ETV Bharat / bharat

চিনা পণ্যের রাতারাতি বর্জনে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' ধাক্কা খেতে পারে : সুঞ্জয় জোশী - ORF চেয়ারম্যান সঞ্জয় জোশী

মেড ইন চায়নাকে রাতারাতি বর্জন করলে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ধাক্কা খেতে পারে ৷ এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী নীতির ৷ বর্ষীয়ান সাংবাদিক স্মিতা শর্মার সঙ্গে কথোপকথনে জানালেন অবজ়ার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুঞ্জয় জোশী ৷

চিনা পণ্যের রাতারাতি বর্জনে "মেক ইন ইন্ডিয়া" ধাক্কা খেতে পারে
চিনা পণ্যের রাতারাতি বর্জনে "মেক ইন ইন্ডিয়া" ধাক্কা খেতে পারে
author img

By

Published : Jul 2, 2020, 11:32 AM IST

Updated : Jul 2, 2020, 11:57 AM IST

59টি চিনা মোবাইল অ্যাপকে নিষিদ্ধ করা প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ৷ কিন্তু এতে আখেরে কী পাওয়া যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । চিনকে জবাব দিতে ভারতকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত দূরদৃষ্টি গড়ে তুলতে হবে ৷ মনে করেন ORF (অবজ়ার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন)-এর চেয়ারম্যান সুঞ্জয় জোশী । সাংবাদিক স্মিতা শর্মার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, রাতারাতি কোনও সরবরাহ ব্যবস্থাকে ছিন্ন করা অসম্ভব ৷ এভাবে 'মেড ইন চায়না'কে আটকানোর চেষ্টা হলে তাতে 'মেড ইন ইন্ডিয়া'র উদ্যোগেও ঝাঁকুনি লাগতে পারে । তিনি আরও বলেন যে সরকারকে একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে ৷ যাতে এখানে উৎপাদনের খরচ কমে ৷ শিল্প ও সরকারকে একে অপরকে বিশ্বাস করতে হবে । তাঁর কথায়, চিনের পরিবর্তে আমদানির জন্য তাইওয়ান বা ভিয়েতনামের উপর নির্ভর করলেও কোনও গ্যারান্টি নেই যে চিনের প্রভাব চলে যাবে । বিশিষ্ট কৌশল বিশেষজ্ঞ এও বলেন, মহামারির মধ্যে যখন জীবন ও জীবিকার বড় মূল্য দিতে হচ্ছে তখন ভারতের উচিত চিনের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করা ৷ নয়তো ভারত নিজের অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে । সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হল:-

প্রশ্ন: ভারত সরকার যে 59টি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে ৷ এটা কী নিছক প্রতীকী নাকি এতে সত্যিই চিনের আঘাত লাগবে ?

সুঞ্জয়: এর একটা অংশ চিনকে বার্তা দেওয়ার জন্য ৷ কিন্তু এতে কতটা লাভ হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । এটা অনেকটাই প্রতীকী । কিন্তু এই সংঘাতের সময় এই সংকেত এবং প্রতীকেরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে । যদি আপনি সাপ্লাই চেন বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলতে শুরু করেন, আগামীকাল থেকেই চিনের ওপর নির্ভরতা বন্ধ করতে বলেন, সেটা সম্ভব নয় । আমার মনে হয় না কেউ সেই চেষ্টা করবেন ৷ এমনকী এই ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন । আমাদের প্রতীকগুলো সরিয়ে বাস্তবের ভিত্তিতে ভাবতে হবে । যদি আপনি এক প্রতিবেশীর সঙ্গে কৌশলগত যুদ্ধ বা কৌশলগত সমঝোতায় ব্যস্ত থাকেন তাহলে এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প ৷ যেখানে পরিকল্পনা এবং ভাবনার প্রয়োজন । রোম একদিনে তৈরি হয়নি । কোনও সাপ্লাই চেনও একদিনে তৈরি হয়নি । বাইদু হোক বা Paytm, চিনা বিনিয়োগ বহু বছর ধরে ভারতে ঢুকেছে । চিন আপনার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে ঢুকে রয়েছে । তাই তাকে বাদ দেওয়া রাতারাতি সম্ভব নয় । শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্বই এর সঙ্গে যুঝে চলেছে । আমাদের প্রতীক, সারবত্তা এবং সংকেতকে তিনটি আলাদা বিষয় হিসেবে ভাবতে হবে ৷ এবং সারবত্তার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ আমরা নিই সুদূর ভবিষ্যতে সেটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াবে ।

প্রশ্ন: 2019 সালে টিকটকের বিশ্বজুড়ে আয় ছিল 17 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ৷ যেখানে প্রচুর সংখ্যায় ডাউনলোড সত্ত্বেও ভারতের অংশ ছিল মাত্র 0.03 শতাংশ । এতে কি আদৌ চিনের ধাক্কা লাগবে ? নাকি মহামারী যখন আমাদের জীবিকায় ছায়া ফেলেছে তখন এইসব সংস্থার কর্মীদের উপরেই আঘাত আসবে ?

সুঞ্জয়: অ্যাপের জগতে বিকল্প পাওয়ার সম্ভাবনা আছে । ভারত খুব একটা পিছিয়ে নেই । ভারতীয়রাই বিশ্বজুড়ে সবথেকে বেশি অ্যাপ ডেভেলপ করে এবং তারাই অ্যাপ সবথেকে বেশি ডাউনলোড করে । আমার উদ্বেগের জায়গাটা হল, সাপ্লাই চেন ছিন্ন করার কথা বলে গুরুতর সমস্যার দিকে এগিয়ে যাই আমরা । আজ ওষুধ তৈরির 70 শতাংশ আর্কাইভ উপকরণ আসে চিন থেকে । কেন সেগুলো চিন থেকে আসে এই প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের বহু বছর আগেই করা উচিত ছিল । আজ আপনি সেই সরবরাহ ব্যবস্থা হঠাৎ বন্ধ করে দিতে পারেন না । একইভাবে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইলের ক্ষেত্রেও আজ আপনি যদি চিনা সাপ্লাই চেন কেটে দেন তাহলে 'মেড ইন চায়না'কে বিচ্ছিন্ন করার আদতে প্রভাব ফেলবে 'মেড ইন ইন্ডিয়া'-র উপরেও । আপনার মেড ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচি থমকে যাবে । এই মহামারির সময় যখন আপনি কর্মসংস্থান নিয়ে সমস্যায় ৷ যখন আপনি অর্থনীতিকে ফের চালু করতে চাইছেন তখন চিনের থেকে নিজের ক্ষতি বেশি করছেন । সুতরাং আমাদের এগুলো ভাবতে হবে । আমাদের চিনের মোকাবিলা করতে হবে কৌশলগতভাবে ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে । প্রতীক এবং সংকেতের একটা অংশ প্রতিবাদের জন্য, TRP-র জন্য ভালো । কিন্তু পরিকল্পনা ছাড়া বাস্তবে এটা করা যেতে পারে না ।

প্রশ্ন: নিরাপত্তা উদ্বেগই কি এর মূল কারণ ? চিনা অ্যাপগুলো থেকে তথ্য ফাঁসের ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট অ্যামেরিকান ইনপুট আছে কিনা, লোকসভায় এবছর মার্চে এই নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছিল ৷ জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি না বলেছিলেন ৷ এবং এই অ্যাপ নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই বলেও জানিয়েছিলেন । তার 100 দিনের মধ্যেই বলা হচ্ছে যে নিরাপত্তা উদ্বেগই নাকি এইসব অ্যাপ বন্ধ করার কারণ ।

সুঞ্জয়: চিনা হোক বা অ্যামেরিকান, নিরাপত্তার বিষয়টি অ্যাপ এবং হার্ডওয়্যার উভয়ের সঙ্গেই জড়িত । এর সবথেকে ভাল সমাধান হল যে আপনি ভারতেই সবকিছু তৈরি করুন । তাহলে আপনার নিজস্ব সিস্টেম থাকবে ৷ একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে । কিন্তু যতক্ষণ না সেটা করছেন ততক্ষণ আপনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন । এর একটা সমাধান হল টেস্টিং । ইজ়রায়েল বা রাশিয়া ও অন্য দেশগুলির মতো যদি আপনার টেস্টিংয়ের ক্ষমতা না থাকে তাহলে নিরাপত্তার দিকটিরও সমাধান আছে । যদি আপনি মনে করেন যে পিছনে এমন কোনও দেওয়াল তৈরি হয়েছে যা আপনার তথ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, তারও সমাধান আছে । যতক্ষণ না আপনি আত্মনির্ভর হচ্ছেন বা সম্পূর্ণভাবে স্বনির্ভর হচ্ছেন ততক্ষণ কোনও ফারাক হবে না । সিসকো একই জিনিস করছে ৷ অ্যামেরিকার কোম্পানিগুলোও একই জিনিস করছে । উইকিলিকস হল অ্যামেরিকার পিছনে দরজা বা পথ খোলা রাখা এমনকী ইউরোপে নিজের সহযোগীদের ওপরেও গুপ্তচরবৃত্তি করা । আমাদের চিনের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তবধর্মী হতে হবে । চিনকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করতে গেলে আমাদের আজকে কয়েকটা নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে । আপনাকে আপনার শিল্পজগতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে ৷ যেটা এক সপ্তাহ বা এক মাসে সম্ভব নয় । আপনাকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে ৷ যাতে ভারতে বিনিয়োগ এবং কাজ করা আরও সস্তা হয় । অন্যথায় আপনি ভারতে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে যাবেন এবং বিশ্বে অন্য সবার থেকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন ।

চিনা পণ্যের রাতারাতি বর্জনে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' ধাক্কা খেতে পারে : সুঞ্জয় জোশী

প্রশ্ন: ভারতে চিনের মোট বিনিয়োগ তিন বছরে পাঁচগুণ বেড়ে 2014-য় 1.6 বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে 2017-য় 8 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায় । তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশ অধিগ্রহণ এবং অংশীদারির মাধ্যমে বেসরকারিভাবে চিনা বিনিয়োগ আসলে পরিসংখ্যানের অন্তত 25 গুণ বেশি । ভারতে কত চিনা বিনিয়োগ আছে ও তার যথাযথ মূল্যায়ন কি হয়েছে ?

সুঞ্জয়: বিশেষ করে কোরোনা পরিস্থিতির পর এই প্রশ্নগুলো গোটা বিশ্বকে করা হচ্ছে । ভারত এবং গোটা বিশ্ব উপলব্ধি করছে যে কোনও একটি ভৌগলিক অবস্থান এবং বিশেষ করে চিনের ওপর ভরসার নিশ্চয়তা নেই । গোটা বিশ্ব এইসময় সাপ্লাই চেন সরানোর খেলায় মেতেছে । বুদ্ধিমানরা জানেন যে এই চেন তৈরি করতে নূন্যতম 3 বছর থেকে 7, এমনকী দশ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে ৷ বহু সংস্থা আছে সেখানে মানুষ বিনিয়োগ করেছেন ৷ বিরাট আর্থিক সংস্থাগুলো জড়িয়ে আছে । ভারতের সামনে বিকল্প সীমিত এবং সেইজন্যই আজ আমাদের পরিকল্পনা করা উচিত ।

প্রশ্ন: আরও 26 বিলিয়ন ডলার চিনা বিনিয়োগের পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে । তাহলে আপনি যখন চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে শুরু করছেন সেক্ষেত্রে বিকল্পগুলো কী কী ?

সুঞ্জয়: আমাদের ভারতকে পুঁজি এবং বিনিয়োগের একটি প্রতিযোগিতামূলক গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে ৷ একে আরও সহজ করতে হবে । উদাহরণস্বরূপ ভারতে উৎপাদন খরচ কমানো যা এখন অত্যন্ত বেশি । চিন বা পাকিস্তান কিছু করেছে বলে এটা বেশি নয় ৷ বরং এটা কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য যা অতীত থেকে আমরা নিয়ে এসেছি । জ্বালানির দাম কমান । বর্তমানে সবকিছুরই একটা সহজ সমাধান আছে । যখনই কোনও আর্থিক সংকট আসে, তখনই ট্যাক্স বেড়ে যায় ৷ জ্বালানির ক্ষেত্রেও এটা হচ্ছে । ভারত আজ পেট্রল আর ডিজ়েলের দাম নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে । বিপদের সময়ে যা আসলে দাম কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারত । যখন আপনি উৎপাদন, নির্মাণ, লজিস্টিক্স, ভারতের মধ্যে পুরো সাপ্লাই চেন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তখন আমাদের কঠিন দৃষ্টিতে দেখতে হয় যে শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক না করার ফল কী হয়েছে । একমাত্র তখনই আমরা চিন-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারি । আমরা শুধু যখন-তখন কিছু অ্যাপ নিষিদ্ধ করে চিনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারব না ।

প্রশ্ন: সরকারের নীতিকে কে পিছনে টেনে রাখছে ? তারা কীভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে এ সম্পর্কে শিল্পমহলের প্রতিক্রিয়া কী ?

সুঞ্জয়: শিল্প মূলত এমন একটা পরিবেশ চায় যেখানে তারা সস্তায় উৎপাদন করতে পারে । শিল্পশ্রম আইনকে নস্যাৎ করতে বলছে না ৷ বরং তাকে আরও যুক্তিপূর্ণ করতে বলছে । কোনও ভালো শিল্প একথা বলবে না যে তাদের শ্রমিকদের বঞ্চনা করতে দেওয়া হোক । তারা ভালো এবং সার্বিক শ্রম আইন চায় ৷ যা শিল্পকে রক্ষা করবে । ভারতে অন্তত 51টা কেন্দ্রীয় আইন আছে যা শ্রমিকদের দেখাশোনা করার জন্য । কিন্তু যখনই মন্দা আসে তখনই পরিযায়ী সংকট দেখা যায় আপনি লাখ লাখ শ্রমিককে দেখতে পান যাঁদের কোনও নিরাপত্তা নেই । এটা একটা সরকারি ব্যর্থতা যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং যার সংশোধন হওয়া দরকার ।

আমরা যথেষ্ট মনোযোগ নিয়ে এটা দেখছি না যে নয়াদিল্লির ক্ষমতার অলিন্দ ছাড়া শিল্প এবং সরকারের মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে কি না । অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন শ্রমিক পরিদর্শক বা GST/শুল্ক ইন্সপেক্টরের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে । জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে শিল্পকে একগুচ্ছ সমস্যার মুখে পড়তে হয় । এগুলোর মেটানো কঠিন পরিশ্রমের কাজ যা অকুস্থলে গিয়ে করতে হয় । শুধু আইন দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ।

প্রশ্ন: বন্দর এবং কাস্টমসের কাছে আমদানি সংক্রান্ত যা বিবরণ আছে, তা জানিয়ে দিতে বলেছে সরকার । টেলিকম, ইলেকট্রনিকস, তথ্যপ্রযুক্তি চিনা আমদানির ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল । ফার্মা ক্ষেত্রের আমদানির জন্য কোভিড সংকটের সময় ওষুধের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে । এই পদক্ষেপকে কি সুচিন্তিত বলে মনে হচ্ছে ?

সুঞ্জয়: এর মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে । এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং এইসব প্রাচীরগুলো তোলার মধ্যে দিয়ে আপনি ব্যবসার সহজসাধ্যতাকে কমিয়ে দিচ্ছেন । যতদূর ভারতীয় উৎপাদনকে চিনা উৎপাদনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের প্রশ্ন, আপনি হয়তো আসলে কয়েক পা এগোনের বদলে কয়েক পা পিছিয়ে গেছেন । এখন আরও বিশদ বিশ্লেষণ এবং আপনার নিজের শিল্পকে বিশ্বাস করার সময় । আমার মনে হয় না আজকাল আমরা আমাদের শিল্পে ভরসা রাখি । আজ আমরা ভাবি যে আমাদের শিল্পে সবাই খারাপ এবং মুনাফা লোটার পক্ষপাতী । হ্যাঁ, তারা মুনাফা করতেই নেমেছে । কিন্তু সেখানে পারস্পরিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে ৷ মুনাফা কোনও খারাপ শব্দ নয় । মুনাফা অর্থনীতির পক্ষে এবং যাঁরা ব্যবসা করেন তাঁদের পক্ষে ভালো । আসুন আমরা শিল্পপতিদের শ্রদ্ধা করি ৷ কারণ তাঁরা কর্মসংস্থান তৈরি করছেন এবং প্রতিযোগিতামূলক পণ্য উৎপাদন করছেন । ওই চিন্তাভাবনা এবং ইন্টারফেস বদলানো প্রয়োজন । প্রতিটি কৃষকই একজন শিল্পপতি । তাদের সম্মান দিন । আমরা তাদের ওপর নির্ভর করি । এর ওপরেই কৃষি, উৎপাদন থেকে পরিষেবার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে । যদি আমরা আমাদের লোকেদের বিশ্বাস করি তাহলে পুরো অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে । এটা দুপক্ষেরই ব্যাপার । মানুষ সরকারকে বিশ্বাস করে না । তারা মনে করে না যে সরকারের নীতিগুলো স্থায়ী হবে । দুপক্ষের মধ্যেই এই বিশ্বাসটা গড়ে তুলতে হবে ।

প্রশ্ন: ভারতের কি তাইওয়ানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বাড়ানো উচিত ? মেক ইন ইন্ডিয়া পুরোদমে চালু হওয়ার আগে চিনা আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কি আর কোনও বিকল্প রয়েছে ?

সুঞ্জয়: এটা এর মধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে । কিন্তু অনেকগুলোরই উৎস সম্পর্কে কখনওই জানা যায় না । তাই আপনি তাইওয়ান বা ভিয়েতনাম বা অন্য কোনও জায়গা থেকে আমদানি করতে পারেন ৷ কিন্তু তাতে চিনের ইমপ্রিন্ট কতটা বড়, কতটা লাভ আসলে চিনে যাচ্ছে, সেটা গণনা করা অত্যন্ত কঠিন । বৈচিত্র একটা কৌশল হতে পারে কিন্তু তার নিজস্ব ঝুঁকি আছে । তাই দেশের মধ্যে কী করা যায় সেটা দেখতে হবে এবং ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বিকল্প সাপ্লাই চেন গড়ে তুলতে হবে । যখন বিপুল পরিমাণে নির্মাণ চিন থেকে সরে যাবে ৷ উৎপাদন এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবে ৷ মেড ইন ইন্ডিয়া তখন মেড ইন তাইওয়ান বা মেড ইন ভিয়েতনাম হবে । তবে আপনি দেখবেন সবথেকে বেশি লাভবান চিনই হবে ।

প্রশ্ন: প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সামরিক বা কূটনৈতিক স্তরে সম্ভাব্য সমাধানের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী ? যাদের বড় চিনা অংশীদারি আছে বা চিনা মালিকানাধীন সেই PUBG বা Paytm-এর কী হবে ? এরা PM কেয়ার্স ফান্ডে অনুদানও দিয়েছে ?

সুঞ্জয়: চিনের বিপুল বিনিয়োগই আসলে আপনার সেরা বিনিয়োগ ৷ যে চিন বেশি যুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে উঠবে না । যদি ওদের এখানে স্বার্থ না থাকতো তাহলে তাদের আরও যুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ওঠার ঝুঁকি ছিল । চিন আজ একটা নির্দিষ্ট আচরণ কেন করছে ? তারা সুযোগের আঁচ পেয়েছে ৷ তা বুঝতে পারছে যে কিছু দেশ নিজেদের জন্য সমস্যা তৈরি করে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক শত্রুতে পরিণত হতে পারে ৷ তখন কীভাবে সংকটের সময় আপনি তাদের এই পদক্ষেপের খরচ বাড়াবেন ? ALC বা দক্ষিণ চিন সাগর, অথবা অস্ট্রেলিয়ায় সাইবার হামলার ক্ষেত্রে চিনের পদক্ষেপ সুপরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে ভারত সহ তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সক্রিয়তার ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া । যদি পরিস্থিতি আসে তারা কী সত্যিই বেরিয়ে এসে বাকিদের মুখোমুখি হবে ? এটা চিনের তরফে একটা সুনিয়ন্ত্রিত জবাব ৷ ভারতেরও উচিত সুনিয়ন্ত্রিত জবাব দেওয়া । আমাদের কোনও বিকল্প বন্ধ করা উচিত নয় ৷ কিন্তু সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকা উচিত । আমরা এখানে বহুদিনের জন্য আছি । দুটি দেশই এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত ৷

59টি চিনা মোবাইল অ্যাপকে নিষিদ্ধ করা প্রতীক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ৷ কিন্তু এতে আখেরে কী পাওয়া যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । চিনকে জবাব দিতে ভারতকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত দূরদৃষ্টি গড়ে তুলতে হবে ৷ মনে করেন ORF (অবজ়ার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন)-এর চেয়ারম্যান সুঞ্জয় জোশী । সাংবাদিক স্মিতা শর্মার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, রাতারাতি কোনও সরবরাহ ব্যবস্থাকে ছিন্ন করা অসম্ভব ৷ এভাবে 'মেড ইন চায়না'কে আটকানোর চেষ্টা হলে তাতে 'মেড ইন ইন্ডিয়া'র উদ্যোগেও ঝাঁকুনি লাগতে পারে । তিনি আরও বলেন যে সরকারকে একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে ৷ যাতে এখানে উৎপাদনের খরচ কমে ৷ শিল্প ও সরকারকে একে অপরকে বিশ্বাস করতে হবে । তাঁর কথায়, চিনের পরিবর্তে আমদানির জন্য তাইওয়ান বা ভিয়েতনামের উপর নির্ভর করলেও কোনও গ্যারান্টি নেই যে চিনের প্রভাব চলে যাবে । বিশিষ্ট কৌশল বিশেষজ্ঞ এও বলেন, মহামারির মধ্যে যখন জীবন ও জীবিকার বড় মূল্য দিতে হচ্ছে তখন ভারতের উচিত চিনের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করা ৷ নয়তো ভারত নিজের অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে । সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হল:-

প্রশ্ন: ভারত সরকার যে 59টি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে ৷ এটা কী নিছক প্রতীকী নাকি এতে সত্যিই চিনের আঘাত লাগবে ?

সুঞ্জয়: এর একটা অংশ চিনকে বার্তা দেওয়ার জন্য ৷ কিন্তু এতে কতটা লাভ হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । এটা অনেকটাই প্রতীকী । কিন্তু এই সংঘাতের সময় এই সংকেত এবং প্রতীকেরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে । যদি আপনি সাপ্লাই চেন বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলতে শুরু করেন, আগামীকাল থেকেই চিনের ওপর নির্ভরতা বন্ধ করতে বলেন, সেটা সম্ভব নয় । আমার মনে হয় না কেউ সেই চেষ্টা করবেন ৷ এমনকী এই ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন । আমাদের প্রতীকগুলো সরিয়ে বাস্তবের ভিত্তিতে ভাবতে হবে । যদি আপনি এক প্রতিবেশীর সঙ্গে কৌশলগত যুদ্ধ বা কৌশলগত সমঝোতায় ব্যস্ত থাকেন তাহলে এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প ৷ যেখানে পরিকল্পনা এবং ভাবনার প্রয়োজন । রোম একদিনে তৈরি হয়নি । কোনও সাপ্লাই চেনও একদিনে তৈরি হয়নি । বাইদু হোক বা Paytm, চিনা বিনিয়োগ বহু বছর ধরে ভারতে ঢুকেছে । চিন আপনার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে ঢুকে রয়েছে । তাই তাকে বাদ দেওয়া রাতারাতি সম্ভব নয় । শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্বই এর সঙ্গে যুঝে চলেছে । আমাদের প্রতীক, সারবত্তা এবং সংকেতকে তিনটি আলাদা বিষয় হিসেবে ভাবতে হবে ৷ এবং সারবত্তার ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ আমরা নিই সুদূর ভবিষ্যতে সেটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াবে ।

প্রশ্ন: 2019 সালে টিকটকের বিশ্বজুড়ে আয় ছিল 17 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ৷ যেখানে প্রচুর সংখ্যায় ডাউনলোড সত্ত্বেও ভারতের অংশ ছিল মাত্র 0.03 শতাংশ । এতে কি আদৌ চিনের ধাক্কা লাগবে ? নাকি মহামারী যখন আমাদের জীবিকায় ছায়া ফেলেছে তখন এইসব সংস্থার কর্মীদের উপরেই আঘাত আসবে ?

সুঞ্জয়: অ্যাপের জগতে বিকল্প পাওয়ার সম্ভাবনা আছে । ভারত খুব একটা পিছিয়ে নেই । ভারতীয়রাই বিশ্বজুড়ে সবথেকে বেশি অ্যাপ ডেভেলপ করে এবং তারাই অ্যাপ সবথেকে বেশি ডাউনলোড করে । আমার উদ্বেগের জায়গাটা হল, সাপ্লাই চেন ছিন্ন করার কথা বলে গুরুতর সমস্যার দিকে এগিয়ে যাই আমরা । আজ ওষুধ তৈরির 70 শতাংশ আর্কাইভ উপকরণ আসে চিন থেকে । কেন সেগুলো চিন থেকে আসে এই প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের বহু বছর আগেই করা উচিত ছিল । আজ আপনি সেই সরবরাহ ব্যবস্থা হঠাৎ বন্ধ করে দিতে পারেন না । একইভাবে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইলের ক্ষেত্রেও আজ আপনি যদি চিনা সাপ্লাই চেন কেটে দেন তাহলে 'মেড ইন চায়না'কে বিচ্ছিন্ন করার আদতে প্রভাব ফেলবে 'মেড ইন ইন্ডিয়া'-র উপরেও । আপনার মেড ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচি থমকে যাবে । এই মহামারির সময় যখন আপনি কর্মসংস্থান নিয়ে সমস্যায় ৷ যখন আপনি অর্থনীতিকে ফের চালু করতে চাইছেন তখন চিনের থেকে নিজের ক্ষতি বেশি করছেন । সুতরাং আমাদের এগুলো ভাবতে হবে । আমাদের চিনের মোকাবিলা করতে হবে কৌশলগতভাবে ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে । প্রতীক এবং সংকেতের একটা অংশ প্রতিবাদের জন্য, TRP-র জন্য ভালো । কিন্তু পরিকল্পনা ছাড়া বাস্তবে এটা করা যেতে পারে না ।

প্রশ্ন: নিরাপত্তা উদ্বেগই কি এর মূল কারণ ? চিনা অ্যাপগুলো থেকে তথ্য ফাঁসের ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট অ্যামেরিকান ইনপুট আছে কিনা, লোকসভায় এবছর মার্চে এই নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছিল ৷ জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি না বলেছিলেন ৷ এবং এই অ্যাপ নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই বলেও জানিয়েছিলেন । তার 100 দিনের মধ্যেই বলা হচ্ছে যে নিরাপত্তা উদ্বেগই নাকি এইসব অ্যাপ বন্ধ করার কারণ ।

সুঞ্জয়: চিনা হোক বা অ্যামেরিকান, নিরাপত্তার বিষয়টি অ্যাপ এবং হার্ডওয়্যার উভয়ের সঙ্গেই জড়িত । এর সবথেকে ভাল সমাধান হল যে আপনি ভারতেই সবকিছু তৈরি করুন । তাহলে আপনার নিজস্ব সিস্টেম থাকবে ৷ একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে । কিন্তু যতক্ষণ না সেটা করছেন ততক্ষণ আপনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন । এর একটা সমাধান হল টেস্টিং । ইজ়রায়েল বা রাশিয়া ও অন্য দেশগুলির মতো যদি আপনার টেস্টিংয়ের ক্ষমতা না থাকে তাহলে নিরাপত্তার দিকটিরও সমাধান আছে । যদি আপনি মনে করেন যে পিছনে এমন কোনও দেওয়াল তৈরি হয়েছে যা আপনার তথ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, তারও সমাধান আছে । যতক্ষণ না আপনি আত্মনির্ভর হচ্ছেন বা সম্পূর্ণভাবে স্বনির্ভর হচ্ছেন ততক্ষণ কোনও ফারাক হবে না । সিসকো একই জিনিস করছে ৷ অ্যামেরিকার কোম্পানিগুলোও একই জিনিস করছে । উইকিলিকস হল অ্যামেরিকার পিছনে দরজা বা পথ খোলা রাখা এমনকী ইউরোপে নিজের সহযোগীদের ওপরেও গুপ্তচরবৃত্তি করা । আমাদের চিনের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তবধর্মী হতে হবে । চিনকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করতে গেলে আমাদের আজকে কয়েকটা নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে । আপনাকে আপনার শিল্পজগতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে ৷ যেটা এক সপ্তাহ বা এক মাসে সম্ভব নয় । আপনাকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে ৷ যাতে ভারতে বিনিয়োগ এবং কাজ করা আরও সস্তা হয় । অন্যথায় আপনি ভারতে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে যাবেন এবং বিশ্বে অন্য সবার থেকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন ।

চিনা পণ্যের রাতারাতি বর্জনে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' ধাক্কা খেতে পারে : সুঞ্জয় জোশী

প্রশ্ন: ভারতে চিনের মোট বিনিয়োগ তিন বছরে পাঁচগুণ বেড়ে 2014-য় 1.6 বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে 2017-য় 8 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায় । তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশ অধিগ্রহণ এবং অংশীদারির মাধ্যমে বেসরকারিভাবে চিনা বিনিয়োগ আসলে পরিসংখ্যানের অন্তত 25 গুণ বেশি । ভারতে কত চিনা বিনিয়োগ আছে ও তার যথাযথ মূল্যায়ন কি হয়েছে ?

সুঞ্জয়: বিশেষ করে কোরোনা পরিস্থিতির পর এই প্রশ্নগুলো গোটা বিশ্বকে করা হচ্ছে । ভারত এবং গোটা বিশ্ব উপলব্ধি করছে যে কোনও একটি ভৌগলিক অবস্থান এবং বিশেষ করে চিনের ওপর ভরসার নিশ্চয়তা নেই । গোটা বিশ্ব এইসময় সাপ্লাই চেন সরানোর খেলায় মেতেছে । বুদ্ধিমানরা জানেন যে এই চেন তৈরি করতে নূন্যতম 3 বছর থেকে 7, এমনকী দশ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে ৷ বহু সংস্থা আছে সেখানে মানুষ বিনিয়োগ করেছেন ৷ বিরাট আর্থিক সংস্থাগুলো জড়িয়ে আছে । ভারতের সামনে বিকল্প সীমিত এবং সেইজন্যই আজ আমাদের পরিকল্পনা করা উচিত ।

প্রশ্ন: আরও 26 বিলিয়ন ডলার চিনা বিনিয়োগের পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে । তাহলে আপনি যখন চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে শুরু করছেন সেক্ষেত্রে বিকল্পগুলো কী কী ?

সুঞ্জয়: আমাদের ভারতকে পুঁজি এবং বিনিয়োগের একটি প্রতিযোগিতামূলক গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতেই হবে ৷ একে আরও সহজ করতে হবে । উদাহরণস্বরূপ ভারতে উৎপাদন খরচ কমানো যা এখন অত্যন্ত বেশি । চিন বা পাকিস্তান কিছু করেছে বলে এটা বেশি নয় ৷ বরং এটা কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য যা অতীত থেকে আমরা নিয়ে এসেছি । জ্বালানির দাম কমান । বর্তমানে সবকিছুরই একটা সহজ সমাধান আছে । যখনই কোনও আর্থিক সংকট আসে, তখনই ট্যাক্স বেড়ে যায় ৷ জ্বালানির ক্ষেত্রেও এটা হচ্ছে । ভারত আজ পেট্রল আর ডিজ়েলের দাম নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে । বিপদের সময়ে যা আসলে দাম কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারত । যখন আপনি উৎপাদন, নির্মাণ, লজিস্টিক্স, ভারতের মধ্যে পুরো সাপ্লাই চেন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তখন আমাদের কঠিন দৃষ্টিতে দেখতে হয় যে শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক না করার ফল কী হয়েছে । একমাত্র তখনই আমরা চিন-চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারি । আমরা শুধু যখন-তখন কিছু অ্যাপ নিষিদ্ধ করে চিনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারব না ।

প্রশ্ন: সরকারের নীতিকে কে পিছনে টেনে রাখছে ? তারা কীভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে এ সম্পর্কে শিল্পমহলের প্রতিক্রিয়া কী ?

সুঞ্জয়: শিল্প মূলত এমন একটা পরিবেশ চায় যেখানে তারা সস্তায় উৎপাদন করতে পারে । শিল্পশ্রম আইনকে নস্যাৎ করতে বলছে না ৷ বরং তাকে আরও যুক্তিপূর্ণ করতে বলছে । কোনও ভালো শিল্প একথা বলবে না যে তাদের শ্রমিকদের বঞ্চনা করতে দেওয়া হোক । তারা ভালো এবং সার্বিক শ্রম আইন চায় ৷ যা শিল্পকে রক্ষা করবে । ভারতে অন্তত 51টা কেন্দ্রীয় আইন আছে যা শ্রমিকদের দেখাশোনা করার জন্য । কিন্তু যখনই মন্দা আসে তখনই পরিযায়ী সংকট দেখা যায় আপনি লাখ লাখ শ্রমিককে দেখতে পান যাঁদের কোনও নিরাপত্তা নেই । এটা একটা সরকারি ব্যর্থতা যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং যার সংশোধন হওয়া দরকার ।

আমরা যথেষ্ট মনোযোগ নিয়ে এটা দেখছি না যে নয়াদিল্লির ক্ষমতার অলিন্দ ছাড়া শিল্প এবং সরকারের মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে কি না । অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন শ্রমিক পরিদর্শক বা GST/শুল্ক ইন্সপেক্টরের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে । জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে শিল্পকে একগুচ্ছ সমস্যার মুখে পড়তে হয় । এগুলোর মেটানো কঠিন পরিশ্রমের কাজ যা অকুস্থলে গিয়ে করতে হয় । শুধু আইন দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ।

প্রশ্ন: বন্দর এবং কাস্টমসের কাছে আমদানি সংক্রান্ত যা বিবরণ আছে, তা জানিয়ে দিতে বলেছে সরকার । টেলিকম, ইলেকট্রনিকস, তথ্যপ্রযুক্তি চিনা আমদানির ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল । ফার্মা ক্ষেত্রের আমদানির জন্য কোভিড সংকটের সময় ওষুধের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে । এই পদক্ষেপকে কি সুচিন্তিত বলে মনে হচ্ছে ?

সুঞ্জয়: এর মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে । এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং এইসব প্রাচীরগুলো তোলার মধ্যে দিয়ে আপনি ব্যবসার সহজসাধ্যতাকে কমিয়ে দিচ্ছেন । যতদূর ভারতীয় উৎপাদনকে চিনা উৎপাদনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের প্রশ্ন, আপনি হয়তো আসলে কয়েক পা এগোনের বদলে কয়েক পা পিছিয়ে গেছেন । এখন আরও বিশদ বিশ্লেষণ এবং আপনার নিজের শিল্পকে বিশ্বাস করার সময় । আমার মনে হয় না আজকাল আমরা আমাদের শিল্পে ভরসা রাখি । আজ আমরা ভাবি যে আমাদের শিল্পে সবাই খারাপ এবং মুনাফা লোটার পক্ষপাতী । হ্যাঁ, তারা মুনাফা করতেই নেমেছে । কিন্তু সেখানে পারস্পরিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে ৷ মুনাফা কোনও খারাপ শব্দ নয় । মুনাফা অর্থনীতির পক্ষে এবং যাঁরা ব্যবসা করেন তাঁদের পক্ষে ভালো । আসুন আমরা শিল্পপতিদের শ্রদ্ধা করি ৷ কারণ তাঁরা কর্মসংস্থান তৈরি করছেন এবং প্রতিযোগিতামূলক পণ্য উৎপাদন করছেন । ওই চিন্তাভাবনা এবং ইন্টারফেস বদলানো প্রয়োজন । প্রতিটি কৃষকই একজন শিল্পপতি । তাদের সম্মান দিন । আমরা তাদের ওপর নির্ভর করি । এর ওপরেই কৃষি, উৎপাদন থেকে পরিষেবার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে । যদি আমরা আমাদের লোকেদের বিশ্বাস করি তাহলে পুরো অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে । এটা দুপক্ষেরই ব্যাপার । মানুষ সরকারকে বিশ্বাস করে না । তারা মনে করে না যে সরকারের নীতিগুলো স্থায়ী হবে । দুপক্ষের মধ্যেই এই বিশ্বাসটা গড়ে তুলতে হবে ।

প্রশ্ন: ভারতের কি তাইওয়ানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বাড়ানো উচিত ? মেক ইন ইন্ডিয়া পুরোদমে চালু হওয়ার আগে চিনা আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কি আর কোনও বিকল্প রয়েছে ?

সুঞ্জয়: এটা এর মধ্যেই ঘটতে শুরু করেছে । কিন্তু অনেকগুলোরই উৎস সম্পর্কে কখনওই জানা যায় না । তাই আপনি তাইওয়ান বা ভিয়েতনাম বা অন্য কোনও জায়গা থেকে আমদানি করতে পারেন ৷ কিন্তু তাতে চিনের ইমপ্রিন্ট কতটা বড়, কতটা লাভ আসলে চিনে যাচ্ছে, সেটা গণনা করা অত্যন্ত কঠিন । বৈচিত্র একটা কৌশল হতে পারে কিন্তু তার নিজস্ব ঝুঁকি আছে । তাই দেশের মধ্যে কী করা যায় সেটা দেখতে হবে এবং ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে বিকল্প সাপ্লাই চেন গড়ে তুলতে হবে । যখন বিপুল পরিমাণে নির্মাণ চিন থেকে সরে যাবে ৷ উৎপাদন এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবে ৷ মেড ইন ইন্ডিয়া তখন মেড ইন তাইওয়ান বা মেড ইন ভিয়েতনাম হবে । তবে আপনি দেখবেন সবথেকে বেশি লাভবান চিনই হবে ।

প্রশ্ন: প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সামরিক বা কূটনৈতিক স্তরে সম্ভাব্য সমাধানের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী ? যাদের বড় চিনা অংশীদারি আছে বা চিনা মালিকানাধীন সেই PUBG বা Paytm-এর কী হবে ? এরা PM কেয়ার্স ফান্ডে অনুদানও দিয়েছে ?

সুঞ্জয়: চিনের বিপুল বিনিয়োগই আসলে আপনার সেরা বিনিয়োগ ৷ যে চিন বেশি যুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে উঠবে না । যদি ওদের এখানে স্বার্থ না থাকতো তাহলে তাদের আরও যুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ওঠার ঝুঁকি ছিল । চিন আজ একটা নির্দিষ্ট আচরণ কেন করছে ? তারা সুযোগের আঁচ পেয়েছে ৷ তা বুঝতে পারছে যে কিছু দেশ নিজেদের জন্য সমস্যা তৈরি করে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক শত্রুতে পরিণত হতে পারে ৷ তখন কীভাবে সংকটের সময় আপনি তাদের এই পদক্ষেপের খরচ বাড়াবেন ? ALC বা দক্ষিণ চিন সাগর, অথবা অস্ট্রেলিয়ায় সাইবার হামলার ক্ষেত্রে চিনের পদক্ষেপ সুপরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে ভারত সহ তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সক্রিয়তার ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া । যদি পরিস্থিতি আসে তারা কী সত্যিই বেরিয়ে এসে বাকিদের মুখোমুখি হবে ? এটা চিনের তরফে একটা সুনিয়ন্ত্রিত জবাব ৷ ভারতেরও উচিত সুনিয়ন্ত্রিত জবাব দেওয়া । আমাদের কোনও বিকল্প বন্ধ করা উচিত নয় ৷ কিন্তু সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকা উচিত । আমরা এখানে বহুদিনের জন্য আছি । দুটি দেশই এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত ৷

Last Updated : Jul 2, 2020, 11:57 AM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.