ETV Bharat / bharat

সাবমেরিন থেকে দূরপাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষায় সফল ভারত, বাড়ল শক্তিও - সাবমেরিন থেকে দূরপাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা

3500 কিমি দূরে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র K 4 SLBM মিজ়াইল আকারে ছোট হলেও নির্ভুলভাবে আক্রমণ করতে সক্ষম ৷ অন্ধ্রের উপকূল এলাকা থেকে এই মিজ়াইলের সফল পরীক্ষা করা হয় ৷

nuclear missiles
দূরপাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র
author img

By

Published : Jan 23, 2020, 1:47 AM IST

ভারত 3500 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম K 4 SLBM মিজ়াইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র) সফল উৎক্ষেপণ করে রবিবার (19 জানুয়ারি ) । অন্ধ্রের উপকূল এলাকা থেকে এই মিজ়াইলের সফল পরীক্ষা করা হল । যদিও এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি । এই অতি আধুনিক মিজ়াইলটি চিনের থেকে অনেকাংশেই দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং আধুনিক ।

ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিন থেকে ছোড়া যায় এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা ভারত এক দশকেরও বেশি আগে শুরু করে দিয়েছিল । 3500 কিলোমিটার পাল্লার এই K-4 মিজ়াইল তৈরির কথা গোপনই রেখেছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক । 2014 সালে প্রথমবার এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয় । উৎক্ষেপণের পরেও ভারত সরকার K-4 উৎক্ষেপণের কথা স্বীকার করেনি । 2015 সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানায় যে 2014-র মার্চে যে ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছিল, সেটি K-4 ।

2014 সালে K-4 ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সফল হয়েছিল ঠিকই । কিন্তু সে বার এই ক্ষেপণাস্ত্র তার পাল্লার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য অতিক্রম করেনি । 3000 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছিল K-4 । চলতি মাসের 19 তারিখ K-4 ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়, এবং সেটি এর পাল্লার পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উৎক্ষেপণ । অর্থাৎ সমুদ্রের তলা থেকে উঠে 3500 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে এ বার আঘাত হেনেছে K-4 ।

সমুদ্রের 30 ফুট গভীর থেকে K-4 নিক্ষেপ করা হয় । প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে নির্ভুল লক্ষ্যে নিখুঁত আঘাত হেনেছে ক্ষেপণাস্ত্রটি । হাইপারসনিক অর্থাৎ শব্দের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি বেগে ছুটতে সক্ষম এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী SLBM । অর্থাৎ ডুবোজাহাজ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর জন্য বিভিন্ন দেশের হাতে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী এবং শক্তিশালী ভারতের এই K-4 । নিউক্লিয়ার সাবমেরিন SLBM অরিহন্ত থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ব্যবহার করা হবে । এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করতে এবং তার প্রয়োজনীয়তা বিচার করে ব্যবহারের ক্ষেত্রে DRDO বহু বছর ধরে সক্রিয় । অতি সম্প্রতি ভারত পরমাণু অস্ত্র ক্লাবের সদস্য হয়েছে, এবং বেশ কিছু ঐতিহাসিক মাপকাঠিতে K-4 এর উৎক্ষেপণ । এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি রাশিয়া এবং অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতকেও একই পংক্তিতে বসিয়ে দিল ।

ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় 1980 দশকে অ্যামেরিকা এবং রাশিয়া নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারে SLBM মজুত করেছিল । পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম SSBN-র মাধ্যমে এই মিজ়াইল বহন করা হয়েছিল । সমুদ্রের 100 মিটার নীচ থেকে 1200 কিলোমিটার দূরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে যা সক্ষম ছিল । ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দাবি করেছিল সমুদ্র থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতাযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র তাদের হাতে আছে । মার্কিন সহযোগিতায় সেই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে বলেও দাবি ছিল তাদের । 1964 সালে পরমাণু অস্ত্র বহনে তাদের সক্ষমতার কথা ঘোষণা করে চিন । 1982 সালে প্রথমবার SLBM-এ সফল পরীক্ষা করে । মাঝারি পাল্লার JL-1 দিয়ে 1700 কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয় চিন ।

মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে চিন সাবমেরিনের ক্ষেত্র অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছে । 2018 সালের নভেম্বর মাসে চিন JL-3-র পরীক্ষা চালিয়েছিল, যা 9000 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম । চিনের দাবি ছিল 2025 সালের মধ্যে আরও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে তারা ।

আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ভারত সমুদ্র নিরাপত্তার বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে । সমুদ্রের তলদেশে নজরদারি চালানোর উপর জোর দেয় । এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, 2018 সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'জলের তলার কূটনৈতিক' নিয়ে টুইট করেন । প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন, পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম অরিহন্ত সফলভাবে সব পরীক্ষায় উতরে গিয়েছে । সেই টুইট ছিল প্রথম সরকারিভাবে ঘোষণা যে, ভারত সমুদ্র তলদেশে শক্তি মজবুত করতে সক্ষম হয়ে গিয়েছে । অরহস্ত 750 কিলোমিটার পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র বহন করতে পারে । SSBN-সিরিজ়ের নতুন সংস্কার আরও দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ।

প্রাক্তন নৌ-সেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ ৷ COSC-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল ৷ যে দিন প্রথমবার অরহস্ত পরিক্রমণ করেছিল, সেই বিষয়টির দায়িত্ব সামলেছিলেন ৷ তিনি বলেন, এই মিজ়াইল হাতে আসায় সমুদ্র তলদেশে ভারতের শক্তি বহুগুণ বেড় গেল ৷ যে জায়গাগুলিতে এতদিন যাওয়া সম্ভব হত না, সেখানে খুব সহজেই নজরদারি চালানো সম্ভব হবে ৷ ভারতীয় নৌ-সেনা এই অত্যাধুনিক যানের সাহায্যে শুধু পরমাণু অস্ত্র বহন করতে সক্ষম তাই নয়, আবর সাগর বা বঙ্গোপসাগরে নজরদারি চালাতে পারবে ৷

ভারতের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন) INS অরিহন্ত ভারতীয় নৌ-সেনায় কমিশনড হয়েছে 2016 সালের অগাস্টে । নিয়মমাফিক তার আগেই একবার লম্বা সি ট্রায়াল (সমুদ্রে যাতায়াত এবং অস্ত্র প্রয়োগ) সেরে নিয়েছিল INS অরিহন্ত । নৌ-সেনার হাতে চলে আসার পরে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটিকে পাঠানো হয়েছিল ডেটারেন্স পেট্রলে । ভারতীয় জলসীমার ভিতরে এবং তা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমার নানা অংশ ঘুরে অরিহন্ত ফিরে এসেছে নির্দিষ্ট বন্দরে । এই দীর্ঘ মহড়ায় সমুদ্রের তলা থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের উপরে পরমাণু হামলা চালানোর মহড়াও অত্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটি । দেশের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রল মহড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক । স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের সাফল্যে উল্লসিত নৌ-সেনা । উল্লসিত দেশের প্রধানমন্ত্রীও ।

INS অরিহন্তের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রল ভারতের সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিল । বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা । ভারতের 'পরমাণু ত্রিশূল' আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পূর্ণ হল ৷

পরমাণু ত্রিশূল কী?

পরমাণু ত্রিশূল হল স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর জন্য সক্ষম । স্থলভাগ থেকে ব্যালিস্টিক মিজ়াইল ছুঁড়ে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা অনেক আগেই অর্জন করেছে ভারত । পরবর্তীকালে ভারতীয় বায়ুসেনাও পরমাণু হামলা চালানোর পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলেছে । ব্রহ্মসের মতো মহাশক্তিধর এবং পরমাণু হামলায় সক্ষম ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার প্রতি সমীহ আরও বেড়েছে যে কোনও প্রতিপক্ষের । এ বার ভারতীয় নৌসেনাও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বিরাট স্বীকৃতি পেয়ে গেল । ফলে স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ— তিন অবস্থান থেকেই পরমাণু হামলা চালানোয় সক্ষম হয়ে উঠল ভারত ।

অ্যামেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স— এই পাঁচ দেশের হাতে পরমাণু ত্রিশূল রয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয় । তবে চিন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের পরমাণু ত্রিশূলের সক্ষমতা নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সংশয়ও রয়েছে । স্থল, জল, অন্তরীক্ষের মধ্যে যে কোনও জায়গা থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা চিন, ব্রিটেন বা ফ্রান্সের রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না । পুরোদস্তুর 'নিউক্লিয়ার ট্রায়াড' বা পরমাণু ত্রিশূল অ্যামেরিকা এবং রাশিয়ার রয়েছে বলেই এতদিন ধরা হত । এ বার ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল যে, পরমাণু ত্রিশূল গঠন সম্পন্ন ।

পরমাণু ত্রিশূল থাকলে কী সুবিধা?

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরমাণু অস্ত্র হাতে থাকলেই পরমাণু হামলার জবাব দেওয়া যায়, এমন নয় । পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য যে কোনও পরমাণু শক্তিধর দেশেই একটি করে ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ থাকে । কিন্তু কোনও দেশ পরমাণু হামলার শিকার হলে ধ্বংসলীলা এত সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছনোর আশঙ্কা থাকে যে, ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয় । প্রথমে যারা পরমাণু হামলা চালাবে, তারা কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমটা ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই চালাবে, এমনটাও ধরে নেওয়া হয় । সে ক্ষেত্রে পালটা পরমাণু হামলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে আক্রান্ত দেশটি । তাই শুধুমাত্র দেশের মূল ভূখণ্ড বা স্থলভাগ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতায় সন্তুষ্ট হওয়া কাজের কথা নয় বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত । আকাশ থেকে বা জলভাগ থেকেও পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন । INS অরিহন্তের সাফল্যে সেই সক্ষমতায় ভারত পৌঁছে গেল ।

3500 কিমি দূরে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি আকারে ছোট হলেও নির্ভুলভাবে আক্রমণ করতে সক্ষম ৷ যার অর্থ গোটা বিশ্বের কাছে এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছে ৷ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের নৌ-সেনাকে সমৃদ্ধ করেছে । ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি আকাশে 600 কিলোমিটার বা 373 মাইল পর্যন্ত দূরের টার্গেটে যেমন আঘাত হানতে পারবে, তেমনই আকাশে 400 কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত শত্রু পক্ষের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকেও ধ্বংস করে দিতে পারবে । এখানেই শেষ নয় । প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার বেগে ছোটা ওই সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র একই সঙ্গে দশটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নজর রাখারও ক্ষমতা রাখে । শত্রু পক্ষের সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যে দিক থেকেই ছোঁড়া হোক না কেন । আকাশে ঘণ্টায় ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির বেগ হবে কম করে 18 হাজার কিলোমিটার । এর রাডার ব্যবস্থাও আক্ষরিক অর্থেই, সর্বাধুনিক । অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ডুবোজাহাজের উপর কেউ কোনও রকম নজরদারি না চালাতে পারে ৷

ভারত 3500 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম K 4 SLBM মিজ়াইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র) সফল উৎক্ষেপণ করে রবিবার (19 জানুয়ারি ) । অন্ধ্রের উপকূল এলাকা থেকে এই মিজ়াইলের সফল পরীক্ষা করা হল । যদিও এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি । এই অতি আধুনিক মিজ়াইলটি চিনের থেকে অনেকাংশেই দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং আধুনিক ।

ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিন থেকে ছোড়া যায় এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা ভারত এক দশকেরও বেশি আগে শুরু করে দিয়েছিল । 3500 কিলোমিটার পাল্লার এই K-4 মিজ়াইল তৈরির কথা গোপনই রেখেছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক । 2014 সালে প্রথমবার এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয় । উৎক্ষেপণের পরেও ভারত সরকার K-4 উৎক্ষেপণের কথা স্বীকার করেনি । 2015 সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানায় যে 2014-র মার্চে যে ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছিল, সেটি K-4 ।

2014 সালে K-4 ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সফল হয়েছিল ঠিকই । কিন্তু সে বার এই ক্ষেপণাস্ত্র তার পাল্লার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য অতিক্রম করেনি । 3000 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছিল K-4 । চলতি মাসের 19 তারিখ K-4 ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়, এবং সেটি এর পাল্লার পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উৎক্ষেপণ । অর্থাৎ সমুদ্রের তলা থেকে উঠে 3500 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে এ বার আঘাত হেনেছে K-4 ।

সমুদ্রের 30 ফুট গভীর থেকে K-4 নিক্ষেপ করা হয় । প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে নির্ভুল লক্ষ্যে নিখুঁত আঘাত হেনেছে ক্ষেপণাস্ত্রটি । হাইপারসনিক অর্থাৎ শব্দের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি বেগে ছুটতে সক্ষম এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী SLBM । অর্থাৎ ডুবোজাহাজ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর জন্য বিভিন্ন দেশের হাতে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী এবং শক্তিশালী ভারতের এই K-4 । নিউক্লিয়ার সাবমেরিন SLBM অরিহন্ত থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ব্যবহার করা হবে । এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করতে এবং তার প্রয়োজনীয়তা বিচার করে ব্যবহারের ক্ষেত্রে DRDO বহু বছর ধরে সক্রিয় । অতি সম্প্রতি ভারত পরমাণু অস্ত্র ক্লাবের সদস্য হয়েছে, এবং বেশ কিছু ঐতিহাসিক মাপকাঠিতে K-4 এর উৎক্ষেপণ । এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি রাশিয়া এবং অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতকেও একই পংক্তিতে বসিয়ে দিল ।

ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় 1980 দশকে অ্যামেরিকা এবং রাশিয়া নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারে SLBM মজুত করেছিল । পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম SSBN-র মাধ্যমে এই মিজ়াইল বহন করা হয়েছিল । সমুদ্রের 100 মিটার নীচ থেকে 1200 কিলোমিটার দূরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে যা সক্ষম ছিল । ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দাবি করেছিল সমুদ্র থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতাযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র তাদের হাতে আছে । মার্কিন সহযোগিতায় সেই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে বলেও দাবি ছিল তাদের । 1964 সালে পরমাণু অস্ত্র বহনে তাদের সক্ষমতার কথা ঘোষণা করে চিন । 1982 সালে প্রথমবার SLBM-এ সফল পরীক্ষা করে । মাঝারি পাল্লার JL-1 দিয়ে 1700 কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয় চিন ।

মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে চিন সাবমেরিনের ক্ষেত্র অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছে । 2018 সালের নভেম্বর মাসে চিন JL-3-র পরীক্ষা চালিয়েছিল, যা 9000 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম । চিনের দাবি ছিল 2025 সালের মধ্যে আরও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে তারা ।

আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ভারত সমুদ্র নিরাপত্তার বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে । সমুদ্রের তলদেশে নজরদারি চালানোর উপর জোর দেয় । এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, 2018 সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'জলের তলার কূটনৈতিক' নিয়ে টুইট করেন । প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন, পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম অরিহন্ত সফলভাবে সব পরীক্ষায় উতরে গিয়েছে । সেই টুইট ছিল প্রথম সরকারিভাবে ঘোষণা যে, ভারত সমুদ্র তলদেশে শক্তি মজবুত করতে সক্ষম হয়ে গিয়েছে । অরহস্ত 750 কিলোমিটার পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র বহন করতে পারে । SSBN-সিরিজ়ের নতুন সংস্কার আরও দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ।

প্রাক্তন নৌ-সেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ ৷ COSC-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল ৷ যে দিন প্রথমবার অরহস্ত পরিক্রমণ করেছিল, সেই বিষয়টির দায়িত্ব সামলেছিলেন ৷ তিনি বলেন, এই মিজ়াইল হাতে আসায় সমুদ্র তলদেশে ভারতের শক্তি বহুগুণ বেড় গেল ৷ যে জায়গাগুলিতে এতদিন যাওয়া সম্ভব হত না, সেখানে খুব সহজেই নজরদারি চালানো সম্ভব হবে ৷ ভারতীয় নৌ-সেনা এই অত্যাধুনিক যানের সাহায্যে শুধু পরমাণু অস্ত্র বহন করতে সক্ষম তাই নয়, আবর সাগর বা বঙ্গোপসাগরে নজরদারি চালাতে পারবে ৷

ভারতের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন) INS অরিহন্ত ভারতীয় নৌ-সেনায় কমিশনড হয়েছে 2016 সালের অগাস্টে । নিয়মমাফিক তার আগেই একবার লম্বা সি ট্রায়াল (সমুদ্রে যাতায়াত এবং অস্ত্র প্রয়োগ) সেরে নিয়েছিল INS অরিহন্ত । নৌ-সেনার হাতে চলে আসার পরে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটিকে পাঠানো হয়েছিল ডেটারেন্স পেট্রলে । ভারতীয় জলসীমার ভিতরে এবং তা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমার নানা অংশ ঘুরে অরিহন্ত ফিরে এসেছে নির্দিষ্ট বন্দরে । এই দীর্ঘ মহড়ায় সমুদ্রের তলা থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের উপরে পরমাণু হামলা চালানোর মহড়াও অত্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটি । দেশের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রল মহড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক । স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের সাফল্যে উল্লসিত নৌ-সেনা । উল্লসিত দেশের প্রধানমন্ত্রীও ।

INS অরিহন্তের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রল ভারতের সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিল । বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা । ভারতের 'পরমাণু ত্রিশূল' আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পূর্ণ হল ৷

পরমাণু ত্রিশূল কী?

পরমাণু ত্রিশূল হল স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর জন্য সক্ষম । স্থলভাগ থেকে ব্যালিস্টিক মিজ়াইল ছুঁড়ে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা অনেক আগেই অর্জন করেছে ভারত । পরবর্তীকালে ভারতীয় বায়ুসেনাও পরমাণু হামলা চালানোর পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলেছে । ব্রহ্মসের মতো মহাশক্তিধর এবং পরমাণু হামলায় সক্ষম ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার প্রতি সমীহ আরও বেড়েছে যে কোনও প্রতিপক্ষের । এ বার ভারতীয় নৌসেনাও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বিরাট স্বীকৃতি পেয়ে গেল । ফলে স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ— তিন অবস্থান থেকেই পরমাণু হামলা চালানোয় সক্ষম হয়ে উঠল ভারত ।

অ্যামেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স— এই পাঁচ দেশের হাতে পরমাণু ত্রিশূল রয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয় । তবে চিন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের পরমাণু ত্রিশূলের সক্ষমতা নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সংশয়ও রয়েছে । স্থল, জল, অন্তরীক্ষের মধ্যে যে কোনও জায়গা থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা চিন, ব্রিটেন বা ফ্রান্সের রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না । পুরোদস্তুর 'নিউক্লিয়ার ট্রায়াড' বা পরমাণু ত্রিশূল অ্যামেরিকা এবং রাশিয়ার রয়েছে বলেই এতদিন ধরা হত । এ বার ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল যে, পরমাণু ত্রিশূল গঠন সম্পন্ন ।

পরমাণু ত্রিশূল থাকলে কী সুবিধা?

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরমাণু অস্ত্র হাতে থাকলেই পরমাণু হামলার জবাব দেওয়া যায়, এমন নয় । পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য যে কোনও পরমাণু শক্তিধর দেশেই একটি করে ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ থাকে । কিন্তু কোনও দেশ পরমাণু হামলার শিকার হলে ধ্বংসলীলা এত সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছনোর আশঙ্কা থাকে যে, ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয় । প্রথমে যারা পরমাণু হামলা চালাবে, তারা কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমটা ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই চালাবে, এমনটাও ধরে নেওয়া হয় । সে ক্ষেত্রে পালটা পরমাণু হামলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে আক্রান্ত দেশটি । তাই শুধুমাত্র দেশের মূল ভূখণ্ড বা স্থলভাগ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতায় সন্তুষ্ট হওয়া কাজের কথা নয় বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত । আকাশ থেকে বা জলভাগ থেকেও পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন । INS অরিহন্তের সাফল্যে সেই সক্ষমতায় ভারত পৌঁছে গেল ।

3500 কিমি দূরে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি আকারে ছোট হলেও নির্ভুলভাবে আক্রমণ করতে সক্ষম ৷ যার অর্থ গোটা বিশ্বের কাছে এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছে ৷ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের নৌ-সেনাকে সমৃদ্ধ করেছে । ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি আকাশে 600 কিলোমিটার বা 373 মাইল পর্যন্ত দূরের টার্গেটে যেমন আঘাত হানতে পারবে, তেমনই আকাশে 400 কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত শত্রু পক্ষের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকেও ধ্বংস করে দিতে পারবে । এখানেই শেষ নয় । প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার বেগে ছোটা ওই সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র একই সঙ্গে দশটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নজর রাখারও ক্ষমতা রাখে । শত্রু পক্ষের সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যে দিক থেকেই ছোঁড়া হোক না কেন । আকাশে ঘণ্টায় ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির বেগ হবে কম করে 18 হাজার কিলোমিটার । এর রাডার ব্যবস্থাও আক্ষরিক অর্থেই, সর্বাধুনিক । অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ডুবোজাহাজের উপর কেউ কোনও রকম নজরদারি না চালাতে পারে ৷

Niamey (Niger), Jan 21 (ANI): External Affairs Minister S Jaishankar and President of Niger Issoufou Mahamadou jointly inaugurated Mahatma Gandhi International Convention Centre in Niamey, Niger. The centre pays tribute to Mahatma Gandhi whose 150th birth anniversary was observed in 2019. The Project of centre has been completed by Indian companies in 14 months.
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.