ETV Bharat / bharat

মা ভারতে, সন্তান বিদেশে, কোরোনা কেমন প্রভাব ফেলতে পারে মনে

ক্রমেই ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছে কোরোনা ৷ চলছে লকডাউন ৷ বিদেশে চাকরি করেন, এমন অনেকের বাড়ি ফিরতে পারছেন না ৷ দেশে মা-বা ৷ ক্রমেই চিন্তা বাড়ছে ৷ বিষয়টি নিয়ে আলকপাত করছেন টিপি শ্রীনিবাসন ৷

author img

By

Published : Apr 2, 2020, 1:32 PM IST

Updated : Apr 2, 2020, 7:13 PM IST

Covid-19
Covid-19

দিল্লি, 2 এপ্রিল : ভারত এবং বিদেশে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্ক আজ একটা অভূতপূর্ব অবস্থার মধ্যে এসে পৌঁছেছে । সৌজন্যে কোরোনা ভাইরাস । মা ভারতে রয়েছেন ৷ লকডাউনের জন্য দেশে ফিরতে পারছেন না ছেলে ৷

এই ভাইরাস সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে যে সব দেশে ভারতীয়রা কাজ করেন এবং যে সব দেশে তাঁদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, সেখানেই এই ভাইরাসের প্রকোপ যেন সবচেয়ে বেশি । সারা বিশ্বকে শাসিয়ে চলেছে এই ভাইরাস । দাতা এবং গ্রহীতা হিসাবে ভারত এবং বিদেশে থাকা বিপুল ভারতীয় এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক উল্টে যেতে পারে যদি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিন কোটি ভারতীয় দাতার ভূমিকা থেকে সাহায্যের জন্য ভারতের ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে । বঞ্চনা আর দুর্দশার সীমা থাকবে না যদি এই সুবিশাল ভারতীয় জনসংখ্যার জীবন বিপন্ন হয় । যতক্ষণ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমানো যাচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ ভারতের ঘারে বিপুল দায় থেকে যাবে ।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাইরে থেকে খুব‌ বেশি সাহায্যের প্রত্যাশা করা ভারতের উচিত হবে না । চিনের একগুঁয়ে মনোভাবের সামনে রাষ্ট্রপুঞ্জও কেমন যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদের সামনে যাদের দিকে বিশ্বের প্রায় সব দেশের নজর ছিল, সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের আচরণও কেমন যেন অন্তর্মুখী । তারা যেন সব দেশকে নিজেদের বিষয়টা নিজেদেরই বুঝে নিতে বলছে । সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (SAARC), G-20 এবং G-7-এর দূর নিয়ন্ত্রিত বৈঠকগুলিও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার কথা শোনাতে পারেনি ।

উচ্চমানের অভিবাসীদের নিয়ে গর্ব করা ভারতের কাছে এই ভাইরাস মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বের বহু প্রাচীন এবং বিখ্যাত রাজত্ব আপন সম্পদ, গরিমা এবং দায়িত্বের চাপে ভেঙে পড়েছিল। বিদেশে থাকা ভারতীয়রা চিরকালই প্রযুক্তি, অর্থ এবং মেধার আকর। ভারতীয় অর্থনীতি যে দিন থেকে উদার হয়েছে এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে দিন থেকে উন্নত দেশে থাকা আধুনিক অভিবাসী এবং পশ্চিম এশিয়ায় থাকা বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে সামনে এসেছে। তিন কোটি অভিবাসীর দুর্দান্ত সম্পদ ভারতের GDP-কে টপকে গিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই অভিবাসীরা ভারতকে বহু সাহায্য করেছে।

ভারতের এই অভিবাসী ‘সাম্রাজ্য’-এর বৃদ্ধির দিকে যদি নজর দেওয়া হয়, তা হলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য এক ‘পরিযায়ী ঢেউ’ উঠেছে যার বেশির ভাগটাই ছিল অসংগঠিত অথবা বিশেষ কোনও কারণে। ভাল চাকরি বা ভাল ভবিষ্যতের আশায় এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বহু বার বহু ভারতীয় উন্নত দেশে গিয়েছেন। এক সময় এই বিষয়টাকে ‘ব্রেন ড্রেন’ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু পরে দেখা গিয়েছে যে, এতে ভারতের উপকারই হয়েছে কেন না এ দেশে মেধাসত্বের কোনও অভাব ছিল না। বেশ কিছু বাধা সত্ত্বেও আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বহু ভারতীয় পেশাদার সে দেশে চলে যান এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত উন্নতি করেন। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশে ভারতীয়ের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমেরিকায় প্রযুক্তি আর ভারতীয় প্রায় সমনাম হয়ে যায়। এই ভারতীয়রা কখনই কোনও জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হননি। দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে খুব অল্প সংখ্যক অভিবাসীই যুক্ত।

পশ্চিম এশিয়ায় অর্ধ প্রশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও ছিল না কোনও আগাম পরিকল্পনা। এমনকি অভিবাসীদের সংখ্যার এই বৃদ্ধি ছিল আশাতীতও। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং কিছু বিবেকহীন দালালের মাধ্যমে এই বিশাল ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণি বেড়ে ওঠে। কিন্তু দালালের অত্যাচার এবং আরও কিছু বাধা অতিক্রম করে এই ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিক শ্রেণির একটা বড় অংশ যা আয় করতেন, তা দেশের আয়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল। এই সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এঁরা বিদেশ থেকে অর্থ রোজগার করে দেশে এনে ভারতীয় অর্থনীতির উপকার করতে থাকেন। এই অর্থের আবার অনেকটা অংশ নষ্ট হয় পরিকল্পনাহীন বিনিয়োগের ফলে এবং দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের অভাবে। পরিযায়ীদের বেশ কয়েক জন আবার যথেষ্ট সম্পদের মালিকও হয়ে ওঠেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর ফলে উন্নত মানের চাকরিও তৈরি হতে থাকে। পশ্চিম এশিয়া থেকে পাওয়া এই ‘লটারি’র সঠিক অর্থ ধীরে ধীরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো বুঝতে শুরু করে এবং দুই পক্ষের মধ্যে একটা অদৃশ্য সমঝোতা তৈরি হয়। এই সব ভারতীয়ের কঠিন পরিশ্রম এবং সুনামের জোরে ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সম্পর্কে উন্নতি হতে শুরু করে।

এই অভিবাসীদের জন্য হৃদয়ের দরজা খুলে দেয় ভারতও। বিদেশে এই ভারতীয়দের জন্য যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি দিল্লি এবং রাজ্যের রাজধানীগুলোতে আয়োজিত হতে থাকে প্রবাসী দিবস এবং প্রবাসী সম্মান। তাঁদের যতটা সম্ভব সমস্যা দূর করতে সচেষ্ট হয় সরকার। পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতার একটা সম্পর্ক তৈরি হয় সরকার এবং এই অভিবাসীদের মধ্যে। সরকারি মধ্যস্ততায় ধনী পরিযায়ীরা এ দেশে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। প্রবাসী ভারতীয় নেতাদের দলে টানতে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এই প্রবাসীরা দলগুলিকে অর্থ সাহায্য করতেন এবং বিনিময়ে কিছু সুবিধা পেতেন। যখনই আইন এই প্রবাসীদের দেশে ফিরতে বাধ্য করেছে, তখনই হয় সরকার মাঝখানে এসে তাঁদের সে দেশেই থাকার ব্যবস্থা করেছে, না হলে ঋণ বা অনুদান দিয়ে দেশে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, পশ্চিম এশিয়ায় থাকা ভারতীয়রা ভারতের উন্নতিতে অংশ নিয়েছে এবং এর বিনিময়ে রাষ্ট্রের দেওয়া সুযোগ সুবিধা নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যখনই প্রবাসীরা সমস্যায় পড়েছেন, তখনই এ দেশের সরকার এগিয়ে এসেছে। এই নীতি কিন্তু আগে অনেকটাই আলাদা ছিল। তখন বর্মা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ বা উগান্ডার মতো দেশে যাওয়া ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকত। এই নীতির পরিবর্তন আসে ১৯৮৮ সাল নাগাদ, যখন ফিজিতে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী হামলা চালায় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কমনওয়েলথ থেকে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারকে বহিষ্কার করেন।

কোভিড-১৯ এই সুন্দর এবং সুখী পরিবেশেই হানা দিয়েছে এবং শেকসপিয়ারের খল চরিত্রের মতো বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি করে সব কিছু উল্টে পাল্টে দিয়েছে। এর প্রধান কারণ হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক ভারতীয়রা যাঁদের হাত ধরে এ দেশে প্রাথমিক ভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এ দেশে প্রথম সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসে কেরলের এক ছাত্রের মাধ্যমে যিনি এসেছিলেন এই অসুখের কেন্দ্র চিনের উহান থেকে। ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত, যেমন ইটালি, স্পেন, ইরান থেকে উদ্বিগ্ন ভারতীয়রা যত দ্রুত সম্ভব ভারতে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। যদি বিমান পরিবহণ স্থগিত না হতো এবং যদি বিশ্ব জুড়ে বিমানবন্দরগুলি বন্ধ করে দেওয়া না হতো, তা হলে হাজারে হাজারে ভারতীয় ভাইরাস-সহ অথবা ভাইরাস ছাড়া এ দেশে প্রবেশ করতেন এবং প্রতি ক্ষেত্রে আপৎকালীন অবস্থার সৃষ্টি হতো। ভারত তাও বেশ কিছু দেশ থেকে প্রবাসীদের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, কিন্তু শীঘ্রই তা ভারতের ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে।

কিন্তু যে ভাবে ভাইরাস-প্রভাবিত ভারতীয়রা তাঁদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার সরকারি অক্ষমতাকে দোষারোপ করেছে, তা অত্যন্ত অশুভ ইঙ্গিত দিয়েছে। এঁদের একটা বড় অংশ স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছিল এবং কেউ আশঙ্কা করেনি যে, তাঁরা এই রকম এক অপ্রত্যাশিত অবস্থার মুখোমুখি হবেন। ভারতের পক্ষেও এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সময় লেগেছে। কিন্তু, চলতি লকডাউনের পরেও যদি ভাইরাস থেকে যায়, তা হলে এঁদের দেশে ফেরানোর কাজটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। পশ্চিম এশিয়া এবং আমেরিকা, যেখানে অবস্থা ক্রমেই জটিল হচ্ছে, সেখান থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে আক্ষরিক অর্থেই সরকারকে বহু শ্রম দিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভারতীয়রা সবাই যদি দেশে ফিরে আসতে চান, তা হলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে পারে।

কোভিড-১৯-এর আর একটি দুর্ভাগ্যজনক দিক হল, এটিকে আমদানিকৃত রোগ হিসাবে দেখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে থাকা ভারতীয় এবং বিদেশিদের মাধ্যমে এই রোগের প্রসার ঘটেছে। কোনও ক্ষেত্রে আবার আক্রান্ত নিজে বোঝেননি যে তিনি এই ভাইরাস শরীরে বহন করছেন এবং সামাজিক ভাবে মেলামেশা করেছেন। অনেকে আবার ইচ্ছা করেই জানাননি যে তিনি সংক্রামিত এলাকা থেকে এসেছেন। এখনও পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই আক্রান্ত হয়েছেন যাঁদের বিদেশ যোগ রয়েছে। এখনও প্রতি দিন যখন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে কোভিড-১৯-এর অবস্থা নিয়ে বিবৃতি দেন, তত বারই তিনি এটা বলেন যে, পশ্চিম এশিয়া থেকে ফেরা মানুষদের মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর ফলে অনেকে মনোক্ষুণ্ণও হচ্ছেন।

একটা বড় রহস্য এই যে, দেশে ফেরা বহু মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯-এর বহু লক্ষণ দেখা গিয়েছিল বিমানে ওঠার পর। লক্ষণ বোঝার সময়কাল অনেক দিন হওয়ায় এটা হয়ত ততটা গৃহীত তথ্য নয়। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ, যাঁরা বহু বছর বিমান পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা মনে করেন যে, সস্তার উড়ানে এই সব সংক্রামিত জায়গায় যাওয়ার ফলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের মতে, জীবাণুনাশকের ব্যবহার, যা প্রতি বিমানের ক্ষেত্রে আবশ্যিক, তা এই সব বিমানের ক্ষেত্রে করা হয়নি।

এই গল্পের কোনও ভিলেন নেই। প্রবাসী ভারতীয়, অন্তত যাঁরা ভারতীয় নাগরিক, তাঁদের অধিকার রয়েছে দেশে ফেরার এবং ভারতও তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। প্রবাসে থাকা তার সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে ভারতমাতার। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ভাইরাসের প্রকোপ না কমা পর্যন্ত যিনি যেখানে আছেন তিনি সেখানেই থাকুন। এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেই হবে। এই সিদ্ধান্ত চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, পরিস্থিতির উন্নতি হলেও যাঁদের প্রয়োজন হবে।

অভিবাসীদের দেশে ফেরানো নিয়ে ভারতের অনিচ্ছার কথা এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষ একসঙ্গে দেশে ফেরার চেষ্টা করলে সমস্যা হবেই। পরিযায়ী শ্রমিকরা যদি সম্মান ও যথেষ্ট বেতন পান, তা হলে তাঁরা যে দেশে আছেন এবং ভারতের পক্ষেও তা যথেষ্ট স্বস্তির। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা যে সমস্যার সামনে পড়ছেন, তেমন সমস্যায় এই প্রবাসী শ্রমিকদের যেন পড়তে না হয়।

ইরাক ও কুয়েতের যুদ্ধের সময় যে তত্পরতার সঙ্গে সেখানকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, তা একেবারেই ভাল ভাবে নেয়নি সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন। দেশগুলি অভিযোগ করেছিল এই বলে যে, ভারতীয়রা ঠিক সেই সময় দেশ ছেড়েছিলেন যখন তাঁদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।শ্রমিকদের কুয়েতে ফেরত পাঠাতে ভারতকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতের উচিত সেই সব দেশের সঙ্গে এই মর্মে দর কষাকষি করা, যেন সেখানকার ভারতীয়রা সঠিক চিকিৎসা ও সুযোগসুবিধা পান। যদি তাঁদের সঠিক বেতন দেওয়া হয় এবং তাঁরা যদি বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ পান, তা হলে তাঁরা হয়তো দেশে ফেরার চেয়ে সে দেশে থেকে যাওয়াই সঠিক বলে মনে করবেন। কিন্তু যদি দেশে ফেরার পাগলামো শুরু হয়, তা হলে একটা সময়ের পর তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজন।

কোভিড-১৯ অতিমারীর বিশেষত্ব হল, এর সামনে সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গুরুত্ব হারায় কারণ সামনে তখন একটাই প্রশ্ন থাকে— জীবন না মৃত্যু। এটা অনেকটা রাশিয়ান রুলের মতো। কেউ জানেন না এই অতিমারীর গল্প শোনাতে, বিশ্বকে পথ দেখাতে তিনি আদৌ বেঁচে থাকবেন কি না। কিন্তু ভারতীয়রা বিশ্বের সব জায়গায় থাকবেন এবং ভারতের যে কোনও সরকার এই প্রবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য সচেষ্ট থাকবে। কেননা আমরা সবাই জানি যে, আমরা ভারতীয়দের যে কোনও জায়গায় নিয়ে রেখে আসতে পারি কিন্তু তার থেকে ভারতীয়ত্ব কখনও সরিয়ে ফেলতে পারব না।

দিল্লি, 2 এপ্রিল : ভারত এবং বিদেশে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে সম্পর্ক আজ একটা অভূতপূর্ব অবস্থার মধ্যে এসে পৌঁছেছে । সৌজন্যে কোরোনা ভাইরাস । মা ভারতে রয়েছেন ৷ লকডাউনের জন্য দেশে ফিরতে পারছেন না ছেলে ৷

এই ভাইরাস সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে যে সব দেশে ভারতীয়রা কাজ করেন এবং যে সব দেশে তাঁদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, সেখানেই এই ভাইরাসের প্রকোপ যেন সবচেয়ে বেশি । সারা বিশ্বকে শাসিয়ে চলেছে এই ভাইরাস । দাতা এবং গ্রহীতা হিসাবে ভারত এবং বিদেশে থাকা বিপুল ভারতীয় এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক উল্টে যেতে পারে যদি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিন কোটি ভারতীয় দাতার ভূমিকা থেকে সাহায্যের জন্য ভারতের ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে । বঞ্চনা আর দুর্দশার সীমা থাকবে না যদি এই সুবিশাল ভারতীয় জনসংখ্যার জীবন বিপন্ন হয় । যতক্ষণ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমানো যাচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ ভারতের ঘারে বিপুল দায় থেকে যাবে ।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাইরে থেকে খুব‌ বেশি সাহায্যের প্রত্যাশা করা ভারতের উচিত হবে না । চিনের একগুঁয়ে মনোভাবের সামনে রাষ্ট্রপুঞ্জও কেমন যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদের সামনে যাদের দিকে বিশ্বের প্রায় সব দেশের নজর ছিল, সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের আচরণও কেমন যেন অন্তর্মুখী । তারা যেন সব দেশকে নিজেদের বিষয়টা নিজেদেরই বুঝে নিতে বলছে । সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (SAARC), G-20 এবং G-7-এর দূর নিয়ন্ত্রিত বৈঠকগুলিও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার কথা শোনাতে পারেনি ।

উচ্চমানের অভিবাসীদের নিয়ে গর্ব করা ভারতের কাছে এই ভাইরাস মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বের বহু প্রাচীন এবং বিখ্যাত রাজত্ব আপন সম্পদ, গরিমা এবং দায়িত্বের চাপে ভেঙে পড়েছিল। বিদেশে থাকা ভারতীয়রা চিরকালই প্রযুক্তি, অর্থ এবং মেধার আকর। ভারতীয় অর্থনীতি যে দিন থেকে উদার হয়েছে এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে দিন থেকে উন্নত দেশে থাকা আধুনিক অভিবাসী এবং পশ্চিম এশিয়ায় থাকা বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে সামনে এসেছে। তিন কোটি অভিবাসীর দুর্দান্ত সম্পদ ভারতের GDP-কে টপকে গিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই অভিবাসীরা ভারতকে বহু সাহায্য করেছে।

ভারতের এই অভিবাসী ‘সাম্রাজ্য’-এর বৃদ্ধির দিকে যদি নজর দেওয়া হয়, তা হলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য এক ‘পরিযায়ী ঢেউ’ উঠেছে যার বেশির ভাগটাই ছিল অসংগঠিত অথবা বিশেষ কোনও কারণে। ভাল চাকরি বা ভাল ভবিষ্যতের আশায় এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বহু বার বহু ভারতীয় উন্নত দেশে গিয়েছেন। এক সময় এই বিষয়টাকে ‘ব্রেন ড্রেন’ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু পরে দেখা গিয়েছে যে, এতে ভারতের উপকারই হয়েছে কেন না এ দেশে মেধাসত্বের কোনও অভাব ছিল না। বেশ কিছু বাধা সত্ত্বেও আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বহু ভারতীয় পেশাদার সে দেশে চলে যান এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত উন্নতি করেন। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশে ভারতীয়ের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমেরিকায় প্রযুক্তি আর ভারতীয় প্রায় সমনাম হয়ে যায়। এই ভারতীয়রা কখনই কোনও জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হননি। দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে খুব অল্প সংখ্যক অভিবাসীই যুক্ত।

পশ্চিম এশিয়ায় অর্ধ প্রশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও ছিল না কোনও আগাম পরিকল্পনা। এমনকি অভিবাসীদের সংখ্যার এই বৃদ্ধি ছিল আশাতীতও। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং কিছু বিবেকহীন দালালের মাধ্যমে এই বিশাল ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণি বেড়ে ওঠে। কিন্তু দালালের অত্যাচার এবং আরও কিছু বাধা অতিক্রম করে এই ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিক শ্রেণির একটা বড় অংশ যা আয় করতেন, তা দেশের আয়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল। এই সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এঁরা বিদেশ থেকে অর্থ রোজগার করে দেশে এনে ভারতীয় অর্থনীতির উপকার করতে থাকেন। এই অর্থের আবার অনেকটা অংশ নষ্ট হয় পরিকল্পনাহীন বিনিয়োগের ফলে এবং দীর্ঘকালীন বিনিয়োগের অভাবে। পরিযায়ীদের বেশ কয়েক জন আবার যথেষ্ট সম্পদের মালিকও হয়ে ওঠেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর ফলে উন্নত মানের চাকরিও তৈরি হতে থাকে। পশ্চিম এশিয়া থেকে পাওয়া এই ‘লটারি’র সঠিক অর্থ ধীরে ধীরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো বুঝতে শুরু করে এবং দুই পক্ষের মধ্যে একটা অদৃশ্য সমঝোতা তৈরি হয়। এই সব ভারতীয়ের কঠিন পরিশ্রম এবং সুনামের জোরে ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সম্পর্কে উন্নতি হতে শুরু করে।

এই অভিবাসীদের জন্য হৃদয়ের দরজা খুলে দেয় ভারতও। বিদেশে এই ভারতীয়দের জন্য যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি দিল্লি এবং রাজ্যের রাজধানীগুলোতে আয়োজিত হতে থাকে প্রবাসী দিবস এবং প্রবাসী সম্মান। তাঁদের যতটা সম্ভব সমস্যা দূর করতে সচেষ্ট হয় সরকার। পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতার একটা সম্পর্ক তৈরি হয় সরকার এবং এই অভিবাসীদের মধ্যে। সরকারি মধ্যস্ততায় ধনী পরিযায়ীরা এ দেশে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। প্রবাসী ভারতীয় নেতাদের দলে টানতে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এই প্রবাসীরা দলগুলিকে অর্থ সাহায্য করতেন এবং বিনিময়ে কিছু সুবিধা পেতেন। যখনই আইন এই প্রবাসীদের দেশে ফিরতে বাধ্য করেছে, তখনই হয় সরকার মাঝখানে এসে তাঁদের সে দেশেই থাকার ব্যবস্থা করেছে, না হলে ঋণ বা অনুদান দিয়ে দেশে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, পশ্চিম এশিয়ায় থাকা ভারতীয়রা ভারতের উন্নতিতে অংশ নিয়েছে এবং এর বিনিময়ে রাষ্ট্রের দেওয়া সুযোগ সুবিধা নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যখনই প্রবাসীরা সমস্যায় পড়েছেন, তখনই এ দেশের সরকার এগিয়ে এসেছে। এই নীতি কিন্তু আগে অনেকটাই আলাদা ছিল। তখন বর্মা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ বা উগান্ডার মতো দেশে যাওয়া ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকত। এই নীতির পরিবর্তন আসে ১৯৮৮ সাল নাগাদ, যখন ফিজিতে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী হামলা চালায় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কমনওয়েলথ থেকে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারকে বহিষ্কার করেন।

কোভিড-১৯ এই সুন্দর এবং সুখী পরিবেশেই হানা দিয়েছে এবং শেকসপিয়ারের খল চরিত্রের মতো বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি করে সব কিছু উল্টে পাল্টে দিয়েছে। এর প্রধান কারণ হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক ভারতীয়রা যাঁদের হাত ধরে এ দেশে প্রাথমিক ভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এ দেশে প্রথম সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসে কেরলের এক ছাত্রের মাধ্যমে যিনি এসেছিলেন এই অসুখের কেন্দ্র চিনের উহান থেকে। ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত, যেমন ইটালি, স্পেন, ইরান থেকে উদ্বিগ্ন ভারতীয়রা যত দ্রুত সম্ভব ভারতে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। যদি বিমান পরিবহণ স্থগিত না হতো এবং যদি বিশ্ব জুড়ে বিমানবন্দরগুলি বন্ধ করে দেওয়া না হতো, তা হলে হাজারে হাজারে ভারতীয় ভাইরাস-সহ অথবা ভাইরাস ছাড়া এ দেশে প্রবেশ করতেন এবং প্রতি ক্ষেত্রে আপৎকালীন অবস্থার সৃষ্টি হতো। ভারত তাও বেশ কিছু দেশ থেকে প্রবাসীদের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, কিন্তু শীঘ্রই তা ভারতের ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে।

কিন্তু যে ভাবে ভাইরাস-প্রভাবিত ভারতীয়রা তাঁদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার সরকারি অক্ষমতাকে দোষারোপ করেছে, তা অত্যন্ত অশুভ ইঙ্গিত দিয়েছে। এঁদের একটা বড় অংশ স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছিল এবং কেউ আশঙ্কা করেনি যে, তাঁরা এই রকম এক অপ্রত্যাশিত অবস্থার মুখোমুখি হবেন। ভারতের পক্ষেও এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সময় লেগেছে। কিন্তু, চলতি লকডাউনের পরেও যদি ভাইরাস থেকে যায়, তা হলে এঁদের দেশে ফেরানোর কাজটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। পশ্চিম এশিয়া এবং আমেরিকা, যেখানে অবস্থা ক্রমেই জটিল হচ্ছে, সেখান থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে আক্ষরিক অর্থেই সরকারকে বহু শ্রম দিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভারতীয়রা সবাই যদি দেশে ফিরে আসতে চান, তা হলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হতে পারে।

কোভিড-১৯-এর আর একটি দুর্ভাগ্যজনক দিক হল, এটিকে আমদানিকৃত রোগ হিসাবে দেখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে থাকা ভারতীয় এবং বিদেশিদের মাধ্যমে এই রোগের প্রসার ঘটেছে। কোনও ক্ষেত্রে আবার আক্রান্ত নিজে বোঝেননি যে তিনি এই ভাইরাস শরীরে বহন করছেন এবং সামাজিক ভাবে মেলামেশা করেছেন। অনেকে আবার ইচ্ছা করেই জানাননি যে তিনি সংক্রামিত এলাকা থেকে এসেছেন। এখনও পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই আক্রান্ত হয়েছেন যাঁদের বিদেশ যোগ রয়েছে। এখনও প্রতি দিন যখন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে কোভিড-১৯-এর অবস্থা নিয়ে বিবৃতি দেন, তত বারই তিনি এটা বলেন যে, পশ্চিম এশিয়া থেকে ফেরা মানুষদের মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর ফলে অনেকে মনোক্ষুণ্ণও হচ্ছেন।

একটা বড় রহস্য এই যে, দেশে ফেরা বহু মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯-এর বহু লক্ষণ দেখা গিয়েছিল বিমানে ওঠার পর। লক্ষণ বোঝার সময়কাল অনেক দিন হওয়ায় এটা হয়ত ততটা গৃহীত তথ্য নয়। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ, যাঁরা বহু বছর বিমান পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা মনে করেন যে, সস্তার উড়ানে এই সব সংক্রামিত জায়গায় যাওয়ার ফলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের মতে, জীবাণুনাশকের ব্যবহার, যা প্রতি বিমানের ক্ষেত্রে আবশ্যিক, তা এই সব বিমানের ক্ষেত্রে করা হয়নি।

এই গল্পের কোনও ভিলেন নেই। প্রবাসী ভারতীয়, অন্তত যাঁরা ভারতীয় নাগরিক, তাঁদের অধিকার রয়েছে দেশে ফেরার এবং ভারতও তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। প্রবাসে থাকা তার সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে ভারতমাতার। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ভাইরাসের প্রকোপ না কমা পর্যন্ত যিনি যেখানে আছেন তিনি সেখানেই থাকুন। এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেই হবে। এই সিদ্ধান্ত চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, পরিস্থিতির উন্নতি হলেও যাঁদের প্রয়োজন হবে।

অভিবাসীদের দেশে ফেরানো নিয়ে ভারতের অনিচ্ছার কথা এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এত বেশি সংখ্যক মানুষ একসঙ্গে দেশে ফেরার চেষ্টা করলে সমস্যা হবেই। পরিযায়ী শ্রমিকরা যদি সম্মান ও যথেষ্ট বেতন পান, তা হলে তাঁরা যে দেশে আছেন এবং ভারতের পক্ষেও তা যথেষ্ট স্বস্তির। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা যে সমস্যার সামনে পড়ছেন, তেমন সমস্যায় এই প্রবাসী শ্রমিকদের যেন পড়তে না হয়।

ইরাক ও কুয়েতের যুদ্ধের সময় যে তত্পরতার সঙ্গে সেখানকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, তা একেবারেই ভাল ভাবে নেয়নি সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন। দেশগুলি অভিযোগ করেছিল এই বলে যে, ভারতীয়রা ঠিক সেই সময় দেশ ছেড়েছিলেন যখন তাঁদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।শ্রমিকদের কুয়েতে ফেরত পাঠাতে ভারতকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতের উচিত সেই সব দেশের সঙ্গে এই মর্মে দর কষাকষি করা, যেন সেখানকার ভারতীয়রা সঠিক চিকিৎসা ও সুযোগসুবিধা পান। যদি তাঁদের সঠিক বেতন দেওয়া হয় এবং তাঁরা যদি বেঁচে থাকার আদর্শ পরিবেশ পান, তা হলে তাঁরা হয়তো দেশে ফেরার চেয়ে সে দেশে থেকে যাওয়াই সঠিক বলে মনে করবেন। কিন্তু যদি দেশে ফেরার পাগলামো শুরু হয়, তা হলে একটা সময়ের পর তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজন।

কোভিড-১৯ অতিমারীর বিশেষত্ব হল, এর সামনে সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গুরুত্ব হারায় কারণ সামনে তখন একটাই প্রশ্ন থাকে— জীবন না মৃত্যু। এটা অনেকটা রাশিয়ান রুলের মতো। কেউ জানেন না এই অতিমারীর গল্প শোনাতে, বিশ্বকে পথ দেখাতে তিনি আদৌ বেঁচে থাকবেন কি না। কিন্তু ভারতীয়রা বিশ্বের সব জায়গায় থাকবেন এবং ভারতের যে কোনও সরকার এই প্রবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য সচেষ্ট থাকবে। কেননা আমরা সবাই জানি যে, আমরা ভারতীয়দের যে কোনও জায়গায় নিয়ে রেখে আসতে পারি কিন্তু তার থেকে ভারতীয়ত্ব কখনও সরিয়ে ফেলতে পারব না।

Last Updated : Apr 2, 2020, 7:13 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.