ETV Bharat / bharat

অজানা থেকে গেল অনেক কিছু...

আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । 2012 সাল থেকে 2017 সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন । 2009 সাল থেকে 2012 সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন । 1980 সাল থেকে 85 সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় নেতা পদে নিযুক্ত ছিলেন ।

pranab mukhopadhyay
pranab mukhopadhyay
author img

By

Published : Aug 31, 2020, 5:59 PM IST

Updated : Aug 31, 2020, 6:50 PM IST

ইন্দিরা গান্ধি যদি হন ভারতীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের সব থেকে মোহময়ী নায়িকা । মনমোহন সিং যদি হন ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম সেরা নায়ক । পি ভি নরসিমা রাও যদি ভারতীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের অন্যতম চর্চিত চরিত্র হয়ে থাকেন, তাহলে এই সব চিত্রনাট্যের প্রযোজক কিন্তু একজনই ।

আর প্রযোজকের ভূমিকা সামান্যতম টালমাটাল হলে কোনও চলচ্চিত্রই সার্থক রূপ পায় না ।

সেই প্রযোজকের আজ অবসান হল । ভারতীয় রাজনীতি হারাল তার বর্তমান চাণক্যকে । প্রয়াত হলেন দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় । পরিসমাপ্তি ঘটল এক অভিনব কংগ্রেসি যুগের ।

তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নম্বর-টু ছিলেন । তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের নম্বর-টু ছিলেন । আবার সেই মানুষটিই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়েরও নম্বর-টু হয়েছিলেন । তাই হয়ত, অনেকে বলতেন ভারতীয় রাজনীতির তিনি হলেন পারপিচুয়াল নম্বর টু ।

বাংলার এক অখ্যাত গ্রাম থেকে দেশের প্রথম নাগরিক । বরবারই তিনি ছিলেন আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে । প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও ভারতীয় সংবিধানে প্রধান নাগরিক, দেশের সাংবিধানিক প্রধান হওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন । কী ভাবে তিনি সে কাজে সফল হলেন, বিপুল ভোটে জিতলেন সে ইতিহাস নতুন করে আলোচনা করার সময় এটা নয় । কিন্তু তিনি ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ হওয়ার পর কী ভাবে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠলেন সেটাই হয়ত আজকের দিনে প্রধান বিচার্য । প্রণববাবুর জীবন তাই এক কথায় ‘নম্বর টু’ থেকে ‘নম্বর ওয়ান’ হয়ে ওঠার কাহিনি । ভারতের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীই প্রকৃত নম্বর ওয়ান । রাষ্ট্রপতি হলেন ‘সেরিমোনিয়াল হেড’। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পাঁচ বছরে সেই জাঁকজমক সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় থেকেও প্রণববাবু প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এ দেশেও ব্রিটেনের রানির মতো রাষ্ট্রপতির পদেরও ক্ষমতার এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিসর আছে । নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনও সংঘাতে না গিয়েও প্রণববাবু দেখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে এই পরিসরটুকুতে এত সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সক্রিয় থাকা যায় । রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনও মতপার্থক্য হয়নি তা কিন্তু নয় । কিন্তু সে কথা কখনওই বাইরে প্রকাশিত হয়নি ।

আসলে প্রকাশ্যে দাপাদাপি না করে নীরবে নিভৃতে কাজ করার মানসিকতাটা চিরকালই ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের । আর এই মানসিকতাই হয়ত তাঁকে নেহরু-গান্ধির কংগ্রেসে একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি এনে দিয়েছিল । সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও নিজের সেই পরিচিতিকে তিনি কখনই হারতে দেননি ।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাই তিনি নিজের সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও এক নিরপেক্ষ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন । মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদী দর্শনে বলে, বস্তু থেকেই ভাবনা উৎসারিত, কিন্তু সেই ভাবনা বা নিজস্বতার কিছু নিজস্ব পরিসর তৈরি হয় । সেই পরিসরটি হল, সৃজনশীল পরিসর । সামগ্রিক ভাবে ‘আইডিয়া’ বস্তু থেকেই সম্পূর্ণ উৎসারিত । অতএব, তার কোনও নিজস্ব পরিসর নেই, এ কথা যাঁরা বলেন তাঁরাই ‘ডিটারমিনিজ়িম’ বা নির্দেশ্যবাদের দ্বারা আক্রান্ত । প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি পদের সাংবিধানিক পরিসরটুকুও এ রকমই ছিল ।

প্রণববাবুর রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সারা জীবন ধরে এক জন সফল ‘ব্যাকরুম বয়’। বলা যায়, সারা জীবন তিনি ‘ব্যাক সিট ড্রাইভিং’ করেছেন । বলা যেতে পারে, তিনি যেন নাট্যমঞ্চের ‘গ্রিনরুম ম্যান’, নাটক বা ফিল্মের প্রযোজকের ভূমিকায় । তিনি নায়ক নন । কিন্তু অন্যতম ‘প্রোডিউসার অফ দা শো’। আর এই কমিটিতে সফল হওয়ার জন্য তাঁর চরিত্রে প্রধান গুণ ছিল, তিনি চিরকাল সকলকে ‘অন বোর্ড’ নিয়ে চলতে চেয়েছেন । তা সে লালুপ্রসাদ যাদবই হোন বা লালকৃষ্ণ আদবানি । তিনি ‘প্লুরালিস্ট’, তিনি ‘ম্যান অফ গ্রেট কনসেন্সাস’। ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বসম্মতিতে তৈরি রাজনীতির তিনি অন্যতম জনক । এই একটা বৈশিষ্ট্যের জন্য পরমাণু চুক্তির সময় মনমোহন সিংহের আমলেও প্রকাশ কারাত ও সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে আলোচনায় বিবাদ মেটানোর দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনিই । আক্রমণাত্মক BJP-কে ঠান্ডা করার জন্য কংগ্রেস জমানায় প্রণববাবুকেই মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিতেন সনিয়া গান্ধি । আবার কূটনৈতিক সমস্যায় বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন ভরসার পাত্র ।

বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে ভারতের সবচেয়ে পুরানো রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠা । সেখান থেকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান । কাহিনি বিস্ময়ের ‌। ছিল না কোনও পারিবারিক প্রভাব । সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় ক্ষমতার অলিন্দে কান্ডারি হয়ে উঠেছিলেন । বিধানচন্দ্র রায়ের পর দ্বিতীয় বাঙালি প্রশাসক ভারতরত্ন পেয়েছেন ।

তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, ড্যামেজ কন্ট্রোলে অভাবনীয় দক্ষতা খুব সহজেই ইন্দিরা গান্ধির কাছের মানুষের পরিণত করেছিল । ইন্দিরা জমানায় তাঁর এই প্রভাব-প্রতিপত্তিই দলের অন্দরেই চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল ।

1980 । লোকসভা নির্বাচন । রাজ্যসভার সদস্য থাকা সত্ত্বেও প্রণববাবু ঠিক করেছিলেন লোকসভা ভোটে দাঁড়াবেন । দাঁড়িয়েছিলেন ‌। ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস জয় পেলেও হারতে হয়েছিল প্রণবকে । সেই হার তাঁর মনে এক গভীর ক্ষত- বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সম্ভবত বিশ্বাস করেছেন, গনি খান চৌধুরি এবং কংগ্রেসের একাংশ চায়নি তিনি জিতুন ‌। যদিও এই পরাজয় ইন্দিরার প্রণব-স্নেহে সামান্যতম চিড় ধরাতে পারেনি । আর তাই তো লোকসভা ভোটে পরাজিত হয়েও সেদিন ইন্দিরার মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ।

কংগ্রেসে প্রণবের হাত যত সক্রিয় হয়েছে, ততই চওড়া হয়েছে প্রণব-বরকত গোষ্ঠী ফাটল । ইন্দিরার মৃত্যুর পর এই প্রণব হয়ে উঠেছিলেন রাজীব গান্ধির কাছে অন্যতম অবিশ্বাসের পাত্র । রাজীবের মন্ত্রিসভায় প্রণবের বাদ পড়া থেকে শুরু করে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার, এ-সবই বোধ হয় নিয়তির পরিহাস । ইন্দিরার মৃত্যুর পর প্রণবের হাত ধরে রাজীব প্রধানমন্ত্রিত্বের মসনদ পেয়েছিলেন । সেই প্রণবকেই ' ক্ষমতার দালাল'-দের দলে ফেলতে বিন্দুমাত্র ভাবেননি ইন্দিরা-পুত্র। যেভাবে রাজীব প্রণবকে ক্রমাগত কোণঠাসা করেছেন, ডানা ছঁটার কাজ করেছেন, তা ভারতীয় রাজনীতির এক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় । রাজীব জানাতেই প্রণববাবুকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার হতে হয়েছিল । আবার ইতিহাসের করুণ পরিহাস, কোণঠাসা রাজীব-ই মাত্র দু'বছরের মধ্যে প্রণবকে দলে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

1988-র ফেব্রুয়ারি মাস । কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন হয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের । ত্রিপুরা নির্বাচনের দায়িত্ব পান । ত্রিপুরায় ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস । এরপর থেকেই ধীরে ধীরে রাজনীতিতে উত্থান হতে শুরু করল প্রণবের । আর পিছনে ফিরতে হয়নি । ফিরে পান রাজীবের আস্থা । প্রণব সম্পর্কে রাজীবের ভুল স্বীকারোক্তি ( মৃত্যুর কয়েক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে ইন্দিরাপুত্র বলেছিলেন, প্রণব সম্পর্কে আমাকে যে সব বলা হয়েছিল তা সঠিক ছিল না) যেন আধুনিক ভারতের ‘চাণক্য’কে জন্ম দিয়েছিল ।

পরবর্তীতে সনিয়ার জমানায় সেই বিশ্বাস-আস্থা কিছুটা নড়বড়ে মনে হলেও, কখনওই প্রণবকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাননি সোনিয়া-রাহুল-মনমোহনরা । যে কোনও সমস্যায় প্রণব মুখোপাধ্যায় নিয়েছেন ড্যামেজ কন্ট্রোলের ভূমিকা । ফের এক বার প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ এলেও, মুখ বুজে নিজের ইচ্ছা চাপা দিয়েছেন । প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন মনমোহন ছিলেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর । অর্থমন্ত্রীকে স্যার বলতেন তিনি । রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই মনমোহনের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন প্রণব । প্রধানমন্ত্রী মনমোহন পূর্বের অভ্যাস বসত অর্থমন্ত্রী প্রণবকে স্যার বললে, শুনেছেন মৃদু ধমকও ।

জীবনের শেষ পর্বে রাজনৈতিক ‘সন্ন্যাস’ নিয়ে রাইসিনার বাসিন্দা হয়েছিলেন । কিন্তু, সে ক্ষেত্রেও নিজের স্বতন্ত্রকে বিসর্জন দেননি । রাইসিনা হয়ে উঠেছিল প্রণবময় । রাইসিনার বাগান-দরজা খুলেছিল সাধারণের জন্য । কোথায় যেন সেখানেও নিজস্বতা । রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর প্রতিটি বিদেশ সফর নতুন মাইল-ফলক তৈরি করেছিল । পাশের দেশে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কা সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন নিজের মতো ।

তাই বোধ হয়, আগাগোড়া কংগ্রেসি হয়েও জীবনের শেষলগ্নে এসে সংঘের সভায় উপস্থিত হতে দুইবার ভাবেননি । বিতর্ক হয়েছে । সোনিয়াদের মুখের হাসি শক্ত হয়েছে । কিন্তু, নিজ সিদ্ধান্তে অচল থেকেছেন প্রণববাবু ।

যেন অত্যন্ত সরু একটি সুতোর উপর হাঁটেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । নিজের ভাষণে তিনি নিজের রাজনৈতিক গোত্র রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন । ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য, বহুত্ব, বিবিধতা নিয়ে সারা জীবন যে সব কথা বলে এসেছিলেন, সুযোগ মতো সেগুলো ফের আওড়েছিলেন সংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে । সহিষ্ণুতাই ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি বলে মন্তব্য করেছিলেন । দেশে অসহিষ্ণুতা ও হিংসা বাড়ছে, ভারতকে সে সবের বিপরীতে যেতে হবে— এমন পরামর্শও দিয়েছিলেন । এই সব কথায় তাঁর রাজনৈতিক ঘরানা সুরক্ষিত হয়েছিল বটে, কিন্তু এ সবের পাশাপাশি এমন অনেক কথাও প্রণব মুখোপাধ্যায় সে দিন বলেছিলেন, যাতে সংঘের খুশি হওয়ার এবং কংগ্রেসের অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল ।

RSS-র প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সমালোচনায় সব সময়ই সরব থাকে কংগ্রেস । হেডগেওয়ারের নীতি-আদর্শেই RSS নির্মিত ও সিঞ্চিত । তাই সংঘকে আক্রমণ করতে গিয়ে সর্বাগ্রে হেডগেওয়ারকেই আক্রমণ করে কংগ্রেস । সেই হেডগেওয়ারের বাসভবনে প্রণব মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন, শ্রদ্ধার্পণ করেছিলেন, ভিজ়িটরস বুকে হেডগেওয়ারকে ‘ভারতমাতার মহান সন্তান’ বলে ব্যাখ্যাও করেছিলেন ।

কিন্তু কেন ? এর অর্থ কী ? স্পষ্ট করেনি কিছুই । ঠিক যেমন ভাবে অজানাই থেকে গিয়েছে অরুণ নেহরু বা বরকত সম্পর্কে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন । কেন বরকত অরুণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কী মনে করতেন প্রণব, যা কোনও দিনই প্রকাশ্যে আনেননি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি । এ সব কথা নিজের বইতেও লেখেননি । তবে, তিনি যে লাল ডায়েরিতে রোজনামচা লিখে রাখতেন, তাতে হয়ত সে সবই ছিল । কিন্তু, প্রণববাবুর ইচ্ছাতেই সেই লাল ডায়েরি কোনওদিনই প্রকাশিত হবে না । প্রণববাবুই নির্দেশ ছিল তাঁর সঙ্গেই যেন পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায় সেই ডায়েরি ।

সত্যি !

অনেক কিছু অজানা থেকেই পরিসমাপ্তি ঘটে গেল অধ্যায়ের ।

ইন্দিরা গান্ধি যদি হন ভারতীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের সব থেকে মোহময়ী নায়িকা । মনমোহন সিং যদি হন ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম সেরা নায়ক । পি ভি নরসিমা রাও যদি ভারতীয় রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের অন্যতম চর্চিত চরিত্র হয়ে থাকেন, তাহলে এই সব চিত্রনাট্যের প্রযোজক কিন্তু একজনই ।

আর প্রযোজকের ভূমিকা সামান্যতম টালমাটাল হলে কোনও চলচ্চিত্রই সার্থক রূপ পায় না ।

সেই প্রযোজকের আজ অবসান হল । ভারতীয় রাজনীতি হারাল তার বর্তমান চাণক্যকে । প্রয়াত হলেন দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় । পরিসমাপ্তি ঘটল এক অভিনব কংগ্রেসি যুগের ।

তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নম্বর-টু ছিলেন । তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের নম্বর-টু ছিলেন । আবার সেই মানুষটিই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়েরও নম্বর-টু হয়েছিলেন । তাই হয়ত, অনেকে বলতেন ভারতীয় রাজনীতির তিনি হলেন পারপিচুয়াল নম্বর টু ।

বাংলার এক অখ্যাত গ্রাম থেকে দেশের প্রথম নাগরিক । বরবারই তিনি ছিলেন আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে । প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও ভারতীয় সংবিধানে প্রধান নাগরিক, দেশের সাংবিধানিক প্রধান হওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন । কী ভাবে তিনি সে কাজে সফল হলেন, বিপুল ভোটে জিতলেন সে ইতিহাস নতুন করে আলোচনা করার সময় এটা নয় । কিন্তু তিনি ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ হওয়ার পর কী ভাবে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠলেন সেটাই হয়ত আজকের দিনে প্রধান বিচার্য । প্রণববাবুর জীবন তাই এক কথায় ‘নম্বর টু’ থেকে ‘নম্বর ওয়ান’ হয়ে ওঠার কাহিনি । ভারতের সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীই প্রকৃত নম্বর ওয়ান । রাষ্ট্রপতি হলেন ‘সেরিমোনিয়াল হেড’। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পাঁচ বছরে সেই জাঁকজমক সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় থেকেও প্রণববাবু প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এ দেশেও ব্রিটেনের রানির মতো রাষ্ট্রপতির পদেরও ক্ষমতার এক নিজস্ব রাজনৈতিক পরিসর আছে । নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনও সংঘাতে না গিয়েও প্রণববাবু দেখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে এই পরিসরটুকুতে এত সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সক্রিয় থাকা যায় । রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনও মতপার্থক্য হয়নি তা কিন্তু নয় । কিন্তু সে কথা কখনওই বাইরে প্রকাশিত হয়নি ।

আসলে প্রকাশ্যে দাপাদাপি না করে নীরবে নিভৃতে কাজ করার মানসিকতাটা চিরকালই ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের । আর এই মানসিকতাই হয়ত তাঁকে নেহরু-গান্ধির কংগ্রেসে একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি এনে দিয়েছিল । সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও নিজের সেই পরিচিতিকে তিনি কখনই হারতে দেননি ।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাই তিনি নিজের সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও এক নিরপেক্ষ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন । মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদী দর্শনে বলে, বস্তু থেকেই ভাবনা উৎসারিত, কিন্তু সেই ভাবনা বা নিজস্বতার কিছু নিজস্ব পরিসর তৈরি হয় । সেই পরিসরটি হল, সৃজনশীল পরিসর । সামগ্রিক ভাবে ‘আইডিয়া’ বস্তু থেকেই সম্পূর্ণ উৎসারিত । অতএব, তার কোনও নিজস্ব পরিসর নেই, এ কথা যাঁরা বলেন তাঁরাই ‘ডিটারমিনিজ়িম’ বা নির্দেশ্যবাদের দ্বারা আক্রান্ত । প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি পদের সাংবিধানিক পরিসরটুকুও এ রকমই ছিল ।

প্রণববাবুর রাজনৈতিক চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সারা জীবন ধরে এক জন সফল ‘ব্যাকরুম বয়’। বলা যায়, সারা জীবন তিনি ‘ব্যাক সিট ড্রাইভিং’ করেছেন । বলা যেতে পারে, তিনি যেন নাট্যমঞ্চের ‘গ্রিনরুম ম্যান’, নাটক বা ফিল্মের প্রযোজকের ভূমিকায় । তিনি নায়ক নন । কিন্তু অন্যতম ‘প্রোডিউসার অফ দা শো’। আর এই কমিটিতে সফল হওয়ার জন্য তাঁর চরিত্রে প্রধান গুণ ছিল, তিনি চিরকাল সকলকে ‘অন বোর্ড’ নিয়ে চলতে চেয়েছেন । তা সে লালুপ্রসাদ যাদবই হোন বা লালকৃষ্ণ আদবানি । তিনি ‘প্লুরালিস্ট’, তিনি ‘ম্যান অফ গ্রেট কনসেন্সাস’। ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বসম্মতিতে তৈরি রাজনীতির তিনি অন্যতম জনক । এই একটা বৈশিষ্ট্যের জন্য পরমাণু চুক্তির সময় মনমোহন সিংহের আমলেও প্রকাশ কারাত ও সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে আলোচনায় বিবাদ মেটানোর দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনিই । আক্রমণাত্মক BJP-কে ঠান্ডা করার জন্য কংগ্রেস জমানায় প্রণববাবুকেই মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিতেন সনিয়া গান্ধি । আবার কূটনৈতিক সমস্যায় বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন ভরসার পাত্র ।

বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে ভারতের সবচেয়ে পুরানো রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠা । সেখান থেকে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান । কাহিনি বিস্ময়ের ‌। ছিল না কোনও পারিবারিক প্রভাব । সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় ক্ষমতার অলিন্দে কান্ডারি হয়ে উঠেছিলেন । বিধানচন্দ্র রায়ের পর দ্বিতীয় বাঙালি প্রশাসক ভারতরত্ন পেয়েছেন ।

তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, ড্যামেজ কন্ট্রোলে অভাবনীয় দক্ষতা খুব সহজেই ইন্দিরা গান্ধির কাছের মানুষের পরিণত করেছিল । ইন্দিরা জমানায় তাঁর এই প্রভাব-প্রতিপত্তিই দলের অন্দরেই চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল ।

1980 । লোকসভা নির্বাচন । রাজ্যসভার সদস্য থাকা সত্ত্বেও প্রণববাবু ঠিক করেছিলেন লোকসভা ভোটে দাঁড়াবেন । দাঁড়িয়েছিলেন ‌। ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস জয় পেলেও হারতে হয়েছিল প্রণবকে । সেই হার তাঁর মনে এক গভীর ক্ষত- বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সম্ভবত বিশ্বাস করেছেন, গনি খান চৌধুরি এবং কংগ্রেসের একাংশ চায়নি তিনি জিতুন ‌। যদিও এই পরাজয় ইন্দিরার প্রণব-স্নেহে সামান্যতম চিড় ধরাতে পারেনি । আর তাই তো লোকসভা ভোটে পরাজিত হয়েও সেদিন ইন্দিরার মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ।

কংগ্রেসে প্রণবের হাত যত সক্রিয় হয়েছে, ততই চওড়া হয়েছে প্রণব-বরকত গোষ্ঠী ফাটল । ইন্দিরার মৃত্যুর পর এই প্রণব হয়ে উঠেছিলেন রাজীব গান্ধির কাছে অন্যতম অবিশ্বাসের পাত্র । রাজীবের মন্ত্রিসভায় প্রণবের বাদ পড়া থেকে শুরু করে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার, এ-সবই বোধ হয় নিয়তির পরিহাস । ইন্দিরার মৃত্যুর পর প্রণবের হাত ধরে রাজীব প্রধানমন্ত্রিত্বের মসনদ পেয়েছিলেন । সেই প্রণবকেই ' ক্ষমতার দালাল'-দের দলে ফেলতে বিন্দুমাত্র ভাবেননি ইন্দিরা-পুত্র। যেভাবে রাজীব প্রণবকে ক্রমাগত কোণঠাসা করেছেন, ডানা ছঁটার কাজ করেছেন, তা ভারতীয় রাজনীতির এক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায় । রাজীব জানাতেই প্রণববাবুকে ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার হতে হয়েছিল । আবার ইতিহাসের করুণ পরিহাস, কোণঠাসা রাজীব-ই মাত্র দু'বছরের মধ্যে প্রণবকে দলে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

1988-র ফেব্রুয়ারি মাস । কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন হয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের । ত্রিপুরা নির্বাচনের দায়িত্ব পান । ত্রিপুরায় ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস । এরপর থেকেই ধীরে ধীরে রাজনীতিতে উত্থান হতে শুরু করল প্রণবের । আর পিছনে ফিরতে হয়নি । ফিরে পান রাজীবের আস্থা । প্রণব সম্পর্কে রাজীবের ভুল স্বীকারোক্তি ( মৃত্যুর কয়েক দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে ইন্দিরাপুত্র বলেছিলেন, প্রণব সম্পর্কে আমাকে যে সব বলা হয়েছিল তা সঠিক ছিল না) যেন আধুনিক ভারতের ‘চাণক্য’কে জন্ম দিয়েছিল ।

পরবর্তীতে সনিয়ার জমানায় সেই বিশ্বাস-আস্থা কিছুটা নড়বড়ে মনে হলেও, কখনওই প্রণবকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাননি সোনিয়া-রাহুল-মনমোহনরা । যে কোনও সমস্যায় প্রণব মুখোপাধ্যায় নিয়েছেন ড্যামেজ কন্ট্রোলের ভূমিকা । ফের এক বার প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ এলেও, মুখ বুজে নিজের ইচ্ছা চাপা দিয়েছেন । প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন মনমোহন ছিলেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর । অর্থমন্ত্রীকে স্যার বলতেন তিনি । রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই মনমোহনের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন প্রণব । প্রধানমন্ত্রী মনমোহন পূর্বের অভ্যাস বসত অর্থমন্ত্রী প্রণবকে স্যার বললে, শুনেছেন মৃদু ধমকও ।

জীবনের শেষ পর্বে রাজনৈতিক ‘সন্ন্যাস’ নিয়ে রাইসিনার বাসিন্দা হয়েছিলেন । কিন্তু, সে ক্ষেত্রেও নিজের স্বতন্ত্রকে বিসর্জন দেননি । রাইসিনা হয়ে উঠেছিল প্রণবময় । রাইসিনার বাগান-দরজা খুলেছিল সাধারণের জন্য । কোথায় যেন সেখানেও নিজস্বতা । রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর প্রতিটি বিদেশ সফর নতুন মাইল-ফলক তৈরি করেছিল । পাশের দেশে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কা সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন নিজের মতো ।

তাই বোধ হয়, আগাগোড়া কংগ্রেসি হয়েও জীবনের শেষলগ্নে এসে সংঘের সভায় উপস্থিত হতে দুইবার ভাবেননি । বিতর্ক হয়েছে । সোনিয়াদের মুখের হাসি শক্ত হয়েছে । কিন্তু, নিজ সিদ্ধান্তে অচল থেকেছেন প্রণববাবু ।

যেন অত্যন্ত সরু একটি সুতোর উপর হাঁটেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । নিজের ভাষণে তিনি নিজের রাজনৈতিক গোত্র রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন । ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্য, বহুত্ব, বিবিধতা নিয়ে সারা জীবন যে সব কথা বলে এসেছিলেন, সুযোগ মতো সেগুলো ফের আওড়েছিলেন সংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে । সহিষ্ণুতাই ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি বলে মন্তব্য করেছিলেন । দেশে অসহিষ্ণুতা ও হিংসা বাড়ছে, ভারতকে সে সবের বিপরীতে যেতে হবে— এমন পরামর্শও দিয়েছিলেন । এই সব কথায় তাঁর রাজনৈতিক ঘরানা সুরক্ষিত হয়েছিল বটে, কিন্তু এ সবের পাশাপাশি এমন অনেক কথাও প্রণব মুখোপাধ্যায় সে দিন বলেছিলেন, যাতে সংঘের খুশি হওয়ার এবং কংগ্রেসের অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল ।

RSS-র প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের সমালোচনায় সব সময়ই সরব থাকে কংগ্রেস । হেডগেওয়ারের নীতি-আদর্শেই RSS নির্মিত ও সিঞ্চিত । তাই সংঘকে আক্রমণ করতে গিয়ে সর্বাগ্রে হেডগেওয়ারকেই আক্রমণ করে কংগ্রেস । সেই হেডগেওয়ারের বাসভবনে প্রণব মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন, শ্রদ্ধার্পণ করেছিলেন, ভিজ়িটরস বুকে হেডগেওয়ারকে ‘ভারতমাতার মহান সন্তান’ বলে ব্যাখ্যাও করেছিলেন ।

কিন্তু কেন ? এর অর্থ কী ? স্পষ্ট করেনি কিছুই । ঠিক যেমন ভাবে অজানাই থেকে গিয়েছে অরুণ নেহরু বা বরকত সম্পর্কে তাঁর সঠিক মূল্যায়ন । কেন বরকত অরুণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কী মনে করতেন প্রণব, যা কোনও দিনই প্রকাশ্যে আনেননি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি । এ সব কথা নিজের বইতেও লেখেননি । তবে, তিনি যে লাল ডায়েরিতে রোজনামচা লিখে রাখতেন, তাতে হয়ত সে সবই ছিল । কিন্তু, প্রণববাবুর ইচ্ছাতেই সেই লাল ডায়েরি কোনওদিনই প্রকাশিত হবে না । প্রণববাবুই নির্দেশ ছিল তাঁর সঙ্গেই যেন পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায় সেই ডায়েরি ।

সত্যি !

অনেক কিছু অজানা থেকেই পরিসমাপ্তি ঘটে গেল অধ্যায়ের ।

Last Updated : Aug 31, 2020, 6:50 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.