কোরোনার জেরে বিশ্বজুড়ে শিক্ষাব্যবস্থায় বদল এসেছে । চলতি শিক্ষাবর্ষ নিয়ে স্থায়ী কোনও পরিকল্পনা তৈরি করতে দেশগুলি কার্যত হিমশিম খাচ্ছে । ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে ৷ ভিয়েতনাম ও হংকংয়ে স্কুলগুলি স্বল্প সময়ের জন্য খোলা হয়েছে । সংক্রমণের সংখ্যা যত বাড়ছে, ততই বিশেষজ্ঞদের মনে এই ধারণা দৃঢ় হচ্ছে যে ভারতে স্কুল এবং কলেজগুলিতে এখনই ক্লাসরুমে পঠনপাঠন শুরু করা যাবে না । কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরের স্কুলগুলি গত বছরের পাঠ্যসূচি অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শেষ করেছে । স্কুল এবং জুনিয়র কলেজগুলিতে পড়ুয়াদের কোনও পরীক্ষা ছাড়াই নতুন ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়েছে । তবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া বাকি । যদিও কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের তরফে স্কুল ও কলেজ পুনরায় চালু করার কথা চিন্তা করেছে, তবু বার বার দিনক্ষণ পিছিয়ে যাচ্ছে । পড়াশোনা যাতে নিরাপদ এবং যথাযথ হয়, তার জন্য বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল এবং ক্লাসরুম সেশন- দুইয়েরই সুপারিশ করেছেন ।
অনলাইন পড়াশোনা সাবেকি প্রথায় পড়াশোনার থেকে বেশ আলাদা । তাই বাকি থাকা পাঠ্যসূচি অনুসরণ করলেই এই সময়ের চাহিদা মিটবে না । পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষাদানের পরিকল্পনায় বদল আনা বাধ্যতামূলক । সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে, CBSE-র পাঠ্যসূচি প্রয়োজনানুসারে বদল করা হবে । এর আগে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী রমেশ পোখরিওয়াল বলেছিলেন যে, আগামী শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্র সিলেবাস এবং পঠনপাঠনের সময় কমিয়ে আনবে । এমন কী, কর্নাটক সরকার তো স্কুলগুলির জন্য সিলেবাস কমানোর চিন্তাভাবনাও শুরু করে দিয়েছে । কিন্তু সিলেবাস সংস্কার করার কিছু অসুবিধাও রয়েছে । বিশেষ করে গণিত এবং সাধারণ বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিতে পারে । কারণ এর প্রতিটি অধ্যায় একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত । কাজেই কোনওটি বাদ পড়লে পড়ুয়াদের বুঝতে সমস্যা হতে পারে । শিক্ষাবিদদের তাই এমন কোনও পাঠ্যসূচি তৈরি করা উচিত, যা একাধারে স্থানীয় স্তরে চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হয় আবার আন্তর্জাতিক গুণমানের সঙ্গেও সাযুজ্য বজায় রাখতে পারে ।
অনলাইন পড়াশোনার ক্ষেত্রটি এখনও নবজাতক স্তরে রয়েছে । শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শারীরিক উপস্থিতি, পথ দেখিয়ে দেওয়া এবং উৎসাহদান পড়ুয়াদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে । অনলাইন ক্লাসে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যবর্তী ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভাব বোধ হয় । নির্দেশপ্রদানকারী তথা ইনস্ট্রাকটারদের নজরদারি ছাড়া, পড়ুয়ারা বিষয় সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর নিজেরা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না । পাশাপাশি শিক্ষকদেরও অসুবিধা হয় ডিজিটাল ক্লাসের সময়, একসঙ্গে সব পড়ুয়াদের দিকে খেয়াল দিতে, সকলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে । এই সব সমস্যার দিকে তাকিয়ে বিশেষজ্ঞদের উচিত, অবিলম্বে ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মানোন্নয়ন করা । পড়ুয়াদের এমন কাজকর্মে ব্যস্ত রাখা যাতে তাদের সৃষ্টিশীলতা এবং সম্পদশীলতার বিকাশ ঘটে । আর এই কাজকর্মের দিকে নজর রাখাও প্রয়োজন । ডিজিটাল পড়াশোনার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং পড়ুয়ার উন্মুখতা এবং পরিবেশের নমনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলে অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করা হয়, তবুও এক্ষেত্রে একাধিক সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করা হয় ।
শহরাঞ্চলগুলিতে পড়ুয়াদের ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয় না, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে পড়ুয়ারা অনলাইনে পড়াশোনার মৌলিক প্রয়োজন যেমন বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেটও ঠিকভাবে পায় না । তাই সরকারের উচিত অনলাইন পড়াশোনার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এবং ট্যাবলেটের জোগান সহজলভ্য করা । শারীরিক দিক থেকে বিশেষভাবে সক্ষম পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে সমস্যা আবার অন্যরকম । বেশিরভাগ সময় তারা স্টাডি মেটিরিয়ালই পায় না । বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার কথা মাথায় রাখতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, সব ক্ষেত্রে যেন সব পড়ুয়া সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে । শিক্ষামন্ত্রককে টিভি এবং রেডিয়োর মাধ্যমে সম্প্রচারকেও শিক্ষার সরঞ্জাম হিসাবে বিবেচনা করতে হবে । যদিও এই মিডিয়ায় ভাবনা আদানপ্রদানের জায়গা নেই, তবু এর মাধ্যমে লাখ লাখ পড়ুয়ারা পঠনপাঠন করতে পারে । এ বছর নির্ঝঞ্ঝাটে অনলাইনে পড়াশোনা করার জন্য সরকার, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবকদের একে অনে্যর সহযোগিতা করা উচিত এবং নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত ।