কলকাতা, 20 জুলাই : সাইবার রিভেঞ্জ ৷ অর্থাৎ অনলাইনে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা ৷ এই সাইবার রিভেঞ্জ বর্তমানে অন্যতম বড় থ্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে ৷ বিশেষ করে এর ফলে সম্মানহানি হচ্ছে দেশের কিশোরী, যুবতি ও মহিলাদের ৷ ইন্টারনেট দুনিয়ায় শ্লীলতাহানি চলছে বছরের পর বছর ধরে ৷ ছবি বিকৃত করে করা হচ্ছে আপলোড ৷ বিভিন্ন আর্থিক প্রতারণার পরই ভারতে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ দায়ের হয় সাইবার রিভেঞ্জের ঘটনায় ৷ কোনও কোনও রাজ্যে অপরাধের শীর্ষে রয়েছে সাইবার রিভেঞ্জ ৷ সম্মান বাঁচাতে অনেক সময় আত্মহত্যাও করেছেন অনেকে ৷
ঘটনা 1 : 10 মার্চ আমেদাবাদের সরদারনগর থানা এলাকায় আত্মহত্যা করেন 16 বছরের এক কিশোরী ৷ তাঁর প্রেমিক 29 ফেব্রুয়ারি নিজেদের এক ঘনিষ্ঠ ভিডিয়ো ইন্টারনেটে আপলোড করে ৷ মুহূর্তে ভাইরালও হয়ে যায় সেটি ৷ তারপর অপমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ওই কিশোরী ৷
ঘটনা 2 : 10 বছর আগে বাংলাতেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা ৷ শিলিগুড়ির এক কলেজ পড়ুয়া যুবতির প্রেমিক নিজেদের গোপন ভিডিয়ো MMS হিসেবে প্রকাশ করে দেয় ৷ ইউটিউবেও আপলোড করা হয় ভিডিয়োটি ৷ সাত বছরের সম্পর্কের পরও এরকম হতে পারে স্বপ্নেও ভাবেননি ওই যুবতি ৷ পরে যুবতির পরিবার থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ৷ পুলিশ ভিডিয়োটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে দেয় ৷ কিন্তু, তারপরও শিলিগুড়ির এক শ্রেণির মানুষের কাছে রয়ে গিয়েছিল ভিডিয়োটি ৷ পরে আত্মহত্যা করেন ওই যুবতি ৷
সময় যত এগিয়েছে ইন্টারনেটে এই অপরাধের ধরন বদলেছে ৷ বেড়েছে অপরাধের পরিমাণও ৷ শুধুমাত্র গোপন ছবি প্রকাশ নয়, অনেক সময় ছবিকে বিশেষভাবে এডিট করে মহিলাদের নগ্ন ছবি বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ৷
ঘটনা 3 : বছর দেড়েক আগে কলকাতার যুবতি এমনই এক ঘটনার শিকার হন ৷ দিনদুপুরে এমন কী, মাঝরাতেও তাঁর বাড়ির দরজায় বেজে উঠছিল কলিং বেল ৷ বাইরে দাঁড়িয়ে অপরিচিত নানা বয়সের যুবক ৷ কী প্রয়োজন প্রশ্ন করতেই পালটা প্রশ্ন করছিল তারা ৷ তাদের বক্তব্য, "আপনিই তো ঠিকানা দিয়েছিলেন ৷ এখন বাইরে দাঁড় করিয়ে না রেখে ভিতরে ঢুকতে দিন ৷ চাহিদা মতো টাকা সঙ্গে এনেছি ৷" প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেননি ওই গৃহবধূ ৷ পরে এক যুবক বিষয়টি জানান তাঁকে ৷ তিনি বলেন, "এসকট সার্ভিসে ছবি-সহ এই বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ৷ সঙ্গে দেওয়া হয়েছে যোগাযোগ নম্বরও ৷ সেখানে যোগাযোগ করলে বলে দেওয়া হচ্ছে সময় ৷" সেই বিজ্ঞাপনের ওয়েবসাইটে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ ওই যুবতি ও তাঁর পরিবারের ৷ শুধু তাঁর ছবি নয়, তাঁর ভাইয়ের বউকে নিয়েও দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞাপন ৷ লজ্জায় অপমানে কী করে এই সমস্যা থেকে বের হবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না ৷ বাড়ির বাইরে CCTV ক্যামেরা বসানো হয় ৷ বাইরে লিখে দেওয়া হয়, ওয়েবসাইট দেখে কেউ এই বাড়িতে আসবেন না ৷ কিন্তু, তারপরও অপরিচিতদের আনাগোনো বন্ধ হয় না ৷ পরে, লালবাজার সাইবার অপরাধ থানায় যোগাযোগ করেন ওই যুবতি ৷ দায়ের করা হয় অভিযোগও ৷ গুরুত্ব বুঝে দ্রুত তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগ ৷ প্রাথমিকভাবে উঠে আসে কলকাতারই এক যুবকের নাম ৷ তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ৷ তাকে জেরা করে জানা যায়, সে এই পরিবারকে চেনে না ৷ তবে, এক বান্ধবীর নির্দেশে এই কাজ করেছে ৷ তার বান্ধবী আসলে ওই যুবতির প্রতিবেশী ৷ জমি বিবাদের জেরে প্রতিশোধ নিতেই এই ব্যবস্থা নিয়েছিল সে ৷ এভাবে সাইবার দুনিয়ায় ক্রমাগত ঘটে চলেছে প্রতিশোধের ঘটনা ।
এ প্রসঙ্গে সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত বলেন, "দেখুন মহিলারা নিজেদের প্রচার করতে গিয়ে সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে নানাভাবে । আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ।" আসলে যুগটা প্রচারের । কেউ কেউ বলেন দেখনদারির । সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বয়সের মহিলারা নিজেদের সৌন্দর্য কিংবা গুণের জাহির করতে মরিয়া । রমরমিয়ে চলছে সেই সব সোশাল সাইটও । চাহিদা একটাই যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছানো । আর তাদের লাইক ।
লকডাউন চলাকালীন এপ্রিল মাসের 17 তারিখ নয়ডার সালারপুরে এক কিশোরী আত্মহত্যা করে । তার অভিমান ছিল, টিকটক চিনা অ্যাপে কেন লাইক পাচ্ছে না সে । তার আগে 7 মে গুরগাঁওয়ে 17 বছরের এক কিশোর একই কারণে 11 তলা থেকে ঝাঁপ দেয় । যে বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ার চাপ সহ্য করতে পারছিল না । অর্থাৎ আজকের টিনেজার কিংবা যুবতিদের আত্মপ্রচারের ঝোঁক জীবন পর্যন্ত নিয়ে নিচ্ছে । আর সেটাই কাল হচ্ছে । এর জেরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাদের নগ্ন ছবি কিংবা ভিডিয়ো । কখনও তারা ব্ল্যাকমেলের শিকার হচ্ছেন ।
লালবাজার সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত কলকাতায় শাড়ি পরে চ্যালেঞ্জ কিংবা কমেন্ট চ্যালেঞ্জের বিষয়ে মামলা হয়নি । কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, লজ্জার ভয়ে অনেকেই এ ধরনের মামলা করেন না । বরং টাকা পয়সা দিয়ে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন । কিন্তু কেন এত উদ্বেগ? কেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই ধরনের চ্যালেঞ্জে পা না দিতে? সন্দীপবাবু জানাচ্ছেন, এর আগে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরও নতুন একটি অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ফেরত এসেছে । তারা বিনামূল্যে কাজ করে দিচ্ছে । ওই ওয়েবসাইটে যেকোনও মহিলার ছবি দেওয়া হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নগ্নরূপ চলে আসবে ওই অ্যাপ ব্যবহারকারীর হাতে । আর এভাবেই দেশের অনেক প্রান্তে শাড়ি পরে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া যুবতি কিংবা কিশোরীরা ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন । এর সুযোগ নিয়ে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে বলে খবর আসছে । অর্থাৎ ছবি এডিটিংয়ের কাজটি কাউকে নিজেকেও করতে হচ্ছে না । নির্দিষ্ট একটি অ্যাপে ছবি দিলেই হল । চলে আসবে নগ্ন ছবি । তথ্য বলছে এতটা সহজলভ্যতার কারণে দিনের পর দিন বাড়ছে সাইবার প্রতারণার ঘটনা ।
কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইমের এক অফিসার জানাচ্ছেন, সাইবার রিভেঞ্জের প্রকৃত চিত্র পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে না । কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই এই মামলা থানা পর্যন্ত পৌঁছায় না । দেশের শহরগুলিতে কিছুটা সচেতনতা বাড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা । কিন্তু, গ্রামে এখনও পর্যন্ত সমস্যা রয়েই গিয়েছে। অস্বীকার করার জায়গা নেই মানুষের মধ্যে যেমন সচেতনতার অভাব রয়েছে, তেমন গ্রামের থানাগুলিতে সাইবার অপরাধ নিয়ে এখনও পর্যন্ত সচেতনতা সেইভাবে পুলিশের মধ্যেও নেই । অথচ আগামী দিনে মানব সভ্যতার কাছে সবথেকে বড় হুমকি হতে চলেছে সাইবার অপরাধ ।
সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, "এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলতে গেলে নেই । একটাই মাত্র পথ খোলা । সোশাল মিডিয়ায় নিজেদের যে ছবিগুলো পোস্ট করা হচ্ছে, সেগুলো শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে চেনা মানুষদের মধ্যেই শেয়ার করা উচিত । অপরিচিত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে নিজের কোনও ছবি শেয়ার করা উচিত নয় । এই ফাঁদ থেকে বাঁচার এটিই একমাত্র উপায় ।" কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) মুরলীধর শর্মা এ প্রসঙ্গে বলেন, "সাইবার রিভেঞ্জের জন্য অত্যন্ত সতর্ক থাকা প্রয়োজন । নিজের ছবি কোনওভাবেই যাতে অপরিচিতের কাছে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে । তার পরেও যদি এমন কোনও ঘটনার খবর আসে দ্রুত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ।"