ভারত 3500 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম K 4 SLBM মিজ়াইলের (সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র) সফল উৎক্ষেপণ করে রবিবার (19 জানুয়ারি ) । অন্ধ্রের উপকূল এলাকা থেকে এই মিজ়াইলের সফল পরীক্ষা করা হল । যদিও এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি । এই অতি আধুনিক মিজ়াইলটি চিনের থেকে অনেকাংশেই দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং আধুনিক ।
ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিন থেকে ছোড়া যায় এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা ভারত এক দশকেরও বেশি আগে শুরু করে দিয়েছিল । 3500 কিলোমিটার পাল্লার এই K-4 মিজ়াইল তৈরির কথা গোপনই রেখেছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক । 2014 সালে প্রথমবার এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয় । উৎক্ষেপণের পরেও ভারত সরকার K-4 উৎক্ষেপণের কথা স্বীকার করেনি । 2015 সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানায় যে 2014-র মার্চে যে ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়েছিল, সেটি K-4 ।
2014 সালে K-4 ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সফল হয়েছিল ঠিকই । কিন্তু সে বার এই ক্ষেপণাস্ত্র তার পাল্লার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য অতিক্রম করেনি । 3000 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছিল K-4 । চলতি মাসের 19 তারিখ K-4 ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হয়, এবং সেটি এর পাল্লার পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উৎক্ষেপণ । অর্থাৎ সমুদ্রের তলা থেকে উঠে 3500 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে এ বার আঘাত হেনেছে K-4 ।
সমুদ্রের 30 ফুট গভীর থেকে K-4 নিক্ষেপ করা হয় । প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে নির্ভুল লক্ষ্যে নিখুঁত আঘাত হেনেছে ক্ষেপণাস্ত্রটি । হাইপারসনিক অর্থাৎ শব্দের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি বেগে ছুটতে সক্ষম এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী SLBM । অর্থাৎ ডুবোজাহাজ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর জন্য বিভিন্ন দেশের হাতে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী এবং শক্তিশালী ভারতের এই K-4 । নিউক্লিয়ার সাবমেরিন SLBM অরিহন্ত থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ব্যবহার করা হবে । এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করতে এবং তার প্রয়োজনীয়তা বিচার করে ব্যবহারের ক্ষেত্রে DRDO বহু বছর ধরে সক্রিয় । অতি সম্প্রতি ভারত পরমাণু অস্ত্র ক্লাবের সদস্য হয়েছে, এবং বেশ কিছু ঐতিহাসিক মাপকাঠিতে K-4 এর উৎক্ষেপণ । এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি রাশিয়া এবং অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতকেও একই পংক্তিতে বসিয়ে দিল ।
ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় 1980 দশকে অ্যামেরিকা এবং রাশিয়া নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারে SLBM মজুত করেছিল । পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম SSBN-র মাধ্যমে এই মিজ়াইল বহন করা হয়েছিল । সমুদ্রের 100 মিটার নীচ থেকে 1200 কিলোমিটার দূরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে যা সক্ষম ছিল । ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দাবি করেছিল সমুদ্র থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতাযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র তাদের হাতে আছে । মার্কিন সহযোগিতায় সেই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে বলেও দাবি ছিল তাদের । 1964 সালে পরমাণু অস্ত্র বহনে তাদের সক্ষমতার কথা ঘোষণা করে চিন । 1982 সালে প্রথমবার SLBM-এ সফল পরীক্ষা করে । মাঝারি পাল্লার JL-1 দিয়ে 1700 কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয় চিন ।
মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে চিন সাবমেরিনের ক্ষেত্র অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছে । 2018 সালের নভেম্বর মাসে চিন JL-3-র পরীক্ষা চালিয়েছিল, যা 9000 কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম । চিনের দাবি ছিল 2025 সালের মধ্যে আরও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে তারা ।
আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে ভারত সমুদ্র নিরাপত্তার বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে । সমুদ্রের তলদেশে নজরদারি চালানোর উপর জোর দেয় । এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, 2018 সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'জলের তলার কূটনৈতিক' নিয়ে টুইট করেন । প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন, পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম অরিহন্ত সফলভাবে সব পরীক্ষায় উতরে গিয়েছে । সেই টুইট ছিল প্রথম সরকারিভাবে ঘোষণা যে, ভারত সমুদ্র তলদেশে শক্তি মজবুত করতে সক্ষম হয়ে গিয়েছে । অরহস্ত 750 কিলোমিটার পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র বহন করতে পারে । SSBN-সিরিজ়ের নতুন সংস্কার আরও দূরে আঘাত হানতে সক্ষম ।
প্রাক্তন নৌ-সেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ ৷ COSC-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছিল ৷ যে দিন প্রথমবার অরহস্ত পরিক্রমণ করেছিল, সেই বিষয়টির দায়িত্ব সামলেছিলেন ৷ তিনি বলেন, এই মিজ়াইল হাতে আসায় সমুদ্র তলদেশে ভারতের শক্তি বহুগুণ বেড় গেল ৷ যে জায়গাগুলিতে এতদিন যাওয়া সম্ভব হত না, সেখানে খুব সহজেই নজরদারি চালানো সম্ভব হবে ৷ ভারতীয় নৌ-সেনা এই অত্যাধুনিক যানের সাহায্যে শুধু পরমাণু অস্ত্র বহন করতে সক্ষম তাই নয়, আবর সাগর বা বঙ্গোপসাগরে নজরদারি চালাতে পারবে ৷
ভারতের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন) INS অরিহন্ত ভারতীয় নৌ-সেনায় কমিশনড হয়েছে 2016 সালের অগাস্টে । নিয়মমাফিক তার আগেই একবার লম্বা সি ট্রায়াল (সমুদ্রে যাতায়াত এবং অস্ত্র প্রয়োগ) সেরে নিয়েছিল INS অরিহন্ত । নৌ-সেনার হাতে চলে আসার পরে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটিকে পাঠানো হয়েছিল ডেটারেন্স পেট্রলে । ভারতীয় জলসীমার ভিতরে এবং তা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমার নানা অংশ ঘুরে অরিহন্ত ফিরে এসেছে নির্দিষ্ট বন্দরে । এই দীর্ঘ মহড়ায় সমুদ্রের তলা থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের উপরে পরমাণু হামলা চালানোর মহড়াও অত্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে নিউক্লিয়ার সাবমেরিনটি । দেশের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রল মহড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক । স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের সাফল্যে উল্লসিত নৌ-সেনা । উল্লসিত দেশের প্রধানমন্ত্রীও ।
INS অরিহন্তের এই সফল ডেটারেন্স পেট্রল ভারতের সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিল । বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা । ভারতের 'পরমাণু ত্রিশূল' আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পূর্ণ হল ৷
পরমাণু ত্রিশূল কী?
পরমাণু ত্রিশূল হল স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর জন্য সক্ষম । স্থলভাগ থেকে ব্যালিস্টিক মিজ়াইল ছুঁড়ে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা অনেক আগেই অর্জন করেছে ভারত । পরবর্তীকালে ভারতীয় বায়ুসেনাও পরমাণু হামলা চালানোর পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলেছে । ব্রহ্মসের মতো মহাশক্তিধর এবং পরমাণু হামলায় সক্ষম ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার প্রতি সমীহ আরও বেড়েছে যে কোনও প্রতিপক্ষের । এ বার ভারতীয় নৌসেনাও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বিরাট স্বীকৃতি পেয়ে গেল । ফলে স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ— তিন অবস্থান থেকেই পরমাণু হামলা চালানোয় সক্ষম হয়ে উঠল ভারত ।
অ্যামেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স— এই পাঁচ দেশের হাতে পরমাণু ত্রিশূল রয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয় । তবে চিন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের পরমাণু ত্রিশূলের সক্ষমতা নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের সংশয়ও রয়েছে । স্থল, জল, অন্তরীক্ষের মধ্যে যে কোনও জায়গা থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা চিন, ব্রিটেন বা ফ্রান্সের রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না । পুরোদস্তুর 'নিউক্লিয়ার ট্রায়াড' বা পরমাণু ত্রিশূল অ্যামেরিকা এবং রাশিয়ার রয়েছে বলেই এতদিন ধরা হত । এ বার ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল যে, পরমাণু ত্রিশূল গঠন সম্পন্ন ।
পরমাণু ত্রিশূল থাকলে কী সুবিধা?
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরমাণু অস্ত্র হাতে থাকলেই পরমাণু হামলার জবাব দেওয়া যায়, এমন নয় । পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য যে কোনও পরমাণু শক্তিধর দেশেই একটি করে ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ থাকে । কিন্তু কোনও দেশ পরমাণু হামলার শিকার হলে ধ্বংসলীলা এত সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছনোর আশঙ্কা থাকে যে, ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয় । প্রথমে যারা পরমাণু হামলা চালাবে, তারা কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমটা ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই চালাবে, এমনটাও ধরে নেওয়া হয় । সে ক্ষেত্রে পালটা পরমাণু হামলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে আক্রান্ত দেশটি । তাই শুধুমাত্র দেশের মূল ভূখণ্ড বা স্থলভাগ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতায় সন্তুষ্ট হওয়া কাজের কথা নয় বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত । আকাশ থেকে বা জলভাগ থেকেও পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন । INS অরিহন্তের সাফল্যে সেই সক্ষমতায় ভারত পৌঁছে গেল ।
3500 কিমি দূরে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি আকারে ছোট হলেও নির্ভুলভাবে আক্রমণ করতে সক্ষম ৷ যার অর্থ গোটা বিশ্বের কাছে এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছে ৷ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের নৌ-সেনাকে সমৃদ্ধ করেছে । ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি আকাশে 600 কিলোমিটার বা 373 মাইল পর্যন্ত দূরের টার্গেটে যেমন আঘাত হানতে পারবে, তেমনই আকাশে 400 কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত শত্রু পক্ষের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকেও ধ্বংস করে দিতে পারবে । এখানেই শেষ নয় । প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার বেগে ছোটা ওই সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র একই সঙ্গে দশটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নজর রাখারও ক্ষমতা রাখে । শত্রু পক্ষের সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যে দিক থেকেই ছোঁড়া হোক না কেন । আকাশে ঘণ্টায় ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির বেগ হবে কম করে 18 হাজার কিলোমিটার । এর রাডার ব্যবস্থাও আক্ষরিক অর্থেই, সর্বাধুনিক । অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে ডুবোজাহাজের উপর কেউ কোনও রকম নজরদারি না চালাতে পারে ৷