মহিলা এবং শিশুদের উপর অন্যায়ের প্রতিবাদে সবসময় সরব হয়েছেন মহাত্মা গান্ধি । এমনকী যুগ যুগ ধরে চলে আসা মহিলাদের উপর অন্যায়, ধর্ম শাস্ত্রে বলা কথারও বিরোধিতা করেছেন ।
1) কন্যাসন্তান হত্যা: বরাবরই কন্যাসন্তান হত্যার বিরোধিতা করে এসেছেন গান্ধিজি । এক সময় কোনও পরিবারে কন্যাশিশু জন্মালেই খুশির হাওয়া উবে যেত । কন্যাসন্তান মানেই ছিল সংসারের বোঝা । ভবিষ্যতে তার বিয়ে দেওয়ার, যৌতুক দেওয়ার খরচ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তেন পরিবারের লোকজন । অথচ উলটো দিকে পরিবারে পুত্রসন্তান জন্মালেই খুশির রেশ বয়ে যেত । গান্ধি লক্ষ্য করেছিলেন বিষয়টি । বিরোধিতা করেছেন এইরকম পক্ষপাতিত্ব আচরণের । তিনি সব সময় বলে এসেছেন কন্যা ও পুত্র সন্তানের মধ্যে কখনওই পার্থক্য করা উচিত না । দু'জনের জন্মেই আনন্দিত হওয়া উচিত । এছাড়াও তিনি বরাবর পণপ্রথার বিরোধিতা করেছেন ।
2) নারী শিক্ষা: গান্ধি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার অভাবই নারীদের উপর হওয়া অন্যায়-অত্যাচারের মূল কারণ । তিনি সবসময় নারী শিক্ষার পক্ষে কথা বলে এসেছেন । মহিলা ও পুরুষ উভয়েরই শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করতেন তিনি । শিক্ষাই একমাত্র নারীকে তাঁদের অধিকার সম্বন্ধে অবগত করাতে পারে, যে কোনও কাজকে প্রকৃতভাবে অনুশীলন করতে সাহায্য করতে পারে । শিক্ষার মাধধ্যমেই একজন নারী নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে ।
3) বাল্য বিবাহ: বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধেও সুর চড়িয়েছিলেন গান্ধিজি । বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের দুইজনেরই সম্মতি থাকা উচিত বলে মনে করতেন তিনি । জোর করে, বলপূর্বক বিয়ে দেওয়া তাঁর মতে ছিল অন্যায় । তিনি বিশ্বাস করতেন বিয়ের জন্য একজন ছেলে অথবা মেয়ের পুরোপুরি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিকশিত হওয়া প্রয়োজন । জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের স্বাধীনতা থাকা উচিত । তাঁর মতে, বাল্য বিবাহ সমাজের উপরই শুধু অভিশাপ নয় তা এক শারীরিক যন্ত্রণাও বটে । বাল্য বিবাহকে সর্বদা তিনি এক অনৈতিক এবং অমানবিক কাজ হিসেবে দেখতেন , যেখানে নিরীহ শিশু কন্যাকে অভিলাষের বস্তুতে পরিণত করা হত । অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে অকালেই স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেত । কম বয়সে বিধবা হত অনেকে । তিনি বিশ্বাস করতেন বাল্য বিবাহ নারীদের উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে । স্কুলে যাওয়ার বয়সে মা হয়ে যেত মেয়েরা । বিষয়টির বিরুদ্ধে বরাবর প্রতিবাদ জানিয়েছেন গান্ধি । তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করে বলেছেন , নারীদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই বাল্য বিবাহ । এই কারণেই মেয়েরা শিক্ষার অধিকার, সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । অকালেই হারাচ্ছে শৈশব । সবচেয়ে ভয়ংকর এই প্রথার ফলে তাদের শারীরিক, মানসিক ক্ষতি হচ্ছে । কারণ মহিলারা অল্প বয়সেই তার স্বামীর ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছে । তিনি বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে সবাইকে এক সঙ্গে বিরোধিতা করার আহ্বান জানান । এক সঙ্গে এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে বলেন । বাল্য বিবাহ বন্ধের আইনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি ।
4) পণপ্রথা: গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন যৌতুকের নিয়ম কম বয়সি মেয়েদের বেচা কেনার সামগ্রী হিসেবে পরিণত করেছে । এই প্রথা নারীদের মর্যাদা হ্রাস করে । নারী পুরুষের সমানাধিকার বিষয়টিকেও নস্যাৎ করে । বিয়ে নামক প্রথাটির এ এক লজ্জা । এর জন্য অভিভাবকদের সব সময় মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার উপদেশ দিতেন । শিক্ষাই একমাত্র পণ চাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস জোগাতে পারে । যৌতুকের বিরুদ্ধে সব সময় জনমত গঠনের চেষ্টা করতেন । যারা যৌতুক নেওয়ার পক্ষপাতি তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার হওয়া উচিত বলে মনে করতেন ।
5) বহু বিবাহ ও স্ত্রীদের বশীকরণ: গান্ধির মতে একজন স্ত্রী কখনই তাঁর স্বামীর দাস নয় । বরং তাঁর সহকর্মী এবং বন্ধু । প্রত্যেক ক্ষেত্রে একজন স্ত্রীরও সমান অধিকার রয়েছে । পারস্পরিক বিশ্বাস থাকতে হবে । গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন একজন নারী তাঁর স্বামীর অপরাধের ভাগীদার নন । স্বামী কোনও ভুল করলে তা তিনি শুধরে দিতে পারেন । স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি অবিচার করে, তবে স্ত্রীর আলাদা থাকার অধিকার রয়েছে । দু'জনের মধ্যে কেউই খুশি না থাকলে তাঁদের আলাদা থাকার অধিকার রয়েছে ।
6) শ্লীলতাহানি: তিনি চেয়েছিলেন অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য নারীরা আত্মরক্ষার কৌশল শিখুক । অন্যায়ের শিকার হলে কখনওই একজন নারীর চুপ করে থাকা উচিত নয় বলে তিনি মনে করতেন । আত্মরক্ষার্থে সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত ।
নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে ছিলেন গান্ধিজি
গান্ধিজি নারীদের উপর আরোপিত নানা অন্যায় নিয়ম নীতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন । পাশাপাশি তাঁদের সমানাধিকারের পক্ষেই কথা বলে এসেছেন সর্বদা ।
1) শিক্ষা: বরাবরই নারী শিক্ষার প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন গান্ধিজি । তাঁর বিশ্বাস ছিল শিক্ষাই একমাত্র নারীদের সমাজের অন্ধকার দিকটি থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে । শিক্ষা নারীর অধিকার হওয়া উচিত । সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রেও নারীদের শিক্ষা আবশ্যক বলে মনে করতেন তিনি।
2) সম্পত্তি: গান্ধিজি লক্ষ্য করেছিলেন ব্রিটিশ শাসনে সম্পত্তি আইন মহিলাদের বিরোধী । আইন বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিশ্বাস করতেন বিবাহিত মহিলাদেরও সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমান অধিকার রয়েছে তাদের স্বামীদের মতো । সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনে সমানাধিকারের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি ।
3) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: তিনি নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষেই বরাবর সওয়াল করেছেন । তখনকার দিনে অনেকের আশঙ্কা ছিল নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসলে তাদের মধ্যে অনৈতিকতা বাড়বে । পারিবারিক জীবন ব্যাহত হবে । এই চিন্তাধারাকে নস্যাৎ করে তাঁর জবাব ছিল, নৈতিকতা কোনও পুরুষ বা মহিলার অসহায়ত্বের উপর নির্ভর করে না । এটি অন্তরের বিশুদ্ধতার পরিচয় হওয়া উচিত । তিনি চেয়েছিলেন মহিলারা পরিবারের উপার্জনের পরিপূরক হিসাবে কাজ করুক । চরকার সাহায্যে আয় করার কথা বলেছিলেন । সব ক্ষেত্রে মহিলাদের সমান বেতন দেওয়ার সুপারিশও করেছিলেন গান্ধিজি ।
4) নারীর সঙ্গেও সমান ব্যবহার: বিশ্বের জন্য নারী-পুরুষ দু'জনেরই যে প্রয়োজন রয়েছে সেকথা উপলব্ধি করেছিলেন তিনি । অভিভাবকদের তাই ছেলে-মেয়ে উভয়ের সঙ্গে সম আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন ।
5) স্ত্রী স্বামীর সমান: তিনি চেয়েছিলেন প্রত্যেক স্বামী তার স্ত্রীকে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ এবং ‘সহধর্মিণী’ বলে বিবেচনা করুক । স্ত্রী স্বামীর বন্ধু হয়ে উঠুক । সব কাজেই অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে নারীর ।
6)নারী- পুরুষ সমান: গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন নারী-পুরুষ সমান । দু'জনেরই আত্মা এক । যেহেতু আত্মার কোনও লিঙ্গ হয় না তাই ভগবানের চোখ নারী-পুরুষ সকলেই সমান । তাঁর বিশ্বাস ছিল পুরুষদের মতোই নারীদের সমান ভাবনা চিন্তার ক্ষমতা রয়েছে । সব কাজেই তাদের তাই সমানাধিকার রয়েছে ।
7) মহিলাদের আলাদা পরিচয় রয়েছে : গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক মহিলার আলাদা পরিচয় থাকা উচিত । তারা কখনওই শুধুমাত্র পুরুষের পণ্য না । তাদের আলাদা পরিচয় গড়ে উঠলে তাদের উপর হওয়া অত্যাচারও কমবে । প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীরও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি ।
8) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা : গান্ধিজির বিশ্বাস ছিল চরকার মাধ্যমে ভারতে পুনর্জাগরণ হতে পারে । দাসত্ব থেকে মুক্তি মিলতে পারে । নারীরা চরকার সাহায্যে দেশীয় পোশাক বুনে বিদেশি পোশাক বর্জন করতে পারবে । মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটি আয়ের এক প্রধান উৎসও হয়ে উঠতে পারে । জীবিকার উপায় হতে পারে খুব দরিদ্র মহিলাদের । মহিলারা স্বনির্ভর হলে তাদের জীবনধারাও পরিবর্তিত হবে বলে বিশ্বাস করতেন গান্ধিজি ।
9)অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা: মহিলারা শিক্ষা গ্রহণ এবং জনসমাজে অংশ নেওয়ার পর নিজস্ব অবস্থান এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন । তৈরি হয় বহু মহিলা সংগঠন ।
10) নারী পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ : গান্ধি শুধু যে পুরুষ- নারী সমান তাই বিশ্বাস করতেন না । তিনি বিশ্বাস করতেন নারী পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ । তাঁর কাছে সাহসিকতার অর্থ ছিল দুঃখ ও ত্যাগ । তাই নারীদের আত্মত্যাগ সাহসিকতার পরিচয় দেয় ।
11) নারী শক্তির প্রতীক : গান্ধি বিশ্বাস করতেন নারী হল ভগবানের উপহার । তাদের মধ্যে এক অসামান্য শক্তি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে । তারা যদি নিজেদের এই শক্তিকে উপলব্ধি করে তাকে ব্যবহার করতে পারে, তাহলে এক মুহূর্তে দুনিয়াকে চমকে দিতে পারবে ।