পূর্ব লাদাখ ঘিরে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তিশালী দেশ, ভারত এবং চিনের সেনা সংঘাতের মূল কারণ শুধুমাত্র তাদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন অথবা ভূ-রাজনৈতিক রণকৌশল নাও হতে পারে । আসলে পূর্ব দিকের অংশ সহ ওই সমগ্র এলাকায় বিপুল পরিমাণ হাইড্রোকার্বনের ভাণ্ডার রয়েছে । রয়েছে তেল এবং গ্যাস । যার থেকে বিপুল পরিমাণে ভূ-তাপীয় শক্তিসম্পদ আহরণ করা সম্ভব ।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পূর্ব লাদাখের আকসাই চিন সম্পর্কে যে বিখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন (এখানে ঘাসের একটা ছড়াও জন্মায় না) তা এখন আর খাটে না । কারণ সমীক্ষায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে , এই শীতল মরু এলাকায় হাইড্রোকার্বনের বিপুল ভাণ্ডার মজুত রয়েছে ।
আর ভারত এবং চিনের মতো শক্তিসম্পদের ঘাটতি থাকা দুই দেশ, যেখানে পেট্রেল এবং পেট্রেলজাত পণ্য যেমন ডিজ়েলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় আর চাহিদা মেটাতে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয় । সেখানে এই হাইড্রোকার্বনের ভাণ্ডার ভবিষ্যতে শক্তি-সম্পদের চাহিদাজনিত নিরাপত্তায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে ।
ভারতকে যেখানে তেলের চাহিদা মেটাতে 82 শতাংশেরও বেশি অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেখানেই 2022 সালের মধে্য এই হার 67 শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য একাধিক স্তরে প্রচেষ্টা চলছে । এই তালিকায় রয়েছে স্থানীয় স্তরে খনিজ তেলের অনুসন্ধান , পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি-সম্পদের ব্যবহার এবং স্বদেশীয় ইথানল জ্বালানির ব্যবহার প্রভৃতি । অন্যদিকে, চিনকে তাদের তেলের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে অন্তত 77 শতাংশ তৈল সম্পদ আমদানি করতে হয় ।
বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত , অথচ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (কারণ এই বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলার অধিকার তাঁর নেই) ONGC-র শীর্ষস্তরের এক আধিকারিক ETV ভারত-কে জানিয়েছেন , “অনেক আগে থেকেই আমরা লাদাখের এই শক্তি-সম্পদের ভাণ্ডার সম্পর্কে জানতাম । আর এও জানতাম যে , এখানে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোকার্বন মজুত আছে । এই প্রাচুর্যের কারণ , এই এলাকার বিশাল একটি অংশ লাখ লাখ বছর আগে টেথিস সাগরের তলদেশ এলাকা ছিল , যা পরবর্তীকালে প্লেট-টেকটনিক শক্তির জেরে ভাঁজ হয়ে উপরে উঠে হিমালয় পর্বতের পশ্চিম ও মধ্য ভাগ গঠন করে । সুতরাং , সমুদ্র তলদেশবর্তী এই এলাকায় যে হাইড্রোকার্বনের অফুরান ভাণ্ডার থাকবে, তা যথেষ্ট স্বাভাবিক ব্যাপার ।”
লাদাখের জান্সকার পর্বতের 70 কিলোমিটার প্রশস্ত এলাকা টেথিয়ান হিমালয়ের অধিকৃত আর এই অংশে ভবিষ্যতে শেল গ্যাস বা শেল তেলের ভাণ্ডার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে । তিব্বত মালভূমির দক্ষিণের প্রান্তভাগ থেকে এটি ক্রমশ পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়েছে , আর পশ্চিমে এটি জান্সকার পর্বতশ্রেণিকে ছুঁয়েছে । পশ্চিম হিমালয়ে টেথিয়ান হিমালয় প্রসারিত হয়েছে কাশ্মীর , জান্সকার , চাম্বা এবং স্পিতিতে ।
এই এলাকায় যে হাইড্রোকার্বন মজুত থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট জোরালো , তা প্রথম জানা যায় , 2018 সালের সেপ্টেম্বরে জমা পড়া একটি সামগ্রিক সমীক্ষায় । এই সমীক্ষাটি করেছিলেন ONGC-র একদল বৈজ্ঞানিক , জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া , জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়, ENI আপস্ট্রিম অ্যান্ড টেকনিক্যাল সার্ভিসেস (ইতালি), পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (PPL) এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বৈজ্ঞানিকরা ।
77 টি পৃষ্ঠার ওই গবেষণাপত্র, যার নাম ‘পেট্রোলিয়াম সিস্টেমস অ্যান্ড হাইড্রোকার্বন পোটেনসিয়াল অফ দ্য নর্থ-ওয়েস্ট (NW) হিমালয়া অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’-এ বলা হয়েছে , “NW হিমালয়কে হাইড্রোকার্বনের উৎস অনুসন্ধানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ এর যথাযথ ভূ-গঠন পলল অধঃক্ষেপণকারী পরিবেশে একাধিক স্থানে পেট্রলিয়ামের অস্তিত্ত্বের প্রমাণ মিলেছে । একইসঙ্গে মিলেছে প্রাকৃতিক গ্যাস , বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহারযোগ্য খনিজ তেলের উপস্থিতিও ।”
রিপোর্টে বলা হয়েছে, “জান্সকার—স্পিতি উপত্যকার ধাপে ধাপে সজ্জিত থাকা মেসোজোয়িক—টার্শিয়ারি স্তরের আর্জিলাসিয়াস পললক্ষেত্রে পাওয়া OM ( জৈব উপাদান) এবং ক্রেটাসিয়াস—ইউসিন ইন্ডাস ফর্মেশনে পাওয়া শেল পাথরগুলিই সম্ভাব্য হাইড্রোকার্বনের উৎস।”
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, “উপত্যকাগুলির ভিতরের দিকে আঞ্চলিকভাবে চাপের জেরে সৃষ্ট ‘ট্র্যাপ’গুলিতে প্রচুর পরিমাণে তেল এবং গ্যাসের উৎস থাকার তাৎপর্যপূর্ণ সম্ভাবনা মিলেছে আর তার ফলে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে আরও গভীরে আরও আরও বেশি অনুসন্ধানকার্য চালানো প্রয়োজন ।”
রিপোর্ট অনুযায়ী, “NW হিমালয়ের যে অংশ ভারতের দিকে রয়েছে, সেখানে হাইড্রোকার্বনের উৎসের সম্ভাবনা জোরালো । কারণ এর উপযুক্ত ভূ-গাঠনিক পলল অধঃক্ষেপণকারী পরিবেশ । এখানে যে গ্যাসের ভাণ্ডার রয়েছে, তা ভূপৃষ্ঠেই দৃশ্যমান (উদাহরণস্বরূপ জ্বালামুখী ‘অগ্নি মন্দির’), আর আশপাশের স্তরগুলিতে যে তেল আর গ্যাসের হদিস মিলতে পারে তাও সহজেই অনুমেয় ।”
উত্তর পশ্চিম হিমালয়ে হাইড্রোকার্বন ভাণ্ডার থাকার সম্ভাবনা যে রয়েছে, সেই সংক্রান্ত গবেষণামূলক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই রিপোর্টই প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ উদে্যাগ ।
এই এলাকাকে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে দেখার ক্ষেত্রে একাধিক কারণ কাজ করেছে । যেমন ভৌগোলিক স্তরে এর বিচ্ছিন্নতা , উচ্চতা, তীব্র শীত প্রভৃতি । তাছাড়া রয়েছে " গঠনগত জটিলতা ও তীব্র ভূগাঠনিক শক্তির প্রয়োগ , যার ফলে এই এলাকায় সমানভাবে বিস্তৃত এবং অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ ভূমিরূপ চোখে পড়ে না । আর এই ধরনের ভূমিরূপ গতির তারতম্যের জেরে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়া চাপের ফলে সৃষ্ট হয় । এই সব কিছুর ফলে আভ্যন্তরীণভাবে অত্যন্ত জটিল এই ভূমিরূপ, যার বৈশিষ্ট্য হল সুগভীর গিরিখাত এবং পার্শ্বীয় গতি । তার কোথায় কী কী সম্পদ থাকতে পারে , তা যথাযথভাবে অনুমান করা অত্যন্ত কঠিন ।
ONGC-র ওই আধিকারিক জানিয়েছেন , “ যথাযথ অনুসন্ধানকার্য চালানোর জন্য অনেক ধরনের উদে্যাগ নিতে হবে । যার অন্যতম হল বিস্ফোরণ ঘটানো । কিন্তু হিমালয় এলাকার বিশাল উচ্চতা, যখন তখন তুষারধস নামার সম্ভাবনা এবং ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ার কারণে তা করা সম্ভব নয় ।”