বায়ু দূষণ এবং বায়ুর মানগত অবনতি মানুষের জীবনযাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে । দিল্লির বর্তমান অবস্থা একথাই প্রমাণ করে । মানুষের দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে । একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা 153টি দেশের মধ্যে তুলনা করার পর 11,258 জন বিজ্ঞানী পরিবেশ নিয়ে সতর্কতা জারি করেছেন । অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, সুনামি, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি, হিমবাহের দ্রুত গলন, সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধির মতো ঘটনা পরিবেশের উপর একটা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, একটা প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করছে । শিল্পায়ন, শহরায়ন, উন্নয়ন প্রাকৃতিক ভারসাম্যের বণ্টনকে নষ্ট করছে । মানব সভ্যতার আদি যুগে মানুষ শিকারি হিসেবে জীবন ধারণ করত । উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের চাহিদা পূরণ করতে মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদকে নষ্ট করতে শুরু করে । গ্রিন হাউস গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত নির্গমন বায়ু, জল এবং খাদ্যকে দূষিত করছে ।
দিল্লি এবং তার চারপাশে এলাকার বায়ু সূচকের (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) মান মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । ভৌগোলিক বিষয়টার থেকে এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভূমিকা । দীপাবলির বাজি এবং ফসলের গোড়া পোড়ানোর ঘটনায় দিল্লির AQI-এর মান 500 ছাড়িয়ে গেছে । মোটের উপর এই মান 400-500 মধ্যে থাকলে, বলতে হবে পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ । দূষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে AQI-এর মান 500-এর বেশি হওয়ার অর্থ অত্যন্ত বিপজ্জনক । বায়ুর গুণগতমান প্রতিদিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তা দিল্লির দৈনিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কুপ্রভাব ফেলছে । মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হওয়ার সাহস দেখাতে পাচ্ছেন না মানুষজন, যা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিকে তুলে ধরছে । শুধুমাত্র দিল্লি নয়, গুরুগ্রাম, গাজিয়াবাদ, নয়ডা, ফরিদাবাদও বায়ু দূষণের যন্ত্রণা ভোগ করছে । মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, ছত্তিশগড় এবং তেলঙ্গানার বেশ কিছু রাজ্যে টক্সিন নির্গমনের ছবিটা ধরা পড়েছে । জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই এই বিপদকে আরও গতিদান করছে । শীতের কুয়াশা, গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, কলকারখানা থেকে নির্গত গ্যাস শ্বাসকার্য চালানোর ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে । দিল্লির প্রতিবেশি দুই রাজ্য পঞ্জাব এবং হরিয়ানা কৃষির দিক থেকে অত্যন্ত এগিয়ে । এই দুই রাজ্যে কৃষির উৎপাদনও বেশ ভালো, সেখানেই হচ্ছে চাষের জমিতে থাকা ফসলের গোড়া পোড়ানোর মতো বিষয়টি । এক টন ফসলের গোড়া পোড়ানোর ফলে 60 কিলোগ্রাম কার্বন এবং 1400 কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় । 3 কিলোগ্রাম সুক্ষ্ম কণা, ছাই এবং সালফার ডাই অক্সাইড অতিরিক্তভাবে পরিবেশে সংযুক্ত হয় । হরিয়ানা, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশ প্রতি বছর পাঁচ কোটি টন ফসল পোড়ায় । এর প্রভাব পড়ে দিল্লিতে ৷ শীতকালে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে ।
ফসল পোড়ানোর ঘটনা জমির উর্বরতা নষ্ট করে । অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফসল পোড়ানোর ফলে উপকৃত ব্যাকটেরিয়া মারা যায় । জমির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে । ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও তা সমস্যা তৈরি করে । ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুন্যাল (NGT) চাষের জমিতে থাকা ফসলের গোড়া পোড়ানো চার বছর আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে । যদিও এখনও পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই এই নির্দেশিকা মানা হয় না । আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনার জন্য বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বাড়ছে । বাড়ছে বায়ু দূষণ । দেশব্যাপী 23 শতাংশ মৃত্যুর কারণ বায়ু দূষণ । মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের হিসেব বলছে, প্রতি আট জনের মধ্যে এক জনের মৃত্যু ঘটছে বায়ু দূষণের জন্য । AIIMS সতর্ক করে বলেছে, দিল্লিতে হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ু দূষণের জেরে । 180 টি দেশের মধ্যে AQI হিসেবে ভারতের স্থান খুবই নিচের দিকে । ভারতের দুই তৃতীয়াংশ শহর কার্যত গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে ।
পড়ে থাকা ফসল পোড়ানোর বদলে বিকল্প কী করা যায়, তা অতি দ্রুত বের করতে হবে । ফসল পোড়ানো থেকে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব কি না, সে বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে । যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি, সেখানকার কৃষকদের ধান-গম চাষের বদলে বাজরা চাষের জন্য উৎসাহিত করতে হবে । গাড়ির ধোঁয়া কমানোর বিষয়ে জোড়-বিজোড় নীতি বিশেষভাবে কার্যকর । গণপরিবহনকে আরও জোরদার করতে হবে । যে সব কলকারখানা থেকে টক্সিন নির্গত হয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম পদক্ষেপ করতে হবে । দূষণের কুপ্রভাবের বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষকে আরও বেশি করে অবগত করতে হবে । অস্ট্রেলিয়া, বার্বাডোস, কানাডায় AQI-এর মান খুব ভালো । এই সকল দেশকে অনুসরণ করে ভারতকে প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে হবে ।