের মনোভাব পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের প্রতি দৃঢ় ও অনমনীয় ছিল। দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। একইসঙ্গে লাফিয়ে বাড়ে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন। ২০১২ সালে যা ছিল প্রায় শ'খানেক, ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় দু'হাজারেরও বেশিতে। আর গতবছর সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সংখ্যা যা ছিল, তা ছাপিয়ে গেছে ২০১৯ সালের প্রথম দশ মাসেই ।

কেন হয় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন ? সর্বজনগ্রাহ্য মত, ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশের সময় কভার ফায়ার দিতে ভারতীয় সেনাছাউনি লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনা। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর যত অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে, তার সংখ্যাই এর প্রমাণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সর্বশেষ বার্ষিক রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪৬১ জন জঙ্গি জম্মু ও কাশ্মীরে ঢোকার চেষ্টা করেছে।

তবে, শুধুমাত্র অনুপ্রবেশের চেষ্টার কারণেই গুলি বিনিময় হয় না। নিয়ন্ত্রণরেখার একটি স্বতন্ত্র জীবন-ছন্দ রয়েছে। দু'পক্ষই চায় শত্রুপক্ষের উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে। এই নৈতিক নিয়ন্ত্রণেচ্ছার তৃষ্ণাতেই, কোনও জওয়ানের শহিদ হওয়ার পর পালটা প্রত্যাঘাত স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিল ২০ অক্টোবর। ভারতের দুই জওয়ান শহিদ হওয়ার পরে। এই 'চোখের বদলে চোখ' মনোভাব অতি প্ররোচনামূলক শোনাতে পারে। কিন্তু আত্মরক্ষামূলক মনোভাব নিলে তা নিয়ন্ত্রণরেখায় মোতায়েন বাহিনীর প্রাণবন্ততা ও আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে থাকে। লিডেল হার্ট (Liddell Hart) যেমন যথার্থ বলেছেন, "the issue of battle is usually decided in the minds of the opposing commanders, not in the bodies of their men".

হিংসার বর্তমান যে চক্রটি চলছে তা থেকে বাঁচার কি কোনও রাস্তা রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো থিওরি হিসেবে বলতে সহজ কিন্তু তা হাতেকলমে করা কঠিন। বল দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানি সেনার কোর্টে। অনুপ্রবেশের চেষ্টায় যদি তারা বাধ দেয়, স্বাভাবিকভাবেই সীমান্তে কমে আসবে হিংসার ঘটনা। কমে যাবে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতও। যদিও, পাকিস্তানি সেনা এই ধরনের পদক্ষেপে যে বিন্দুমাত্র আগ্রহী, তার কোনও ইঙ্গিত অবশ্য নেই। সীমান্তের ওপার থেকে অনুপ্রবেশ যে হচ্ছে তা তারা স্বীকারই করে না।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে ফের তলানিতে। এই অবস্থায় বিশ্বাস অর্জনে দু'পক্ষ থেকেই কোনওরকম পদক্ষেপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেটা সীমান্তে শান্তি আনতে সক্ষম হত।

ভয়াবহ বাস্তব এই যে, অদূর ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে কোনওরকম পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শেষ কথা বলবে বন্দুকই। একটা পদক্ষেপ অবশ্য হতে পারে। দু'পক্ষ থেকে লোক দেখানো কথাবার্তা যদি কমানো যায়। অন্য কারণে যদি নাও বা হয়, অন্তত সামরিক ও অসামরিক শহিদদের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

লেখক- অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনন্ট জেনেরাল ডি এস হুডা

ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর রক্তাক্ত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল ২০ অক্টোবর। সেনা জওয়ান এবং গ্রামবাসী মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৯। যদিও নিয়ন্ত্রণরেখার দু'পার থেকেই দাবি করা হয়েছে প্রতিপক্ষের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি করেছে তারা। পাকিস্তানি পোস্ট, জঙ্গিদের লঞ্চ প্যাড গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনার গোলন্দাজ বাহিনী। জেনেরাল বিপিন রাওয়াত বলেছেন, ভারতের প্রত্যাঘাতে "ছয় থেকে দশজন পাকিস্তানি জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে এবং ধ্বংস করা হয়েছে তিনটি জঙ্গিঘাঁটি।" স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান অবশ্য এই বিবৃতিকে নস্যাৎ করেছে । উলটে তাদের দাবি, নয়জন ভারতীয় জওয়ানকে মেরেছে তারা।

প্রতিবার সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ভারত ও পাকিস্তান। ধ্বংস হওয়া সেনাঘাঁটি এবং হতাশাগ্রস্ত সেনাজওয়ানদের ভুয়ো ভিডিও নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে উভয়পারের টুইটার যোদ্ধারা। এই মুহূর্তে সত্যিকারের যে মারণ-দ্বন্দ্বে ফুঁসছে নিয়ন্ত্রণরেখা, এতে করে সেই বাস্তবতা অস্পষ্ট হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গোলাগুলির পরে ২০০৩ সালে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সংঘর্ষবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। এর জেরে এর পরের দশবছর শান্তি আসে। সীমান্তে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ স্বস্তির শ্বাস নেয়। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি তার কারণ যে কোনও সংঘর্ষবিরতিতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা এবং সবথেকে কম সুরক্ষিত থাকে। ২০১৮ সালের মে মাসে পাকিস্তান থেকে গোলাগুলি বর্ষণের জেরে আর্নিয়া সেক্টরে ৭৬ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসীকে তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল। একই ছবি দেখা গিয়েছিল সীমাপারের এলাকাগুলিতে।

আমার মতে, ২০১৩ সালটাতেই সবকিছু পালটে যায়। তার কারণ কাশ্মীরে নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির উন্নতিতে অস্বস্তিতে ছিল পাকিস্তানি সেনা। পাশাপাশি আর একটা কারণ নওয়াজ় শরিফের জয়, যাঁকে ভারতের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন হিসেবে দেখা গিয়েছিল। এই সময়ই সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সংখ্যা বাড়িয়ে; হীরানগর, সাম্বা এবং জ্য়াংলোটে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে আরও ঘোরালো করে তোলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোনও শক্তি।

২০১৪ সালে এমন একটি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, যাদের মনোভাব পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের প্রতি দৃঢ় ও অনমনীয় ছিল। দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। একইসঙ্গে লাফিয়ে বাড়ে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন। ২০১২ সালে যা ছিল প্রায় শ'খানেক, ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় দু'হাজারেরও বেশিতে। আর গতবছর সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সংখ্যা যা ছিল, তা ছাপিয়ে গেছে ২০১৯ সালের প্রথম দশ মাসেই ।

কেন হয় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন ? সর্বজনগ্রাহ্য মত, ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশের সময় কভার ফায়ার দিতে ভারতীয় সেনাছাউনি লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনা। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর যত অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে, তার সংখ্যাই এর প্রমাণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সর্বশেষ বার্ষিক রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪৬১ জন জঙ্গি জম্মু ও কাশ্মীরে ঢোকার চেষ্টা করেছে।

তবে, শুধুমাত্র অনুপ্রবেশের চেষ্টার কারণেই গুলি বিনিময় হয় না। নিয়ন্ত্রণরেখার একটি স্বতন্ত্র জীবন-ছন্দ রয়েছে। দু'পক্ষই চায় শত্রুপক্ষের উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে। এই নৈতিক নিয়ন্ত্রণেচ্ছার তৃষ্ণাতেই, কোনও জওয়ানের শহিদ হওয়ার পর পালটা প্রত্যাঘাত স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিল ২০ অক্টোবর। ভারতের দুই জওয়ান শহিদ হওয়ার পরে। এই 'চোখের বদলে চোখ' মনোভাব অতি প্ররোচনামূলক শোনাতে পারে। কিন্তু আত্মরক্ষামূলক মনোভাব নিলে তা নিয়ন্ত্রণরেখায় মোতায়েন বাহিনীর প্রাণবন্ততা ও আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে থাকে। লিডেল হার্ট (Liddell Hart) যেমন যথার্থ বলেছেন, "the issue of battle is usually decided in the minds of the opposing commanders, not in the bodies of their men".

হিংসার বর্তমান যে চক্রটি চলছে তা থেকে বাঁচার কি কোনও রাস্তা রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো থিওরি হিসেবে বলতে সহজ কিন্তু তা হাতেকলমে করা কঠিন। বল দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানি সেনার কোর্টে। অনুপ্রবেশের চেষ্টায় যদি তারা বাধ দেয়, স্বাভাবিকভাবেই সীমান্তে কমে আসবে হিংসার ঘটনা। কমে যাবে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতও। যদিও, পাকিস্তানি সেনা এই ধরনের পদক্ষেপে যে বিন্দুমাত্র আগ্রহী, তার কোনও ইঙ্গিত অবশ্য নেই। সীমান্তের ওপার থেকে অনুপ্রবেশ যে হচ্ছে তা তারা স্বীকারই করে না।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে ফের তলানিতে। এই অবস্থায় বিশ্বাস অর্জনে দু'পক্ষ থেকেই কোনওরকম পদক্ষেপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেটা সীমান্তে শান্তি আনতে সক্ষম হত।

ভয়াবহ বাস্তব এই যে, অদূর ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে কোনওরকম পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শেষ কথা বলবে বন্দুকই। একটা পদক্ষেপ অবশ্য হতে পারে। দু'পক্ষ থেকে লোক দেখানো কথাবার্তা যদি কমানো যায়। অন্য কারণে যদি নাও বা হয়, অন্তত সামরিক ও অসামরিক শহিদদের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

লেখক- অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনন্ট জেনেরাল ডি এস হুডা

Intro:ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর রক্তাক্ত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল ২০ অক্টোবর। সেনা জওয়ান এবং গ্রামবাসী মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ৯। যদিও নিয়ন্ত্রণরেখার দু'পার থেকেই দাবি করা হয়েছে প্রতিপক্ষের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি করেছে তারা। পাকিস্তানি পোস্ট, জঙ্গিদের লঞ্চ প্যাড গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনার গোলন্দাজ বাহিনী। জেনেরাল বিপিন রাওয়াত বলেছেন, ভারতের প্রত্যাঘাতে "ছয় থেকে দশজন পাকিস্তানি জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে এবং ধ্বংস করা হয়েছে তিনটি জঙ্গিঘাঁটি।" স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান অবশ্য এই বিবৃতিকে নস্যাৎ করেছে। উলটে তাদের দাবি, নয়জন ভারতীয় জওয়ানকে মেরেছে তারা।

প্রতিবার সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ভারত ও পাকিস্তান। ধ্বংস হওয়া সেনাঘাঁটি এবং হতাশাগ্রস্ত সেনাজওয়ানদের ভুয়ো ভিডিও নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে উভয়পারের টুইটার যোদ্ধারা। এই মুহূর্তে সত্যিকারের যে মারণ-দ্বন্দ্বে ফুঁসছে নিয়ন্ত্রণরেখা, এতে করে সেই বাস্তবতা অস্পষ্ট হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গোলাগুলির পরে ২০০৩ সালে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সংঘর্ষবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয় ভারত ও পাকিস্তান। এর জেরে এর পরের দশবছর শান্তি আসে। সীমান্তে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ স্বস্তির শ্বাস নেয়। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি তার কারণ যে কোনও সংঘর্ষবিরতিতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা এবং সবথেকে কম সুরক্ষিত থাকে। ২০১৮ সালের মে মাসে পাকিস্তান থেকে গোলাগুলি বর্ষণের জেরে আর্নিয়া সেক্টরে ৭৬ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসীকে তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল। একই ছবি দেখা গিয়েছিল সীমাপারের এলাকাগুলিতে।

আমার মতে, ২০১৩ সালটাতেই সবকিছু পালটে যায়। তার কারণ কাশ্মীরে নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির উন্নতিতে অস্বস্তিতে ছিল পাকিস্তানি সেনা। পাশাপাশি আর একটা কারণ নওয়াজ় শরিফের জয়, যাঁকে ভারতের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন হিসেবে দেখা গিয়েছিল। এই সময়ই সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সংখ্যা বাড়িয়ে; হীরানগর, সাম্বা এবং জ্য়াংলোটে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে আরও ঘোরালো করে তোলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোনও শক্তি।

২০১৪ সালে এমন একটি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, যাদের মনোভাব পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের প্রতি দৃঢ় ও অনমনীয় ছিল। দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। একইসঙ্গে লাফিয়ে বাড়ে সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন। ২০১২ সালে যা ছিল প্রায় শ'খানেক, ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় দু'হাজারেরও বেশিতে। আর গতবছর সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সংখ্যা যা ছিল, তা ছাপিয়ে গেছে ২০১৯ সালের প্রথম দশ মাসেই।

কেন হয় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন ? সর্বজনগ্রাহ্য মত, ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশের সময় কভার ফায়ার দিতে ভারতীয় সেনাছাউনি লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনা। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর যত অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে, তার সংখ্যাই এর প্রমাণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সর্বশেষ বার্ষিক রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪৬১ জন জঙ্গি জম্মু ও কাশ্মীরে ঢোকার চেষ্টা করেছে।

তবে, শুধুমাত্র অনুপ্রবেশের চেষ্টার কারণেই গুলি বিনিময় হয় না। নিয়ন্ত্রণরেখার একটি স্বতন্ত্র জীবন-ছন্দ রয়েছে। দু'পক্ষই চায় শত্রুপক্ষের উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে। এই নৈতিক নিয়ন্ত্রণেচ্ছার তৃষ্ণাতেই, কোনও জওয়ানের শহিদ হওয়ার পর পালটা প্রত্যাঘাত স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিল ২০ অক্টোবর। ভারতের দুই জওয়ান শহিদ হওয়ার পরে। এই 'চোখের বদলে চোখ' মনোভাব অতি প্ররোচনামূলক শোনাতে পারে। কিন্তু আত্মরক্ষামূলক মনোভাব নিলে তা নিয়ন্ত্রণরেখায় মোতায়েন বাহিনীর প্রাণবন্ততা ও আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে থাকে। লিডেল হার্ট (Liddell Hart) যেমন যথার্থ বলেছেন, "the issue of battle is usually decided in the minds of the opposing commanders, not in the bodies of their men".

হিংসার বর্তমান যে চক্রটি চলছে তা থেকে বাঁচার কি কোনও রাস্তা রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো থিওরি হিসেবে বলতে সহজ কিন্তু তা হাতেকলমে করা কঠিন। বল দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানি সেনার কোর্টে। অনুপ্রবেশের চেষ্টায় যদি তারা বাধ দেয়, স্বাভাবিকভাবেই সীমান্তে কমে আসবে হিংসার ঘটনা। কমে যাবে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতও। যদিও, পাকিস্তানি সেনা এই ধরনের পদক্ষেপে যে বিন্দুমাত্র আগ্রহী, তার কোনও ইঙ্গিত অবশ্য নেই। সীমান্তের ওপার থেকে অনুপ্রবেশ যে হচ্ছে তা তারা স্বীকারই করে না।

Body:ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে ফের তলানিতে। এই অবস্থায় বিশ্বাস অর্জনে দু'পক্ষ থেকেই কোনওরকম পদক্ষেপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেটা সীমান্তে শান্তি আনতে সক্ষম হত।

ভয়াবহ বাস্তব এই যে, অদূর ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে কোনওরকম পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শেষ কথা বলবে বন্দুকই। একটা পদক্ষেপ অবশ্য হতে পারে। দু'পক্ষ থেকে লোক দেখানো কথাবার্তা যদি কমানো যায়। অন্য কারণে যদি নাও বা হয়, অন্তত সামরিক ও অসামরিক শহিদদের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।Conclusion:লেখক- অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনন্ট জেনেরাল ডি এস হুডা
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.