ETV Bharat / bharat

ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংকটে চলে গিয়েছে

author img

By

Published : Oct 17, 2020, 9:53 PM IST

2020-21 আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে 69 হাজার কোটি টাকা । যা ভারতের GDP এর মাত্র এক শতাংশ । ভারতের মতো একটা দেশ, যার জনসংখ্যা অনেক বেশি, সেই দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই তহবিল কার্যত অপর্যাপ্ত । 2011 সালে প্ল্যানিং কমিশন প্রস্তাব দিয়েছিল যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে GDP এর 2.5 শতাংশ খরচ করা হোক । কিন্তু সেই প্রস্তাবকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে কোনও সরকারই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি ।

ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা
ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা

মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং মাতৃত্বকালীন ও শিশুমৃত্যু কমাতে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে । তা সত্ত্বেও ভারতের জনস্বাস্থ্যের অন্যান্য প্রাথমিক দিকগুলি নিয়ে সেভাবে কোনও রকম সংঘবদ্ধ কাজ করা হয়নি । আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গুণমান ও নীতির ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি এই দেশ । চিকিৎসা পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়ে জাতীয় স্তরে বিভিন্ন রাজ্যগুলির মধ্যে ব্যাপক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় । যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যকর জনসংখ্যা সবসময় সবচেয়ে আগে প্রয়োজন পড়ে । সেই কারণেই অনেক দেশ তাদের GDP এর একটা বড় অংশ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি ও তার মান উন্নত করার কাজে ব্যবহার করে । পার ক্যাপিটায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রে যে পরিমাণ খরচ করে বিভিন্ন দেশগুলি, 190 টি দেশের সেই তালিকায় ভারতের অবস্থান 141 নম্বরে । Covid 19 এর প্রেক্ষাপটে দেশীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভালো করে যাচাই করা ও বর্তমান ব্যবস্থার দুর্বল জায়গাগুলি নতুন করে পর্যালোচনা করার সময় চলে এসেছে ।

2020-21 আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে 69 হাজার কোটি টাকা । যা ভারতের GDP এর মাত্র এক শতাংশ । ভারতের মতো একটা দেশ, যার জনসংখ্যা অনেক বেশি, সেই দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই তহবিল কার্যত অপর্যাপ্ত । 2011 সালে প্ল্যানিং কমিশন প্রস্তাব দিয়েছিল যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে GDP এর 2.5 শতাংশ খরচ করা হোক । কিন্তু সেই প্রস্তাবকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে কোনও সরকারই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি । 2018 সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা ( PMJAY ), যা আয়ুষ্মান ভারত নামেও পরিচিত । ওই যোজনার মাধ্যমে দেশের যে মানুষরা চিকিৎসার সঠিক সুবিধা পান না, তাঁদের বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে । এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে 5 লাখ টাকার বিমার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে । এই প্রকল্পকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্প বলা হচ্ছে । অর্থনৈতিক, জাতি ও সামাজিক সুমারি অনুসারে জনসংখ্যার 40 শতাংশ মানুষ, যার অর্থ 10 কোটি পরিবার বা 50 কোটি মানুষ এই প্রকল্পের অধীনে জায়গা পেয়ে উপকৃত হয়েছেন । এখনও পর্যন্ত 72 লাখ পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন । তবে এই যোজনায় নির্দিষ্ট কিছু রোগেরই চিকিৎসা হয় । আয়ুষ্মান ভারতের লক্ষ্য 2022 সালের মধ্যে সারা দেশে 1.5 লাখ স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা হয় । যদিও এখনও পর্যন্ত সেই লক্ষ্যের 25 শতাংশ পার করা যায়নি ।

এই নিয়ে জতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ( NHA ), যারা এই PMJAY প্রকল্পের সর্বোচ্চ নিয়ামক, তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বিভিন্ন রাজ্যের বিমার অর্থ প্রদানের তারতম্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে । এই প্রকল্পের অর্থ খরচে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশ । আবার হাসপাতালে ভরতির নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে কেরল । 115 টি জেলাকে সবচেয়ে আশাবাদী জেলা হিসেবে ধরা হয়েছিল । অথচ সেখানকার একটিও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্র আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়নি । এমন ওই জেলাগুলির বেসরকারি হাসপাতালগুলিও এই প্রকল্পে যুক্ত হতে চায়নি । মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখণ্ড ছাড়া অধিকাংশ রাজ্যই উন্নত জেলাগুলির বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে এই প্রকল্পের আওতায় রেখেছে । সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই দেশে চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত হল 1 : 1456 । অথচ এই অনুপাত 1 : 1000 হওয়া উচিত বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO ) । এই অনুপাতকে বৃদ্ধি করার জন্য সরকার জেলা হাসপাতালগুলির সঙ্গে মেডিকেল কলেজগুলি সংযোগ তৈরির ঘোষণা করেছে । বর্তমানে দেশজুড়ে 526টি সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে । গত 2 বছরে এই কলেজগুলিতে আসন সংখ্যা 82 হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে 1 লাখ হয়েছে । সরকার পরিচালিত ও বেসরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে প্রতিদিনই বৈপরীত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে । দেশে যত হাসপাতাল আছে, তার 58 শতাংশ বেসরকারি । আর হাসপাতালে যত শয্যা আছে, তার 29 শতাংশ রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে । চিকিৎসকদের 81 শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করছেন । জাতীয় পরীক্ষা বোর্ডের অধীনে হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত ধারণ ক্ষমতা তৈরি করে স্নাতকোত্তর স্তরের কোর্সের অফার দিয়েছে কেন্দ্র ।

শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাকে কমিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে । MBBS এর পর সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ সুবিধা ক্রমশ কমছে । প্রশিক্ষিতের চিকিৎসার ঘাটতি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে । দেশের কর্পোরেট হাসপাতালগুলির চিকিৎসা সরঞ্জামের সেরা সম্ভার রয়েছে । কিছু বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষমতা রয়েছে যে তারা তাদের চিকিৎসকদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসতে পারেন । নিজেদের পরিষেবাকে ব্যবহার করে জাতীয় পরীক্ষা বোর্ড চিকিৎসা বিদ্যার পড়ুয়াদের PG কোর্সে ভরতি করিয়ে দিতে পারে । চিকিৎসা বিদ্যার পড়ুয়াদের চিকিৎসক হিসেবে কাজও করানোর কথা । কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল অধিকাংশই রোগী না দেখেই গ্র্যাজুয়েশনের ডিগ্রি পেয়ে যান । NITI আয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে যে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজগুলির সঙ্গে জেলা হাসপাতালগুলির সংযোগ স্থাপন করার বিষয়ে । অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এমন বড় কোনও হাসপাতাল নেই যাদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে । নীতি নির্ধারকরা রাজ্য সরকারগুলিকে বলেছে যে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে কম দামে জমি দেওয়ার জন্য । যাতে সেখানে তারা হাসপাতাল গড়ে তুলতে পারে । কয়েকটি রাজ্য ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে । বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলির সঙ্গে জেলা হাসপাতালগুলির সংযোগ স্থাপন করলেই যে চিকিৎসকের সংকট মিটে যাবে, সেই বিষয়টি এখনও যথেষ্ট অনিশ্চিত ।

প্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রে দেশে পরিকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে । আগামী পাঁচ বছরে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরিকাঠামো তৈরিতে ভারতের 5 লাখ 38 হাজার 305 কোটি টাকা লাগবে । কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক 15 তম প্ল্যানিং কমিশনের কাছে এই প্রস্তাব রেখেছে । এখনও পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রের পরিকাঠামো তৈরির জন্য কোনও রকম বরাদ্দ করা হয়নি । প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে । বিশ্বের সুস্বাস্থ্যধর দেশগুলির তালিকায় ভারতের স্থান 120 নম্বরে । এই তালিকায় প্রথম 2 টি স্থান দখল করেছে স্পেন ও ইট্যালি । এটা উল্লেখ করতেই হবে যে COVID-19 এ যে সমস্ত দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ইট্যালি অন্যতম । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শ্রীলঙ্কা ( 66 ), বাংলাদেশ ( 91 ) ও নেপাল ( 110 ) এর অবস্থান ভারতের থেকেও ভালো জায়গায় রয়েছে । বর্তমান স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার খামতিগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই প্যানডেমিক । প্রথম যে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ত্রুটি ধরা পড়েছে, তা হল ভাইরোলজি ল্যাব সংক্রান্ত । ভারতের সবচেয়ে বড় ভাইরোলজি গবেষণা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান হল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি ( NIV ), যা 1952 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । WHO এর সঙ্গে একজোট হয়ে ভাইরাস নিয়ে গবেষণার কৃতিত্ব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের । দুর্ভাগ্যবশত, এটা দেশের একমাত্র সংস্থা যা এই মহামারীর সময়ে উদ্ধারের কাজে এগিয়ে এসেছে ।

প্যানডেমিক বুঝিয়ে দিল যে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিটি রাজ্যে তৈরি করতে হবে । রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিয়ে মারাত্মক দেরি আটকাতে দেশের প্রতিটি কোণে ভাইরোলজি গবেষণাগার তৈরি করা উচিত । এই ধরনের গবেষণাগার উচ্চ সংক্রমণ যুক্ত রোগের উৎস সন্ধানে সাহায্য করবে । বিশেষ করে COVID-19 এর সময়ে NIV কোরোনা ভাইরাসের প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করেছে । এছাড়া এর লক্ষণ ও ছড়িয়ে পড়ার ধরন নিয়েও গবেষণা করেছে । COVID-19 এর মতো বর্তমান সংকট মানুষের জীবনধারণকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে । যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ জরুরি পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, ততক্ষণ আত্মতুষ্টি চলতেই থাকবে । দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি বিমুদ্রাকরণ ও GST চালু হওয়ার সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । বর্তমান পরিস্থিতিতে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগ ও উৎসাহ ভাতার প্রয়োজন । অধিকাংশ ওষুধের জন্য চিন অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডেন্স ( API ) সরবরাহ করে । বর্তমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে চিনের উপর অতিরিক্ত ভরসা করা অনেক ক্ষতি করতে পারে । সেই কারণে দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক শিল্পকে নতুন করে উজ্জীবীত করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে । জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় উন্নয়ন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । নীতি নির্ধারকদের দ্রুত সমাধানের পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে । এর বদলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে ।

সম্প্রতি একটি স্যাম্পেল সার্ভেতে দেখা গিয়েছে যে ভারতীয়রা ম্যালেরিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, ডায়েরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, চিকেন পক্স, মিজলস, এনসেফেলাইটিস, ফাইলেরিয়াসিস, টাইফয়েড ও টিউবারকিউলোসিসের সংক্রমণের আরও বেশি করে আক্রান্ত হচ্ছেন । এই সমস্যা সমাধানে সরকারের উচিত আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা । যদি সাধারণ সংক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তহবিল ও সম্পদের প্রয়োজন হয়, তাহলে কোরোনার মতো প্যানডেমিকের ক্ষেত্রে কেমন ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রকে ? সরকারকে এটা বুঝতে হবে যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ । আর পরিকাঠামোর উন্নতি ও সংস্কার করা কতটা জরুরি ।

মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং মাতৃত্বকালীন ও শিশুমৃত্যু কমাতে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে । তা সত্ত্বেও ভারতের জনস্বাস্থ্যের অন্যান্য প্রাথমিক দিকগুলি নিয়ে সেভাবে কোনও রকম সংঘবদ্ধ কাজ করা হয়নি । আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গুণমান ও নীতির ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি এই দেশ । চিকিৎসা পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়ে জাতীয় স্তরে বিভিন্ন রাজ্যগুলির মধ্যে ব্যাপক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় । যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যকর জনসংখ্যা সবসময় সবচেয়ে আগে প্রয়োজন পড়ে । সেই কারণেই অনেক দেশ তাদের GDP এর একটা বড় অংশ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি ও তার মান উন্নত করার কাজে ব্যবহার করে । পার ক্যাপিটায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রে যে পরিমাণ খরচ করে বিভিন্ন দেশগুলি, 190 টি দেশের সেই তালিকায় ভারতের অবস্থান 141 নম্বরে । Covid 19 এর প্রেক্ষাপটে দেশীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভালো করে যাচাই করা ও বর্তমান ব্যবস্থার দুর্বল জায়গাগুলি নতুন করে পর্যালোচনা করার সময় চলে এসেছে ।

2020-21 আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে 69 হাজার কোটি টাকা । যা ভারতের GDP এর মাত্র এক শতাংশ । ভারতের মতো একটা দেশ, যার জনসংখ্যা অনেক বেশি, সেই দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই তহবিল কার্যত অপর্যাপ্ত । 2011 সালে প্ল্যানিং কমিশন প্রস্তাব দিয়েছিল যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে GDP এর 2.5 শতাংশ খরচ করা হোক । কিন্তু সেই প্রস্তাবকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে কোনও সরকারই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি । 2018 সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা ( PMJAY ), যা আয়ুষ্মান ভারত নামেও পরিচিত । ওই যোজনার মাধ্যমে দেশের যে মানুষরা চিকিৎসার সঠিক সুবিধা পান না, তাঁদের বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে । এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে 5 লাখ টাকার বিমার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে । এই প্রকল্পকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রকল্প বলা হচ্ছে । অর্থনৈতিক, জাতি ও সামাজিক সুমারি অনুসারে জনসংখ্যার 40 শতাংশ মানুষ, যার অর্থ 10 কোটি পরিবার বা 50 কোটি মানুষ এই প্রকল্পের অধীনে জায়গা পেয়ে উপকৃত হয়েছেন । এখনও পর্যন্ত 72 লাখ পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন । তবে এই যোজনায় নির্দিষ্ট কিছু রোগেরই চিকিৎসা হয় । আয়ুষ্মান ভারতের লক্ষ্য 2022 সালের মধ্যে সারা দেশে 1.5 লাখ স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা হয় । যদিও এখনও পর্যন্ত সেই লক্ষ্যের 25 শতাংশ পার করা যায়নি ।

এই নিয়ে জতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ( NHA ), যারা এই PMJAY প্রকল্পের সর্বোচ্চ নিয়ামক, তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বিভিন্ন রাজ্যের বিমার অর্থ প্রদানের তারতম্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে । এই প্রকল্পের অর্থ খরচে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশ । আবার হাসপাতালে ভরতির নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে কেরল । 115 টি জেলাকে সবচেয়ে আশাবাদী জেলা হিসেবে ধরা হয়েছিল । অথচ সেখানকার একটিও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেন্দ্র আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়নি । এমন ওই জেলাগুলির বেসরকারি হাসপাতালগুলিও এই প্রকল্পে যুক্ত হতে চায়নি । মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখণ্ড ছাড়া অধিকাংশ রাজ্যই উন্নত জেলাগুলির বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে এই প্রকল্পের আওতায় রেখেছে । সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই দেশে চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত হল 1 : 1456 । অথচ এই অনুপাত 1 : 1000 হওয়া উচিত বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO ) । এই অনুপাতকে বৃদ্ধি করার জন্য সরকার জেলা হাসপাতালগুলির সঙ্গে মেডিকেল কলেজগুলি সংযোগ তৈরির ঘোষণা করেছে । বর্তমানে দেশজুড়ে 526টি সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে । গত 2 বছরে এই কলেজগুলিতে আসন সংখ্যা 82 হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে 1 লাখ হয়েছে । সরকার পরিচালিত ও বেসরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে প্রতিদিনই বৈপরীত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে । দেশে যত হাসপাতাল আছে, তার 58 শতাংশ বেসরকারি । আর হাসপাতালে যত শয্যা আছে, তার 29 শতাংশ রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে । চিকিৎসকদের 81 শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করছেন । জাতীয় পরীক্ষা বোর্ডের অধীনে হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত ধারণ ক্ষমতা তৈরি করে স্নাতকোত্তর স্তরের কোর্সের অফার দিয়েছে কেন্দ্র ।

শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাকে কমিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে । MBBS এর পর সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ সুবিধা ক্রমশ কমছে । প্রশিক্ষিতের চিকিৎসার ঘাটতি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে । দেশের কর্পোরেট হাসপাতালগুলির চিকিৎসা সরঞ্জামের সেরা সম্ভার রয়েছে । কিছু বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষমতা রয়েছে যে তারা তাদের চিকিৎসকদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসতে পারেন । নিজেদের পরিষেবাকে ব্যবহার করে জাতীয় পরীক্ষা বোর্ড চিকিৎসা বিদ্যার পড়ুয়াদের PG কোর্সে ভরতি করিয়ে দিতে পারে । চিকিৎসা বিদ্যার পড়ুয়াদের চিকিৎসক হিসেবে কাজও করানোর কথা । কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল অধিকাংশই রোগী না দেখেই গ্র্যাজুয়েশনের ডিগ্রি পেয়ে যান । NITI আয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে যে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজগুলির সঙ্গে জেলা হাসপাতালগুলির সংযোগ স্থাপন করার বিষয়ে । অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এমন বড় কোনও হাসপাতাল নেই যাদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে । নীতি নির্ধারকরা রাজ্য সরকারগুলিকে বলেছে যে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে কম দামে জমি দেওয়ার জন্য । যাতে সেখানে তারা হাসপাতাল গড়ে তুলতে পারে । কয়েকটি রাজ্য ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে । বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলির সঙ্গে জেলা হাসপাতালগুলির সংযোগ স্থাপন করলেই যে চিকিৎসকের সংকট মিটে যাবে, সেই বিষয়টি এখনও যথেষ্ট অনিশ্চিত ।

প্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রে দেশে পরিকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে । আগামী পাঁচ বছরে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরিকাঠামো তৈরিতে ভারতের 5 লাখ 38 হাজার 305 কোটি টাকা লাগবে । কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক 15 তম প্ল্যানিং কমিশনের কাছে এই প্রস্তাব রেখেছে । এখনও পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রের পরিকাঠামো তৈরির জন্য কোনও রকম বরাদ্দ করা হয়নি । প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে । বিশ্বের সুস্বাস্থ্যধর দেশগুলির তালিকায় ভারতের স্থান 120 নম্বরে । এই তালিকায় প্রথম 2 টি স্থান দখল করেছে স্পেন ও ইট্যালি । এটা উল্লেখ করতেই হবে যে COVID-19 এ যে সমস্ত দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ইট্যালি অন্যতম । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শ্রীলঙ্কা ( 66 ), বাংলাদেশ ( 91 ) ও নেপাল ( 110 ) এর অবস্থান ভারতের থেকেও ভালো জায়গায় রয়েছে । বর্তমান স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার খামতিগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই প্যানডেমিক । প্রথম যে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ত্রুটি ধরা পড়েছে, তা হল ভাইরোলজি ল্যাব সংক্রান্ত । ভারতের সবচেয়ে বড় ভাইরোলজি গবেষণা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান হল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি ( NIV ), যা 1952 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । WHO এর সঙ্গে একজোট হয়ে ভাইরাস নিয়ে গবেষণার কৃতিত্ব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের । দুর্ভাগ্যবশত, এটা দেশের একমাত্র সংস্থা যা এই মহামারীর সময়ে উদ্ধারের কাজে এগিয়ে এসেছে ।

প্যানডেমিক বুঝিয়ে দিল যে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিটি রাজ্যে তৈরি করতে হবে । রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিয়ে মারাত্মক দেরি আটকাতে দেশের প্রতিটি কোণে ভাইরোলজি গবেষণাগার তৈরি করা উচিত । এই ধরনের গবেষণাগার উচ্চ সংক্রমণ যুক্ত রোগের উৎস সন্ধানে সাহায্য করবে । বিশেষ করে COVID-19 এর সময়ে NIV কোরোনা ভাইরাসের প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করেছে । এছাড়া এর লক্ষণ ও ছড়িয়ে পড়ার ধরন নিয়েও গবেষণা করেছে । COVID-19 এর মতো বর্তমান সংকট মানুষের জীবনধারণকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে । যতক্ষণ না সাধারণ মানুষ জরুরি পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, ততক্ষণ আত্মতুষ্টি চলতেই থাকবে । দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি বিমুদ্রাকরণ ও GST চালু হওয়ার সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । বর্তমান পরিস্থিতিতে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগ ও উৎসাহ ভাতার প্রয়োজন । অধিকাংশ ওষুধের জন্য চিন অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডেন্স ( API ) সরবরাহ করে । বর্তমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে চিনের উপর অতিরিক্ত ভরসা করা অনেক ক্ষতি করতে পারে । সেই কারণে দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক শিল্পকে নতুন করে উজ্জীবীত করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে । জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় উন্নয়ন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । নীতি নির্ধারকদের দ্রুত সমাধানের পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে । এর বদলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে ।

সম্প্রতি একটি স্যাম্পেল সার্ভেতে দেখা গিয়েছে যে ভারতীয়রা ম্যালেরিয়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, ডায়েরিয়া, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, চিকেন পক্স, মিজলস, এনসেফেলাইটিস, ফাইলেরিয়াসিস, টাইফয়েড ও টিউবারকিউলোসিসের সংক্রমণের আরও বেশি করে আক্রান্ত হচ্ছেন । এই সমস্যা সমাধানে সরকারের উচিত আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করা । যদি সাধারণ সংক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তহবিল ও সম্পদের প্রয়োজন হয়, তাহলে কোরোনার মতো প্যানডেমিকের ক্ষেত্রে কেমন ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্ষেত্রকে ? সরকারকে এটা বুঝতে হবে যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ । আর পরিকাঠামোর উন্নতি ও সংস্কার করা কতটা জরুরি ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.