ব্যবহার হয়নি একটিও বুলেট । তা সত্ত্বেও গত অর্ধ শতকের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী থাকল লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি । শহিদ হলেন ভারত ও চিনের একাধিক সেনা ।
ঠিক কী কারণে এতটা ভয়ঙ্কর হামলা চালাল চিনা সেনা ?
লোহার রড, পাথর দিয়ে ভারতীয় জওয়ানদের উপর হামলা চালানো হয় ৷ ভারত-চিন সম্পর্কের দিকে নজর রেখে চলা মানুষের মনে এই হামলার একাধিক কারণ সামনে এসেছে । মনে হচ্ছে যেন বহু দিনের পোষণ করা রাগের বহিঃপ্রকাশ করেছে চিন । যে অঞ্চলে এই সংঘাত হয়েছে অর্থাৎ DBO রোডের গালওয়ান ভ্যালির কাছে পেট্রল পয়েন্ট 14-তে ৷ গত বুধবার ওই অঞ্চলটিতে ভারতীয় ও চিনা সেনা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ৷ ওই এলাকায় ভারতীয়দের ট্রুপের মধ্যে ঢুকে পড়ে ওই চিনা সেনারা ৷
LAC
ভারত ও চিনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে খুবই দুর্বল একটি চুক্তি রয়েছে যা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল নামে পরিচিত । দুই দেশের সেনারই সীমান্ত নিয়ে মতভেদ রয়েছে । ফলে দুই দেশের সেনাই নিজেদের মতো করে ওই এলাকায় টহলদারি চালায় । লাদাখের এই অঞ্চলে দুই দেশের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও সীমান্ত রেখা পর্যন্ত নেই । সেনাবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিকদের মধ্যে সমঝোতা ও দুই বাহিনীর ধারণার ভিত্তিতে স্থির হয়-কোন দেশের সেনা কতটা এলাকা পর্যন্ত টহল দিতে পারবে । LAC-তে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে দুই বাহিনীর পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কিছু প্রোটোকল তৈরি হয়েছে ।
বিশাল উচ্চতায় থাকা LAC-তে টহলদারি চালায় ভারতীয় সেনা । কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় এলাকায় টহল দেন ভারত তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (ITBP)-এর জওয়ানরাও । তবে, সীমান্তের মূল বিতর্ক লাদাখের পূর্ব প্রান্তে থাকা প্যাংগং হ্রদ ও গালওয়ান উপত্যকা ঘিরে । প্যাংগং হ্রদের এক তৃতীয়াংশ চিনের দখলে । বাকি অংশ ভারতের । ভৌগোলিকভাবে দু’টি অঞ্চল রয়েছে— ফিঙ্গার 4 ও ফিঙ্গার 8 । চিন ফিঙ্গার 4-কে LAC হিসেবে মানে । আর ভারত LAC হিসেবে মানে ফিঙ্গার 8-কে ৷
লাদাখের সীমান্তে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছে গালওয়ান উপত্যকার দুর্বক, শায়ক ও DBO রোডে । উত্তর লাদাখে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সরবরাহ যথাযথ রাখার জন্য এই রাস্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সেই কারণেই গালওয়ান ভ্যালির গুরুত্ব অনেকখানি ৷ কারণ এই ভ্যালি এই প্রধান রাস্তাটিকে রক্ষা করে । এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে চিনা সেনা কেন ফিঙ্গার 4 - এ পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়েছে ৷ এর ফলেই দুই দেশের বাহিনী মুখোমুখি চলে এসেছে ।
গালওয়ান ভ্যালি
ভারতীয় সেনার জন্য গালওয়ান ভ্যালির গুরুত্ব অপরিসীম । গালওয়ান ভ্যালির ঠিক পিছনে আকসাই চিন থাকায় এর গুরুত্ব চিনের কাছেও মারাত্মক । পূর্ব লাদাখে থাকা ভারতীয় বাহিনীর জন্য ও DBO রোডের নিরাপত্তার জন্য ভারতের কাছে গালওয়ান উপত্যকার গুরুত্ব সম্পর্কে চিন অবহিত । এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের স্থিতাবস্থা নষ্ট করার লক্ষ্যেই ভারতীয় সেনা জওয়ানদের উপর সাম্প্রতিক হামলা চালিয়েছে চিনা সেনা । 6 জুন দুই বাহিনীর কর্পস কমান্ডার স্তরের সমঝোতার ভিত্তিতেই ওই অঞ্চলে টহলদারি চালাতে গিয়েছিল ভারতীয় সেনার একটি দল । কর্নেল সন্তোষ বাবুর নেতৃত্বে যাবতীয় প্রোটোকল মেনে ওই দল যখন ওই এলাকায় যায়, তখন তারা সেখানে কয়েকটি কাঠামো দেখতে পেয়ে সেগুলি ভাঙা শুরু করে । তখন সেখানে আগে থেকে উপস্থিত চিনা সেনার বড় একটি দল ভারতীয় জওয়ানদের উপর হিংস্রভাবে আক্রমণ করে । তারা আগে থেকে তৈরি হয়ে এসেছিল ও তাদের কাছে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল হিংসাত্মক হামলার । ঠিক উলটো ছিল ভারতীয় সেনারা ৷ যারা প্রথম দিন থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছিল ।
এই ঘটনার পিছনে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে । এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জম্মু কাশ্মীরের বদল । চিনের এই হিংসাত্মক কার্যকলাপের আর একটি কারণ হল এই এলাকায় ভারতের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন । এই অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম ও জনপদগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ভারত পাকা সড়ক, সেতু প্রভৃতি তৈরি করছে । এর ফলে LAC-র গ্রামগুলির মানুষের জীবনধারণে অনেক উন্নতি হবে । জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ পাওয়া ও সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনে আনা, লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীরের মানচিত্র থেকে বের করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা , জম্মু ও কাশ্মীর থেকে 370 ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত চিনা সরকারের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ । সীমান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে এর আগে পর্যন্ত লাদাখ বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অন্যতম পক্ষ হতেই হত । কিন্তু এখন প্রশাসনিক চরিত্র বদলের ফলে এই বিষয়টির আর কোনও গুরুত্বই থাকল না ।
এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে লাদাখের সীমান্ত নিয়ে কোনও দিন কোনও সমস্যা ছিল না বা হঠাৎ করে সমস্যা শুরু হয়েছে । চিন ও ভারতের সেনা পর্যায়ের রুটিন বৈঠক হয় প্রায় প্রতি সপ্তাহে । সমস্যা যাতে আর না বাড়ে সে দিকে খেয়াল রেখে ও রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে করা হচ্ছিল পদক্ষেপ । কিন্তু বর্তমান সময়ে সমস্যা হঠাৎই অনেকটাই বেড়ে গেছে । চিন ঠিক সময় বুঝেই সমস্যা তৈরি করছে ৷ কারণ চিনের প্রতি পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ভালো সমর্থন রয়েছে । কালাপানি লেপুলেকে ভারত ও নেপালের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ভারত ও নেপালের সম্পর্ক এর আগে কখনও এতটা খারাপ হয়নি । এমনকী LoC-তে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কও যথেষ্টই উদ্বেগজনক ।
CPEC (চিন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর)
চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে এই এলাকার জন্য গেম চেঞ্জার বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তান দিয়ে কাশগড় ও আরব সাগরের যোগাযোগ চিনা অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আনবে । CPEC নিয়ে চিনকে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ সমর্থনের ফলে কাশ্মীর ইশুতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে সমর্থন করেই চলেছে চিন । নিজের স্বার্থেই চিন বরাবর পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইশুতে সমর্থন করে এসেছে ৷ FATF-এর ব্ল্যাক লিস্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে এসেছে । এমনকী কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী মৌলানা মাসুদ আজহারকে বাঁচানোর জন্যও সব রকম চেষ্টা চালিয়েছে চিন । এই মাসুদ আজ়হারকে পর্তুগিজ পাসপোর্টসহ ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ও যাকে পরে IC-814-এর অপহৃত যাত্রীদের বিনিময়ে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ভারত । এই বিমানটি পঞ্জাব থেকে নেপাল যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল । এই আজ়হার জইশ-ই-মহম্মদ নামক জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তান থেকে কার্যকলাপ চালিয়ে যায় । ভারত যখন আজ়হারকে রাষ্ট্রসংঘের ব্ল্যাক লিস্টেড আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে তখন চিন ভারতের সেই চেষ্টা রুখে দেয় । পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি সংগঠনগুলির বড় প্রভাব রয়েছে । তাই আজ়হারের মতো সন্ত্রাসবাদীদের চটিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরিতে কোনও রকম সমস্যা হোক তা চায়নি চিন ।
এই অবস্থায় প্রশ্ন হল, সীমান্তের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে সমস্যা মেটাতে ভারতের কী করা উচিত । ভারতের প্রথমেই উচিত নেপালের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে একটা সুষ্ঠু সমাধান বের করা । দ্বিতীয়ত, চিনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা । আলোচনার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তবেই সেনা ব্যবহারের বিষয়ে ভাবা উচিত । সেনা ব্যবহারকে একেবারে শেষ অস্ত্র হিসেবে দেখা উচিত । LoC এবং LAC দুটোকে একেবারে আলাদা বিষয় হিসেবে দেখা উচিত । LoC-র সমস্যা কয়েক যুগ ধরে চলে আসছে । তবে পাকিস্তান ও চিনের আঁতাতের সম্পর্কের দিকে দেখলে এই সমস্যার সমাধান হওয়া কঠিন বলেই মনে হয় । কোনও রকম সংঘর্ষে না গিয়ে চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়টাই সবচেয়ে বেশি কাম্য । আর তা না হলে সব পক্ষই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই ।