ETV Bharat / bharat

নয়া শিক্ষানীতি : সম্ভাবনা এবং ত্রুটি

author img

By

Published : Aug 1, 2020, 11:19 AM IST

34 বছর পর বড়সড় রদবদল হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে। এই নীতির মূল লক্ষ্য শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঢেলে সাজানো। প্রতিবেদনটি লিখেছেন কুমার সঞ্জয় সিং ।

নয়া শিক্ষানীতি 2020
নয়া শিক্ষানীতি 2020

2020 সালের 29 জুলাই চালু হওয়া নয়া শিক্ষানীতি (2020) ব্যপ্তিতে সুদূরপ্রসারী এবং এর লক্ষ্য দেশের শিক্ষার পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানো । বাস্তবিকভাবেই প্রাথমিক এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য এর রূপায়ণ হয়েছে। পরিকাঠামোগত এবং শিক্ষাবিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যও এই নীতির অন্তর্ভুক্ত। নয়া শিক্ষানীতিতে আটটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

  • স্কুলিং এবং এলিমেন্টারি স্কুলিং অর্থাৎ পড়ুয়াদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষাদান এবং মৌলিক শিক্ষার বন্দোবস্ত
  • স্কুল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড রিসোর্সেস অর্থাৎ বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো এবং সম্পদ
  • হোলিস্টিক ডেভলপমেন্ট অফ স্টুডেন্টস অর্থাৎ পড়ুয়াদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ
  • ইনক্লুসিভিটি অর্থাৎ সর্বব্যাপী বৈশিষ্ট্য
  • অ্যাসেসমেন্টস অর্থাৎ বিশ্লেষণ
  • কারিকুলাম অ্যান্ড পেডাগগিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্থাৎ পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষাবিজ্ঞানগত রূপরেখা
  • টিচার ফর রিক্রুটমেন্টস/টিচার এডুকেশন অর্থাৎ নিয়োগ করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা/ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠ্যক্রম
  • রোল অফ গর্ভমেন্ট ডিপার্টমেন্টস/বডিস/ইনস্টিটিউশনস অর্থাৎ সরকারি দপ্তর/কর্তৃপক্ষ/প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা

শিক্ষার এই প্রধান বিভাগগুলির রূপান্তর ঘটিয়ে সরকার চাইছে শিক্ষাক্ষেত্রের ভিত আরও মজবুত করতে এবং 2035 সালের মধ্যে গ্রস এনরোলমেন্টের অনুমান বাড়িয়ে 50 শতাংশ করতে। শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সৃষ্টিশীলতা আনার মাধ্যমে সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হল ‘ভারতকে বিশ্বব্যপী জ্ঞানের সেরাশক্তি’ হিসাবে গড়ে তুলতে। শিক্ষাবিজ্ঞানের নিরিখে এর জন্য জরুরি হল প্রাথমিক এবং উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রমে বড়সড় তথা গভীর বদল আনা। স্কুল স্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা হল মাতৃভাষার উন্নতি। কারণ, অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষাকেই শিক্ষাদানের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হল ‘লিবারেল আর্টস’-এর উপর জোর দেওয়া, যা শিক্ষাগত শৃঙ্খলা এবং কারিগরি জ্ঞানের সংমিশ্রণ। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘লিবারেল আর্টস’ দৃষ্টিভঙ্গি আরোপের মাধ্যমে কারিগরি জ্ঞানের প্রচার করা হয়। স্কুল শিক্ষাকে ভিত্তিগঠনকারী স্তর (বয়স 3 থেকে 8 বছর), প্রস্তুতি স্তর (বয়স 8 থেকে 11 বছর), মধ্যবর্তী স্তর (বয়স 11 থেকে 14 বছর) এবং মাধ্যমিক স্তর (14 থেকে 18 বছর)।

‘লিবারেল আর্টস’ দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করা এবং সহগামী কারিগরি শিক্ষার উপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা উচ্চশিক্ষাতেও প্রসারিত করা হচ্ছে যেখানে একে প্রতিপালন করা হচ্ছে ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম’ (CBCS)-এ। উচ্চশিক্ষায় ‘লিবারেল আর্টস’ প্রোগ্রামে শিক্ষাগত শৃঙ্খলার সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানের সংমিশ্রণ রয়েছে এবং এটিতে কোনও পড়ুয়ার কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের উপর কর্মদক্ষতা দাবি করে না। এছাড়াও তিন বছরের স্নাতক স্তরের শিক্ষাকে, কলা এবং বিজ্ঞান বিভাগে বাড়িয়ে চার বছর করে দেওয়া হয়েছে। যদিও পড়ুয়ার কাছে বিকল্প রয়েছে এক বছর (সার্টিফিকেট প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে), দু’বছর (ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম) অথবা তিন বছর (ডিগ্রি প্রোগ্রামে) পর কোর্স ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারার। শুধুমাত্র যারা গবেষণায় কেরিয়ার গড়তে চায়, তাদেরই চতুর্থ বর্ষের পড়াশোনা শেষ করতে হবে। পড়ুয়াদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা যতদূর পড়েছে, সেই ক্রেডিট ‘সেভ’ করা এবং কিছু সময় পর ফিরে এসে কোর্সে ‘রিজয়েন’ করার বিকল্পও আছে ।

শিক্ষানীতিতে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির সামগ্রিক স্তরে পরিকাঠামো পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে। যার সূচনাতেই রয়েছে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে নাম বদলে শিক্ষামন্ত্রক হওয়া। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের হাতে থাকা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ (RSA) হবে সেই শীর্ষ কর্তৃপক্ষ যারা দেশে শিক্ষার সম্পদ ও দক্ষতার উৎপত্তি, সংবহন এবং চালনা সংক্রান্ত সমস্ত স্তর এবং প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, নজরদারি চালাবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে। এর আওতায় থাকবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং শীর্ষ আমলারা। এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের মাধ্যমে RSA শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ, পর্যালোচনা এবং নজরদারি সংক্রান্ত সমস্ত পরিকল্পনাগুলিকে পরিচালনা করবে। এর আওতাতেই পৃথকভাবে শিক্ষার জন্য তহবিল গড়া হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হবে, কৃতিত্ব আরোপ করা হবে এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান (HEI) গুলিকে নিয়ন্ত্রণও করা হবে। বেসরকারি এবং সরকারি HEI-গুলির জন্য একই নজরদারি কর্তৃপক্ষ এবং ফলাফল বিশ্লেষণের একই মাপকাঠি গড়ে তোলা হবে। অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য তিন ধরনের বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে-

  • মাল্টিডিসিপ্লিনারি তথা বহুবিভাগীয় রিসার্চ ইউনিভার্সিটি
  • মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিচিং ইউনিভার্সিটি
  • অটোনোমাস মাল্টিডিসিপ্লিনারি কলেজ

এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ফ্যাকাল্টি পদে নিয়োগ এবং নিযুক্তদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে মেধাকেই নিয়ামক করার কথা বলা হয়েছে। এই বিপুল স্তরের সংস্কার কার্যকর করতে গেলে গোড়াতে যে কোনও সমস্যা হবে না, তা মনে করাটা ছেলেমানুষি। সুতরাং নয়া শিক্ষানীতি 2020-র মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষা সংস্কারকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে গোড়ায় কী কী সমস্যা আসতে পারে, সমীক্ষার মাধ্যমে তার সার সংক্ষেপ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন ইউরোপে 1998-99 সালে বোলোগনা কনভেনশন চালু করা হয়েছিল। এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির জন্য সংস্কারমুখী যে লক্ষ্য রাখা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ত্রিস্তরীয় ডিগ্রি পরিকাঠামো (ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট) এবং ‘অ্যাডপটেড শেয়ারড ইনস্ট্রুমেন্টস’ যেমন ইউরোপিয়ান ক্রেডিটস ট্রান্সপার অ্যান্ড অ্যাকিউমুলেশন সিস্টেম (ECTS) এবং দা ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড গাইডলাইন্স ফর কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স ইন দা ইউরোপিয়ান হায়ার এডুকেশন এরিয়া (ESG)। এছাড়াও এতে গুণগত মানের আশ্বাস থাকায় পড়ুয়া থেকে শুরু করে স্নাতকরা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এবং এর সঙ্গে যুক্ত বাকি সকলেই বিভিন্ন বিভাগের উৎকর্ষ এবং কাজের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল।

নয়া শিক্ষানীতি (2020) কি সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকে এড়িয়ে যেতে পারবে?

এটাই বর্তমানে তর্কযোগ্য প্রশ্ন। ঠিক এই প্রসঙ্গেই নীতিগতভাবে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনও উত্তরই মিলছে না। এই শিক্ষানীতির লক্ষ্য এবং বর্তমান পরিস্থিতির সামনে প্রথম যে বাধা এসে উপস্থিত হয়েছে, তা হল গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও 2035 সালের মধ্যে বাড়িয়ে 50 শতাংশ করে দেওয়া নিয়ে। এই বিপুল বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক শিক্ষাখাতে পরিকাঠামো অনেকটাই বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু তার জন্য অর্থ আসবে কোথা থেকে ? সেই দিক দিয়ে বিচার করলে এই নীতি সম্ভাব্য, কারণ এতে বেসরকারি এবং মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠানের তরফে অনুদানের আশা করা হয়েছে। যদিও ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, গ্রামীণ স্তরে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অনুদান ইতিপূর্বে খুব কমই এসেছে। অনলাইন ডিসট্যান্স লার্নিং (ODL) এবং ম্যাসিভ অনলাইন কোর্সেসের (MOOCs) মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ করলে, তা GER 50 শতাংশ বৃদ্ধি করতে তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতিপন্ন হবে। যদিও কোভিড-19 লকডাউনের সময় অনলাইন পড়াশোনার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছে, তাতে স্পষ্ট এই শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির একপ্রকার বিপক্ষেই, যাদের কাছে এই কোর্স করার জন্য জরুরি ইলেকট্রনিক সরঞ্জামই নেই।

এই শিক্ষানীতিতে বর্তমানে বাজার উপযোগী কোর্সগুলির সমর্থনে সওয়াল করা হয়েছে, যার জেরে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় দুর্বলতা কাটার আশা জোরালো হতে পারে। স্নাতক স্তরে চার বছরের কোর্স চালু করায় অতিরিক্ত এক বছর শিক্ষাতেই নিয়োজিত হবে যদিও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির পক্ষে তা এক রকম দুর্বলতাই বটে। আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাব, মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বহু ছেলে মেয়েই হয়তো আর্থিক অনটনের জেরে গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার দিকে না গিয়ে, চার বছরের কোর্সের মেয়াদ সম্পূর্ণ না করেই বেরিয়ে আসছে। এই সম্ভাবনা আরও জোরালো হয়েছে। কারণ নয়া শিক্ষা নীতিতে বেতন মিটানোর জন্য শিক্ষা ঋণের হয়ে তদবির করা হয়েছে। শিল্প এবং বাণিজ্য মহলে আরও বেশি গবেষণার চাহিদা মেটাতে, HEI-গুলিতে পড়ুয়াদের গবেষণা করার জন্য সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতিতে সওয়াল করা হয়েছে। এইভাবে, বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান, উভয়ক্ষেত্রেই থিয়োরি বিভাগে আগাম গবেষণা করার প্রয়োজন আর থাকবে না। এই শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হল, তা সত্যিই কার্যকর হয়, না লাল ফিতের ফাঁসে ঝুলে থাকে, সেটাই দেখার।

(প্রতিবেদনটি লিখেছেন কুমার সঞ্জয় সিং ৷ তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্বামী শ্রদ্ধানন্দ কলেজের ইতিহাস বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর৷)

2020 সালের 29 জুলাই চালু হওয়া নয়া শিক্ষানীতি (2020) ব্যপ্তিতে সুদূরপ্রসারী এবং এর লক্ষ্য দেশের শিক্ষার পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানো । বাস্তবিকভাবেই প্রাথমিক এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য এর রূপায়ণ হয়েছে। পরিকাঠামোগত এবং শিক্ষাবিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যও এই নীতির অন্তর্ভুক্ত। নয়া শিক্ষানীতিতে আটটি বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

  • স্কুলিং এবং এলিমেন্টারি স্কুলিং অর্থাৎ পড়ুয়াদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষাদান এবং মৌলিক শিক্ষার বন্দোবস্ত
  • স্কুল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড রিসোর্সেস অর্থাৎ বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো এবং সম্পদ
  • হোলিস্টিক ডেভলপমেন্ট অফ স্টুডেন্টস অর্থাৎ পড়ুয়াদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ
  • ইনক্লুসিভিটি অর্থাৎ সর্বব্যাপী বৈশিষ্ট্য
  • অ্যাসেসমেন্টস অর্থাৎ বিশ্লেষণ
  • কারিকুলাম অ্যান্ড পেডাগগিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্থাৎ পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষাবিজ্ঞানগত রূপরেখা
  • টিচার ফর রিক্রুটমেন্টস/টিচার এডুকেশন অর্থাৎ নিয়োগ করার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা/ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠ্যক্রম
  • রোল অফ গর্ভমেন্ট ডিপার্টমেন্টস/বডিস/ইনস্টিটিউশনস অর্থাৎ সরকারি দপ্তর/কর্তৃপক্ষ/প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা

শিক্ষার এই প্রধান বিভাগগুলির রূপান্তর ঘটিয়ে সরকার চাইছে শিক্ষাক্ষেত্রের ভিত আরও মজবুত করতে এবং 2035 সালের মধ্যে গ্রস এনরোলমেন্টের অনুমান বাড়িয়ে 50 শতাংশ করতে। শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সৃষ্টিশীলতা আনার মাধ্যমে সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হল ‘ভারতকে বিশ্বব্যপী জ্ঞানের সেরাশক্তি’ হিসাবে গড়ে তুলতে। শিক্ষাবিজ্ঞানের নিরিখে এর জন্য জরুরি হল প্রাথমিক এবং উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রমে বড়সড় তথা গভীর বদল আনা। স্কুল স্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা হল মাতৃভাষার উন্নতি। কারণ, অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষাকেই শিক্ষাদানের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হল ‘লিবারেল আর্টস’-এর উপর জোর দেওয়া, যা শিক্ষাগত শৃঙ্খলা এবং কারিগরি জ্ঞানের সংমিশ্রণ। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘লিবারেল আর্টস’ দৃষ্টিভঙ্গি আরোপের মাধ্যমে কারিগরি জ্ঞানের প্রচার করা হয়। স্কুল শিক্ষাকে ভিত্তিগঠনকারী স্তর (বয়স 3 থেকে 8 বছর), প্রস্তুতি স্তর (বয়স 8 থেকে 11 বছর), মধ্যবর্তী স্তর (বয়স 11 থেকে 14 বছর) এবং মাধ্যমিক স্তর (14 থেকে 18 বছর)।

‘লিবারেল আর্টস’ দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করা এবং সহগামী কারিগরি শিক্ষার উপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা উচ্চশিক্ষাতেও প্রসারিত করা হচ্ছে যেখানে একে প্রতিপালন করা হচ্ছে ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম’ (CBCS)-এ। উচ্চশিক্ষায় ‘লিবারেল আর্টস’ প্রোগ্রামে শিক্ষাগত শৃঙ্খলার সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানের সংমিশ্রণ রয়েছে এবং এটিতে কোনও পড়ুয়ার কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের উপর কর্মদক্ষতা দাবি করে না। এছাড়াও তিন বছরের স্নাতক স্তরের শিক্ষাকে, কলা এবং বিজ্ঞান বিভাগে বাড়িয়ে চার বছর করে দেওয়া হয়েছে। যদিও পড়ুয়ার কাছে বিকল্প রয়েছে এক বছর (সার্টিফিকেট প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে), দু’বছর (ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম) অথবা তিন বছর (ডিগ্রি প্রোগ্রামে) পর কোর্স ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারার। শুধুমাত্র যারা গবেষণায় কেরিয়ার গড়তে চায়, তাদেরই চতুর্থ বর্ষের পড়াশোনা শেষ করতে হবে। পড়ুয়াদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা যতদূর পড়েছে, সেই ক্রেডিট ‘সেভ’ করা এবং কিছু সময় পর ফিরে এসে কোর্সে ‘রিজয়েন’ করার বিকল্পও আছে ।

শিক্ষানীতিতে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির সামগ্রিক স্তরে পরিকাঠামো পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে। যার সূচনাতেই রয়েছে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে নাম বদলে শিক্ষামন্ত্রক হওয়া। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের হাতে থাকা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ (RSA) হবে সেই শীর্ষ কর্তৃপক্ষ যারা দেশে শিক্ষার সম্পদ ও দক্ষতার উৎপত্তি, সংবহন এবং চালনা সংক্রান্ত সমস্ত স্তর এবং প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, নজরদারি চালাবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে। এর আওতায় থাকবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং শীর্ষ আমলারা। এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের মাধ্যমে RSA শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ, পর্যালোচনা এবং নজরদারি সংক্রান্ত সমস্ত পরিকল্পনাগুলিকে পরিচালনা করবে। এর আওতাতেই পৃথকভাবে শিক্ষার জন্য তহবিল গড়া হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হবে, কৃতিত্ব আরোপ করা হবে এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান (HEI) গুলিকে নিয়ন্ত্রণও করা হবে। বেসরকারি এবং সরকারি HEI-গুলির জন্য একই নজরদারি কর্তৃপক্ষ এবং ফলাফল বিশ্লেষণের একই মাপকাঠি গড়ে তোলা হবে। অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য তিন ধরনের বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে-

  • মাল্টিডিসিপ্লিনারি তথা বহুবিভাগীয় রিসার্চ ইউনিভার্সিটি
  • মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিচিং ইউনিভার্সিটি
  • অটোনোমাস মাল্টিডিসিপ্লিনারি কলেজ

এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ফ্যাকাল্টি পদে নিয়োগ এবং নিযুক্তদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে মেধাকেই নিয়ামক করার কথা বলা হয়েছে। এই বিপুল স্তরের সংস্কার কার্যকর করতে গেলে গোড়াতে যে কোনও সমস্যা হবে না, তা মনে করাটা ছেলেমানুষি। সুতরাং নয়া শিক্ষানীতি 2020-র মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষা সংস্কারকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে গোড়ায় কী কী সমস্যা আসতে পারে, সমীক্ষার মাধ্যমে তার সার সংক্ষেপ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন ইউরোপে 1998-99 সালে বোলোগনা কনভেনশন চালু করা হয়েছিল। এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির জন্য সংস্কারমুখী যে লক্ষ্য রাখা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ত্রিস্তরীয় ডিগ্রি পরিকাঠামো (ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট) এবং ‘অ্যাডপটেড শেয়ারড ইনস্ট্রুমেন্টস’ যেমন ইউরোপিয়ান ক্রেডিটস ট্রান্সপার অ্যান্ড অ্যাকিউমুলেশন সিস্টেম (ECTS) এবং দা ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড গাইডলাইন্স ফর কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স ইন দা ইউরোপিয়ান হায়ার এডুকেশন এরিয়া (ESG)। এছাড়াও এতে গুণগত মানের আশ্বাস থাকায় পড়ুয়া থেকে শুরু করে স্নাতকরা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এবং এর সঙ্গে যুক্ত বাকি সকলেই বিভিন্ন বিভাগের উৎকর্ষ এবং কাজের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল।

নয়া শিক্ষানীতি (2020) কি সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকে এড়িয়ে যেতে পারবে?

এটাই বর্তমানে তর্কযোগ্য প্রশ্ন। ঠিক এই প্রসঙ্গেই নীতিগতভাবে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনও উত্তরই মিলছে না। এই শিক্ষানীতির লক্ষ্য এবং বর্তমান পরিস্থিতির সামনে প্রথম যে বাধা এসে উপস্থিত হয়েছে, তা হল গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও 2035 সালের মধ্যে বাড়িয়ে 50 শতাংশ করে দেওয়া নিয়ে। এই বিপুল বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক শিক্ষাখাতে পরিকাঠামো অনেকটাই বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু তার জন্য অর্থ আসবে কোথা থেকে ? সেই দিক দিয়ে বিচার করলে এই নীতি সম্ভাব্য, কারণ এতে বেসরকারি এবং মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠানের তরফে অনুদানের আশা করা হয়েছে। যদিও ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, গ্রামীণ স্তরে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অনুদান ইতিপূর্বে খুব কমই এসেছে। অনলাইন ডিসট্যান্স লার্নিং (ODL) এবং ম্যাসিভ অনলাইন কোর্সেসের (MOOCs) মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ করলে, তা GER 50 শতাংশ বৃদ্ধি করতে তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতিপন্ন হবে। যদিও কোভিড-19 লকডাউনের সময় অনলাইন পড়াশোনার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছে, তাতে স্পষ্ট এই শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির একপ্রকার বিপক্ষেই, যাদের কাছে এই কোর্স করার জন্য জরুরি ইলেকট্রনিক সরঞ্জামই নেই।

এই শিক্ষানীতিতে বর্তমানে বাজার উপযোগী কোর্সগুলির সমর্থনে সওয়াল করা হয়েছে, যার জেরে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় দুর্বলতা কাটার আশা জোরালো হতে পারে। স্নাতক স্তরে চার বছরের কোর্স চালু করায় অতিরিক্ত এক বছর শিক্ষাতেই নিয়োজিত হবে যদিও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির পক্ষে তা এক রকম দুর্বলতাই বটে। আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাব, মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বহু ছেলে মেয়েই হয়তো আর্থিক অনটনের জেরে গবেষণা বা উচ্চশিক্ষার দিকে না গিয়ে, চার বছরের কোর্সের মেয়াদ সম্পূর্ণ না করেই বেরিয়ে আসছে। এই সম্ভাবনা আরও জোরালো হয়েছে। কারণ নয়া শিক্ষা নীতিতে বেতন মিটানোর জন্য শিক্ষা ঋণের হয়ে তদবির করা হয়েছে। শিল্প এবং বাণিজ্য মহলে আরও বেশি গবেষণার চাহিদা মেটাতে, HEI-গুলিতে পড়ুয়াদের গবেষণা করার জন্য সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতিতে সওয়াল করা হয়েছে। এইভাবে, বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান, উভয়ক্ষেত্রেই থিয়োরি বিভাগে আগাম গবেষণা করার প্রয়োজন আর থাকবে না। এই শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হল, তা সত্যিই কার্যকর হয়, না লাল ফিতের ফাঁসে ঝুলে থাকে, সেটাই দেখার।

(প্রতিবেদনটি লিখেছেন কুমার সঞ্জয় সিং ৷ তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্বামী শ্রদ্ধানন্দ কলেজের ইতিহাস বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর৷)

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.