শ্রীনগর : এই প্যানডেমিক সারা বিশ্বকে কার্যত স্থবির করে দিয়েছে ৷ ভারতের আদালতের রায় দেওয়ার প্রক্রিয়াও বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷ এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে আদালতের কাজ শুরু হয়েছে ৷ ফলে বিচারক, আবেদনকারী ও অন্য অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে ভার্চুয়াল এজলাস বসছে
৷গতকাল, ETV Bharat-এর প্রতিবেদকের এই ধরনের একটি মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল ৷ ওই মামলার আবেদনকারী কাশ্মীর বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মঈন আবদুল কায়ুম ৷ তিনি তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে নিজের মুক্তির আবেদন করেছেন ৷ গত বছর অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও ৩৫এ-র অবলুপ্তির পর তাঁকে জনসুরক্ষা আইনে (PSA) গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৷ এই রিপোর্টার আগেও এজলাসে একাধিক মামলার শুনানির সময় উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছেন ৷ কিন্তু ভার্চুয়াল এজলাসে উপস্থিত থাকার বিষয়টি একেবারে ভিন্ন এবং আকর্ষণীয় ৷
আমার অভিজ্ঞতা শোনানোর আগে আপনাদের বলতে চাই যে জম্মু ও কাশ্মীর উচ্চ আদালত মামলার শুনানির জন্য তৈরি বিশেষ একটি ভিডিয়ো অ্যাপ ব্যবহার করে এই কাজ করছে ৷ ওই অ্যাপের মাধ্যমে মামলার শুনানি চলাকালীন নথি শেয়ার করার সুযোগ রয়েছে ৷ আবেদনকারীকে আগেই ভার্চুয়াল এজলাসের জন্য নাম নথিভুক্ত করতে হয় ৷
আইনজীবী মঈম তুফেইল আহমেদ, যিনি মঈন কায়ুমের আইনি দলের অংশ, তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘শহরে এখন লকডাউন চলছে এবং এমন অনেক শুনানি স্বশরীরে হাজির হয়ে করা যাচ্ছে না ৷ তা ভার্চুয়াল মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে ৷ আবেদনকারী অথবা তাঁর আইনজীবীকে জম্মু ও কাশ্মীর উচ্চ আদালতের রেজিস্ট্রারকে শুনানির বিষয়ে জানাতে হচ্ছে ৷ আমরা তালিকা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিচারপতির সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারি ৷ যদি অনুমতি
দেওয়া হয়, তখন শুনানির তারিখ ও সময় নির্ধারিত হয় ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘শুনানি ভিডিয়ো না কল কনফারেন্সে হবে ? সেই সিদ্ধান্তের ভার রয়েছে বিচারপতির উপর ৷ কায়ুম স্যারের মামলায় ভিডিয়ো কনফারেন্সের অনুমতি দেওয়া হয় ৷ ইন্টারনেট সংযোগের খারাপ অবস্থার জন্য অনেক সময় শুনানির দিন-সময় নতুন করে নির্ধারিত হয় ৷ আমরা আগের একাধিক শুনানিতেও এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি ৷’’
সাংবাদিক বা অন্য কোনও তৃতীয় পক্ষকে কি এই ধরনের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী শুধুমাত্র ‘প্রতিবেদনযোগ্য’ মামলার শুনানির ক্ষেত্রেই সাংবাদিককে থাকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ৷ তাঁদের ভিডিয়ো রেকর্ড করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না ৷ কিন্তু তাঁরা অডিয়ো বা অন্য কোনও তথ্য রেকর্ড করতে পারেন ৷ যদিও সামাজিক, শারীরিক দূরত্ব বজায় এবং অন্য Covid-19 নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে ৷ সাধারণ এজলাসের সমস্ত নিয়মও ভার্চুয়াল ক্ষেত্রেও মেনে চলা হচ্ছে ৷’’
আদালতের প্রক্রিয়া
মঈন আবদুল কায়ুম মামলার শুনানি সকাল ১১টায় হাইকোর্টের দুই বিচারপতি আলি মহম্মদ মাগরে ও বিচারপতি বিনোদ চ্যাটার্জি কৌলের বেঞ্চের এজলাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল ৷ আদালত এই মামলার অন্য প্রক্রিয়া মে মাসের ১৮ তারিখই শেষ করে ফেলেছিল ৷ বেঞ্চের দ্বারা রায়দান হবে বলে মঈন কায়ুমের আইনি দলের তরফে এই প্রতিবেদক ও উপত্যকার আরও দুই সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ৷ আইনজীবীর
বাড়িটিকে ভার্চুয়াল এজলাসে পরিণত করার বিষয়টি বেশ উল্লেখযোগ্য ৷ বিচারপতিরা এবং আইনজীবীরা কালো কোট ও গাউন পরেই হাজির হয়েছিলেন ৷ দেখে মনে হচ্ছিল তাঁরা এজলাসেই রয়েছেন ৷ পার্থক্য বলতে শুধু ছিল নথির কাগজের বদলে হার্ড ডিস্ক ও পেন ড্রাইভ ৷
যে মূহূর্তে ভিডিয়ো অ্যাপ অন হল, তখন একজন বিশিষ্ট আইনজীবী সহজে বুঝিয়ে দেন যে, এর আগে ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় একাধিক প্রচেষ্টাতেও নথি আপলোড করা যায়নি ৷ তাই শুনানির দিন ফের নির্ধারিত করতে হয় ৷ আমাদের জানানো হয় যে, মোবাইল ফোন ফ্লাইট মোডে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ৷ আর রায়দানের সময় নীরব থাকতে হবে ৷ অ্যাপ্লিকেশনে সংযোগ করা গিয়েছিল তিন-চার বারের চেষ্টায় ৷
‘একটা স্ক্রিন, দশটা উইনডো’
অ্যাপ্লিকেশন খোলার পর আমরা বিচারপতি মাগরে, বিচারপতি কৌল, বিশিষ্ট আইনজীবী জাফর শা, আইনজীবী মঈন তুফেইল আহমেদ, আইনজীবী এন এ রোঙ্গা, অ্যাডভোকেট জেনারেল ডি সি রায়না, সিনিয়র অ্যাডিশনাল অ্যাডভোকেট জেনারেল বি এ দার, অ্যাডিশনাল অ্যাডভোকেট জেনারেল শাহ আমির, অ্যাডিশনাল অ্যাডভোকেট জেনারেল অসীম শনে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সলিসিটার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া তাহির মাজিদ শামসিকে দেখতে পাই ৷ কিন্তু কাশ্মীর বার অ্যাসোসিয়েশনের বন্দী সভাপতি মঈন আবদুল কায়ুমকে আমরা দেখতে পাইনি ৷
পরে একজন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যাখ্যা করেন যে ‘‘যদি বিচারপতি চান তাহলেই আবেদনকারীকে ডাকা হয় ৷ তাছাড়া, আজ শুধু রায়দানের দিন ছিল ৷’’
আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা বিনিময় এবং ইন্টারনেট-সহ সমস্ত সংযোগ যাচাই করে নেওয়ার পর বিচারপতি মাগরে রায়দান শুরু করেন ৷ দশ মিনিট ধরে পড়া ওই রায়ে বিচারপতি মাগরে আবেদন খারিজ করে দেন এবং বিচারপতি মাগরে বলেন : ‘‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন আইন বেআইনি নয় ৷ কারণ, প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনে নেওয়ার জন্য এর মধ্যে কোনও আপত্তিজনক নিয়মের উল্লেখ নেই ৷ এবং বিষয়টি নির্বাহী ব্যক্তির বিষয়গত সন্তুষ্টির দিকে ছেড়ে দেন । এর কারণ প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয় ৷ এটা শুধুই প্রতিরোধক ৷ এবং এটা শেষ করা হয় এই বলে যে, কোনও ব্যক্তিকে আটক করা মানে তাঁকে বিচারের আগে কিছু বিষয় থেকে আটকানো ৷ আইনে তেমনই বলা আছে ৷’’
তিনি এর পর বলেন, ‘‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন সন্দেহের উপর ভিত্তি করে হয়, কোনও প্রমাণের ভিত্তিতে নয় ৷ কোনও রাজ্যের সুরক্ষা, সরকারি নির্দেশের রক্ষা বা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা এবং সরবরাহের দায়িত্বের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আধিকারিকরা অবশ্যই প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের মতো পদক্ষেপ করতে পারেন ৷ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার
পর পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করে আদালত ৷ প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের মতো পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে আটককারী কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় । কোনও ব্যক্তিকে আটক করার জন্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কাঁটাছেড়া করার উপযুক্ত স্থান আদালত নয় ৷ এই বিষয়টি সঠিক অ্যাডভাইসারি বোর্ডকে করতে হবে ৷ আটক করার এক্তিয়ার নিয়ে এই শুনানি বসেনি ৷ আটক করার বিষয়ে আদালত কর্তৃপক্ষের উপর নিজেদের মতামত চাপাতে পারে না, যখন আটক করার কারণ যথোপযুক্ত, প্রাসঙ্গিক, অনুমান সাপেক্ষ এবং বাস্তবসম্মত ৷’’
বিচারপতি মাগরে বলেন, ‘‘আমরা গোয়েন্দা রিপোর্ট পড়ে দেখেছি ৷ যেখানে ২০১০ সালের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আটক করেছে ৷ যা আটকের নির্দেশ সংক্রান্ত নথিতে উল্লেখ করা আছে ৷ সেই নথি সন্তোষজনক ৷ এই রিপোর্ট নতুন তথ্য তৈরিতে কার্যকর বলা যেতে পারে ৷’’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘‘FIR-এ যে আদর্শের কথা বলা হয়েছে এবং আটক (কায়ুম)-এর বিরুদ্ধে যা অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অনেকটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ৷ আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০০৮ ও ২০১০ সালে চারটি FIR দায়ের করা হয়েছিল ৷ ওই FIR-এ তাঁর কার্যকলাপের যে অভিযোগ রয়েছে, তা আদালতকে জানানো হয়েছিল ৷ এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তাঁর অতীত কার্যকলাপের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রয়েছে ৷ নতুন FIR-এ উল্লেখ করা হয় যে, তিনি নিজের পুরনো কার্যকলাপ বন্ধ করে দেননি ৷’’
সব শেষে বিচারপতি কৌল বলেন, ‘‘অ্যাডভোকেট জেনারেলের আইনত সঠিক এবং ভালো সওয়ালের উপর ভিত্তি করে আমরা আটক ব্যক্তির উপর সব ছাড়লাম ৷ তিনি কি অ্যাডভোকেট জেনারেলের অবস্থানের সুযোগ নেবেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হয়ে নিয়ম মেনে প্রতিনিধিত্ব করবেন ? এটা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর ছাড়া হোক, যে তারা JK PSA-র অধীনে এই আটক ব্যক্তির দ্বারা এমন প্রতিনিধিত্বের সিদ্ধান্ত নেবেন কিনা ৷ এটি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এই জাতীয় কোনও আবেদনের প্রেক্ষিতে যদি কোনও বিপরীত রায় দেওয়া হয়, তবে কোনও অবস্থাতেই কোনও আইনি প্রক্রিয়া চলবে না ।’’
রায়দান চলার সময় তাতে উল্লেখ করা AAG বি এ দারের সওয়ালের বিরুদ্ধে পালটা সওয়াল করার চেষ্টা করেন জাফর শাহ এবং অন্য আইনজীবীরা ৷ কিন্তু বেঞ্চ মঈন কায়ুমের আইনি দলের কোনও আপত্তিকেই গুরুত্ব দেয়নি ৷
রায়দান শেষের পর খারিজ হওয়া পক্ষের আইনজীবী বলেন : ‘‘আমরা মামলাটি হেরে গেলাম ৷ এটাই সব ৷ আমরা এখনও অন্য বিকল্প খুঁজছি ৷ পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে ঘোষণা করার আগে আমরা কিছুটা সময় অপেক্ষা করব ৷’’