ক্ষমতায় যে দলই থাকুক , কারণ দল বিশেষে নির্দিষ্ট বিদেশ নীতি হয় , প্রতিরক্ষা কর্মসূচি প্রভৃতি থাকে তাই , তাদের একটি নির্দিষ্টি শিক্ষানীতিও থাকা উচিত–এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা প্রশংসনীয় এবং আন্তরিকভাবে স্বাগত ।
গত কয়েক দশক ধরে, দেশ গঠনের মতো মজবুত ও স্থায়ী শিক্ষাব্যবস্থার অভাবে ভারত অনেক কিছু হারিয়েছে । পড়ুয়াদের বইয়ে ঠাসা, ভারি ব্যাগের চাপ, পরীক্ষার উদ্বেগ থেকে মুক্তি দিতে এবং তাদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এবং সৃষ্টিশীলচিন্তাভাবনার প্রবণতা বাড়াতে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির প্রবর্তন করে মোদি সরকার বর্তমানে বহুধা—বিস্তৃত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে ।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি বলেছেন, দেশে অন্য কোনও রাজ্যের আগে, তারা এই নীতির প্রয়োগ ঘটাবে সেখানেই আবার তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গ এই নীতিরূপায়ণ নিয়ে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে । আপত্তি উঠছে যে, কেন্দ্র শিক্ষাদানকে জনপরিষেবা বলে উল্লেখ করেছে । তারা কেন শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ করা নিয়ে প্রস্তাবে কিছুই বলেনি ? সমালোচনার পাশাপাশি পরামর্শও ধেয়ে আসছে সামগ্রিক প্রচেষ্টা, পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ এবং প্রযুক্তিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার আগ্রহ নিয়ে । এটা স্বাভাবিক যে, গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তনের প্রস্তাব এলে, তা নিয়ে বিরোধিতা হবেই । কাজেই জরুরি হল, সমস্ত সন্দেহ এবং ধন্দকে সরিয়ে রেখে, সার্বিকভাবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে এগনো । নয়া শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে সরকারের হস্তক্ষেপ ন্যূনতমহবে–এই মর্মে প্রধানমন্ত্রীর জনগণকে আশ্বাসকে সকলের স্বাগত জানানো উচিত ।
মজবুত শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে মানবসম্পদের উৎকর্ষতা বাড়বে এবং দেশগঠনকারী কার্যকলাপে তার সর্বাধিক প্রয়োগ ত্বরান্বিত হবে । সেই স্বপ্ন যদি পূরণ হতে পারে, তাহলেই এই অনুশীলন সফল হবে । যে শিক্ষা বর্তমান সময়ের উপযোগী নয়, যা ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতেপারে না ।যে সব ডিগ্রি ভবিষ্যতে স্বচ্ছ্বল জীবনযাপনের আশ্বাস দিতে পারে না... এই সবই হল বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দুর্দশাসমূহ, যা কোমায় পৌঁছে গিয়েছে ।
বর্তমানে যে ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তাতে শিক্ষা ব্যবস্থার স্তর যত বেড়েছে, ততই বেশি হয়েছে কর্মসংস্থানের ঝুঁকি, যার ফলে মানবসম্পদের তীব্র অপব্যবহার হচ্ছে । চার বছর আগে UNESCO-র এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, স্কুল স্ট্যান্ডার্ডের নিরিখে ভারত 50বছর পিছিয়ে আছে । নয়া শিক্ষানীতিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ‘উৎকৃষ্ট শিক্ষা পড়ুয়ার অধিকার’ ।
পড়তি গুণমানের ক্রমোন্নয়নের দিকে সরকারের নজর দেওয়া, টিচিং স্টাফদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মজবুত ভিত্তি গড়তে সরকারের তরফে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রচলন প্রশংসনীয় । যদি প্রাইভেট শিক্ষকদের জন্য ‘TET’ (টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট) বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয় এবং তা 100% কার্যকর করা হয় তবে তা হবে প্রথম সাফল্য ।
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের মতে, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ হয় । প্রধানমন্ত্রীও বিশ্বাস করেন যে, নির্দেশ যদি মাতৃভাষায় দেওয়া হয় তাহলে তা পড়ুয়াদের মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে । এছাড়াও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ফলে স্বাভাবিক চিন্তার প্রক্রিয়ার বিকাশ হয় ।
আমাদের সংস্কৃতি—সাহিত্যের গরিমা এবং ঐতিহ্য একটি মজবুত দেশ গড়ে তুলতে সক্ষম, পড়ুয়াদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, চরিত্র গঠন করে এবং নীতিবোধের সঞ্চার ঘটিয়ে । তবে, নীতিগত বয়ান হল এক জিনিস আর বাস্তবায়নের সাফল্য হল অন্য জিনিস । এক্ষেত্রে কেন্দ্রের উচিত বড় ভূমিকা পালন করা এবং সমস্ত রাজ্যগুলিকে বোঝানো যাতে তারা কোনওরকম মতবিরোধ না করে একজোট হয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের হয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় ।
দেশজুড়ে যত শিক্ষার সংস্কারের উদ্যম ছড়িয়ে পড়বে, ততই কর্মসংস্থানের নিয়মনীতির সামগ্রিক সংস্কারসাধনের উদ্যোগও গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়বে । কেন্দ্রকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার সক্রিয় প্রচারে তারা পিছিয়ে থাকবে না এবং রাজ্যগুলিকে এই ক্ষেত্রে হওয়া আর্থিক বোঝা লাঘব করতে সাহায্য করবে । পূর্বের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, 2030 সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে যে 90 কোটি যুবা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যথাযথ দক্ষতার অভাব বোধ করবে, তাদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যাই বেশি থাকবে । এই উদ্বেগ প্রশমন করতে নয়া শিক্ষানীতিতে পড়ুয়াদের প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সামগ্রিক বিকাশ সুনিশ্চিত করতে হবে এবং জীবন ও জীবনযাত্রার সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য ক্ষমতাশালী হতে প্রস্তুতি নিতে হবে ।