ETV Bharat / bharat

COVID-19 : চিন বনাম বাকি দুনিয়া - বেল্ট অ্যান্ড রোড

আন্তর্জাতিক মহলের কিছু অংশে, নির্দিষ্টভাবে অ্যামেরিকা, চিনের বিরুদ্ধে যে চক্রান্তের তত্ত্বকথা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হল কোরোনা ভাইরাস চিনের ইউহানের একটি গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছিল এবং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশ্বকে দুর্বল করার জন্য । পাশাপাশি, চিনের বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবী এই ধারণাতেও একমত হয়েছিল যে, সঠিক সময়ে এই মহামারী সম্পর্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে সতর্ক করতে চিন ব্যর্থ হয়েছিল যার ফলে আজ বিশ্বে এত প্রাণের বলি হয়েছে এবং বিশ্বের অর্থনীতির গতি কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়েছে । এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন রাষ্ট্রদূত আঁচল মালহোত্রা ৷

COVID-19
COVID-19
author img

By

Published : Apr 23, 2020, 6:09 PM IST

দিল্লি, 23 এপ্রিল: COVID–১৯ সংকটের আবহে চিন ও বাকি পৃথিবীর মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে ৷ এই বিশ্বাসভঙ্গের প্রাথমিক কারণগুলি হল, বিশ্বের একাধিক দেশের উপর চিনের ক্ষমতা প্রসারণ, নিজের পদক্ষেপ ফেলা এবং প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করার পাশাপাশি আর্থিক দাসত্ব বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করার ক্রমাগত প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যমত্য সৃষ্টি হয়েছে যে, চিনের ফলপ্রসূ অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত প্রকল্প এবং এর আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং সাহায্যের নিয়মনীতির মধ্যে গুরুতর ভূ-রাজনৈতিক তথা কৌশলগত এবং নিরাপত্তাগত উদ্দেশ্য রয়েছে । নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (OBOR) এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড (BRI) উদ্যোগ এবং তার অনিবার্য ফল অর্থাৎ ঋণের বন্ধনে জড়িয়ে ফেলার নীতিকে পৃথিবীর সব দেশ সন্দেহের চোখে দেখছে । বেশিরভাগ বড় বড় দেশই যেমন অ্যামেরিকা এবং ভারত, চিনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যে বৃহৎ ঘাটতির ঘটনা এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী ও বড় বড় সংস্থাগুলিতে চিনের ক্রমাগত অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির ঘটনায় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন । বিশেষ করে বিবাদে জর্জরিত দক্ষিণ চিন সাগর এলাকায় চিনের স্বৈরাচারী মনোভাবকে ওই এলাকায় নৌচালনা এবং বিমানচালনার স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে কারণ এই এলাকার মাধ্যমে কয়েক বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয় ।

যেভাবে COVID–১৯ মহামারী ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এবং একের পর এক দেশকে রীতিমতো গ্রাস করছে, আর তারই মধ্যে যেভাবে চিন এই সংকটের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে তাতে এই দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং সম্মানে আরও বড় ফাটল তৈরি হওয়া নিশ্চিত যা আন্তর্জাতিক মহলকে এ ব্যাপারে আরও সতর্ক করে তুলেছে । তা কীভাবে হচ্ছে, সে বিষয়ে নিচে বর্ণনা করা হল ।

আন্তর্জাতিক মহলের কিছু অংশে, নির্দিষ্টভাবে আমেরিকায়, চিনের বিরুদ্ধে যে চক্রান্তের তত্ত্বকথা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হল কোরোনা ভাইরাস চিনের ইউহানের একটি গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছিল এবং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশ্বকে দুর্বল করার জন্য । পাশাপাশি, চিনের বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবী এই ধারণাতেও একমত হয়েছিল যে, সঠিক সময়ে এই মহামারী সম্পর্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে সতর্ক করতে চিন ব্যর্থ হয়েছিল যার ফলে আজ বিশ্বে এত প্রাণের বলি হয়েছে এবং বিশ্বের অর্থনীতির গতি কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়েছে । চিনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও উঠেছে যে তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) বিপথে চালিত করতে সফল হয়েছে কারণ এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস আড্যানম গেব্রিয়েসিস ২০১৭ সালের মে মাসে এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন চিনের সমর্থনেই ৷ তাই সংকট মোচনে চিনের ব্যর্থতাকে তিনি গোপন করেছেন । শুধু তাই নয়, এই মারণ ভাইরাস কীভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল তা নিয়ে চিনের ব্যাখ্যাকেই অন্ধভাবে কেবল সমর্থনই করেননি, একধাপ এগিয়ে এর নিবারণে চিনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন তিনি ।

ইতিমধ্যে চিনের বিগড়ে যাওয়া ভাবমূর্তিতে এই সত্য আরও কালিমা লেপন করেছে যে এই সংকটের সময়েও চিন চারিদিকে সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে । সংবাদমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়েছে যে, চিন ইট্যালিকে (যা পরবর্তী সময়ে কোরোনা ভাইরাসের ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়) সেই সব পার্সোনাল প্রোক্টেকশন ইকুইপমেন্ট (PPE) বিক্রি করেছে, যা ইট্যালি আগে কয়েক টন পরিমাণে চিনকে দান করেছিল যখন চিনে এই প্যানডেমিকের সূত্রপাত হয়েছিল ।

এই ঘটনা নিতান্তই লজ্জাজনক যদি তা সত্য হয় । এছাড়াও চিন খুব তাড়াতাড়ি প্রচুর অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা চালাচ্ছে নিম্ন গুণমানের চিকিৎসা সামগ্রী বিক্রি করে । চিনের দেওয়া ৫০ হাজার বিকল কুইক টেস্টিং কিট স্পেন ফিরিয়ে দিয়েছে । একইরকমভাবে নেদারল্যান্ডও চিনা সামগ্রী গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে কারণ তা তাদের নিরাপত্তার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি সেই সামগ্রীগুলি ।

আরও বেশি গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগের বিষয় হল বিশ্বব্যাপী বাজারে যেভাবে শেয়ারের পতন ঘটছে, তার সুযোগ নিয়ে চিন আন্তর্জাতিক বাজারে শেয়ার এবং সম্পত্তি প্রচুর পরিমাণে কিনে নিতে পারে । আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু কিছু দেশ বর্তমানে চিনা ফার্মগুলির কাছে প্রযুক্তি সংস্থাগুলির বিক্রি রুখে দিতে সচেষ্ট হয়েছে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাজনিত কারণে । আবার অন্যদিকে মহামারীর প্রার্দুভাবের পর ইট্যালি, স্পেন ও জার্মানির মতো দেশ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কড়া নজরদারি চালু করেছে, বিশেষ করে চিনের জন্য ।

পশ্চিমী দেশগুলি চিনের বিরুদ্ধে কোরোনা সংক্রমণে তাদের ভূমিকার তদন্ত দাবি করেছে, অ্যামেরিকায় ইতিমধ্যে মামলা দায়ের হয়েছে এবং অন্যান্য দেশগুলিও ভাইরাস সংক্রমণে চিনকে দায়ী করে ক্ষয়ক্ষতির জন্য চিনের কাছ থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে । অন্যদিকে, অ্যামেরিকা আবার এই সংকটের মুহূর্তে WHO এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক (যদিও অধিকাংশেরই মতে তা এড়ানো যেত) ব্যবস্থা হিসাবে আর্থিক অনুদান বন্ধ করার ঘোষণা করেছে ।

কিন্তু ভারত এ নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া দিয়েছে? চিনের বিরুদ্ধে এই আন্তর্জাতিক রোষের সঙ্গে গলা না মিলিয়ে সরকারিভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ভারত । পাশাপাশি প্রত্যক্ষভাবে WHO এর বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনা করাও এড়িয়ে গিয়েছে ভারত ৷ পরিবর্তে (G-20 ভার্চুয়াল কনফারেন্স) WHO এর সংস্কার সাধন এবং মজবুতীকরণের হয়ে সওয়াল করেছে । এই মুহূর্তে ভারত যে যে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তার মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে নিজেদের দেশে কোভিড–১৯ এর সংক্রমণ যেন তৃতীয় স্তরে না পৌঁছয়, তার জন্য আপ্রাণভাবে চেষ্টা করা এবং অন্যদিকে রয়েছে এই মহামারীকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহত বিশ্বব্যপী উদ্যোগকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করা, দরিদ্র দেশগুলির জন্য আর্থিক তহবিল তৈরি করা, তথ্যের বিনিময় করা, যত দ্রুত সম্ভব নভেল কোরোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে এমন প্রতিষেধক তৈরির জন্য গবেষণায় সাহায্য করা প্রভৃতি ।

বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্রে ভারত একটি দ্বিমুখী তথা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এগিয়েছে । সেই মতো বিশ্বব্যপী গবেষণার অঙ্গ হিসাবে ভারত চিন থেকে এই মহামারীর আবহে অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সরঞ্জাম কেনা চালু রেখেছে । সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী (সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে) গত ৪ থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে চিন থেকে ভারতে এসেছে ৩৯০ টন চিকিৎসা সামগ্রী, যার মধ্যে রয়েছে RT-PCR সহ টেস্ট কিট, র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট, থার্মোমিটার এবং পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট(PPE) ।

ঠিক এই সময়েই ভারত এই সতর্কতা নিয়ে এটা নিশ্চিত করার জন্য এগোচ্ছে যাতে ভারতে স্টক মার্কেটের পতনের কোনও অন্যায় সুযোগ চিন না নিতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, ১৮ এপ্রিল ভারত তার সংশোধিত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নীতি ঘোষণা করে এটা নিশ্চিত করেছিল যে, সীমান্তে অবস্থানকারী দেশগুলি থেকে বিনিয়োগ কেবলমাত্র সরকারি পথেই আসবে । নিঃসন্দেহে ভারতের এই পদক্ষেপ চিনকে আটকানোর জন্যই যাতে মহামারীর প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়া দেশের ব্যবসা কিংবা উদ্যোগপতি প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিন তার প্রতিপত্তি প্রয়োগ করে কিনে না নিতে পারে । এই মহামারীর প্রকোপের সময়ই যখন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আবাসন ঋণপ্রদানকারী ব্যাঙ্ক তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠান HDFC লিমিটেডের ১৭.৫ মিলিয়ন শেয়ার কিনে নেয় চিনের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, (তাও আবার তখন যখন এই ব্যাঙ্কের শেয়ারের দামে বিশাল পতন হয়েছিল) ঠিক তার পরই ভারত এই ঘোষণা করে । চিন অবশ্য অভিযোগ করেছিল যে ভারতের এই পদক্ষেপ আদপে WTO এবং অন্যান্য বহুস্তরীয় সংস্থার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন কিন্তু ভারত চিনের এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে । ভারত যথাযথভাবে এই ব্যাখ্যা দিয়েছে যে, FDI নীতিতে তারা যে সংশোধনী এনেছে, তার ফলে ভারতে FDI আসার রুট বদল হয়েছে মাত্র । এতে কোনওভাবেই নির্বাচিত দেশগুলির উপর ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি । এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে এটাও নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা যেতে পারে যে, ওষুধ প্রস্তুতি, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাজার দখলের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থাগুলির উপর চিন নিজেই একাধিক বিধিনিষেধ জারি করে রেখেছে ।

COVID–১৯ প্যানডেমিকের প্রভাবে যে বিশ্বব্যাপী সংকট তৈরি হয়েছে, তার নিষ্পত্তি এখনই হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই । এই অভূতপূর্ব সংকটের প্রভাবে ঠিক কত মানুষের প্রাণহানি ঘটল, বিশ্ব অর্থনীতি এমনকী গোটা সমাজের উপরই বা ঠিক এর কতখানি কী প্রভাব পড়ল, কত ক্ষয়ক্ষতি ঘটল, তার যথাযথ হিসাব এখনই চূড়ান্ত করে বলা সম্ভব নয় । চিরন্তন সময় লেগে যাবে এটা জানতে এবং তার পাশাপাশি এটা আবিষ্কার করতে যে, কোভিড–১৯ প্যানডেমিককে তৈরি করা হয়েছিল না ভুলক্রমে এর সৃষ্টি হয়েছিল না কি WHO–এর গাফিলতিতে এটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল না কী গোটাটাই ছিল কোনও DG–র তরফে তাঁর পৃষ্ঠপোষককে অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়া ।

যদিও এই মুহূর্তে, যেটা স্পষ্ট হল, সেটা হল, এই সংকটের ফলে চিনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী দেশগুলির অনাস্থা বেড়ে গিয়েছে । এই সংকটের ফলে আরও বোঝা গিয়েছে আর্থিক উদারীকরণ বা বিশ্বায়ন এবং একক দেশগুলির জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে একটি সীমারেখা অবশ্যই টানা প্রয়োজন ।

এখন এটাই দেখার যে, প্যানডেমিক শেষ হওয়ার পর চিন কি সেই পুরনো পথে হেঁটেই আবার ঘোরতর ব্যবসায়ীর ভূমিকায় ফিরবে না কি বিশ্বের বাকি দেশগুলি চিনের থেকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করে চলবে ।

দিল্লি, 23 এপ্রিল: COVID–১৯ সংকটের আবহে চিন ও বাকি পৃথিবীর মধ্যে এক দীর্ঘস্থায়ী বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে ৷ এই বিশ্বাসভঙ্গের প্রাথমিক কারণগুলি হল, বিশ্বের একাধিক দেশের উপর চিনের ক্ষমতা প্রসারণ, নিজের পদক্ষেপ ফেলা এবং প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করার পাশাপাশি আর্থিক দাসত্ব বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বের উপর আধিপত্য বিস্তার করার ক্রমাগত প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যমত্য সৃষ্টি হয়েছে যে, চিনের ফলপ্রসূ অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত প্রকল্প এবং এর আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং সাহায্যের নিয়মনীতির মধ্যে গুরুতর ভূ-রাজনৈতিক তথা কৌশলগত এবং নিরাপত্তাগত উদ্দেশ্য রয়েছে । নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (OBOR) এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড (BRI) উদ্যোগ এবং তার অনিবার্য ফল অর্থাৎ ঋণের বন্ধনে জড়িয়ে ফেলার নীতিকে পৃথিবীর সব দেশ সন্দেহের চোখে দেখছে । বেশিরভাগ বড় বড় দেশই যেমন অ্যামেরিকা এবং ভারত, চিনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যে বৃহৎ ঘাটতির ঘটনা এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী ও বড় বড় সংস্থাগুলিতে চিনের ক্রমাগত অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির ঘটনায় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন । বিশেষ করে বিবাদে জর্জরিত দক্ষিণ চিন সাগর এলাকায় চিনের স্বৈরাচারী মনোভাবকে ওই এলাকায় নৌচালনা এবং বিমানচালনার স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে কারণ এই এলাকার মাধ্যমে কয়েক বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয় ।

যেভাবে COVID–১৯ মহামারী ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এবং একের পর এক দেশকে রীতিমতো গ্রাস করছে, আর তারই মধ্যে যেভাবে চিন এই সংকটের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে তাতে এই দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং সম্মানে আরও বড় ফাটল তৈরি হওয়া নিশ্চিত যা আন্তর্জাতিক মহলকে এ ব্যাপারে আরও সতর্ক করে তুলেছে । তা কীভাবে হচ্ছে, সে বিষয়ে নিচে বর্ণনা করা হল ।

আন্তর্জাতিক মহলের কিছু অংশে, নির্দিষ্টভাবে আমেরিকায়, চিনের বিরুদ্ধে যে চক্রান্তের তত্ত্বকথা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হল কোরোনা ভাইরাস চিনের ইউহানের একটি গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছিল এবং গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশ্বকে দুর্বল করার জন্য । পাশাপাশি, চিনের বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবী এই ধারণাতেও একমত হয়েছিল যে, সঠিক সময়ে এই মহামারী সম্পর্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে সতর্ক করতে চিন ব্যর্থ হয়েছিল যার ফলে আজ বিশ্বে এত প্রাণের বলি হয়েছে এবং বিশ্বের অর্থনীতির গতি কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়েছে । চিনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও উঠেছে যে তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) বিপথে চালিত করতে সফল হয়েছে কারণ এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস আড্যানম গেব্রিয়েসিস ২০১৭ সালের মে মাসে এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন চিনের সমর্থনেই ৷ তাই সংকট মোচনে চিনের ব্যর্থতাকে তিনি গোপন করেছেন । শুধু তাই নয়, এই মারণ ভাইরাস কীভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল তা নিয়ে চিনের ব্যাখ্যাকেই অন্ধভাবে কেবল সমর্থনই করেননি, একধাপ এগিয়ে এর নিবারণে চিনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন তিনি ।

ইতিমধ্যে চিনের বিগড়ে যাওয়া ভাবমূর্তিতে এই সত্য আরও কালিমা লেপন করেছে যে এই সংকটের সময়েও চিন চারিদিকে সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে । সংবাদমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়েছে যে, চিন ইট্যালিকে (যা পরবর্তী সময়ে কোরোনা ভাইরাসের ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়) সেই সব পার্সোনাল প্রোক্টেকশন ইকুইপমেন্ট (PPE) বিক্রি করেছে, যা ইট্যালি আগে কয়েক টন পরিমাণে চিনকে দান করেছিল যখন চিনে এই প্যানডেমিকের সূত্রপাত হয়েছিল ।

এই ঘটনা নিতান্তই লজ্জাজনক যদি তা সত্য হয় । এছাড়াও চিন খুব তাড়াতাড়ি প্রচুর অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা চালাচ্ছে নিম্ন গুণমানের চিকিৎসা সামগ্রী বিক্রি করে । চিনের দেওয়া ৫০ হাজার বিকল কুইক টেস্টিং কিট স্পেন ফিরিয়ে দিয়েছে । একইরকমভাবে নেদারল্যান্ডও চিনা সামগ্রী গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে কারণ তা তাদের নিরাপত্তার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি সেই সামগ্রীগুলি ।

আরও বেশি গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগের বিষয় হল বিশ্বব্যাপী বাজারে যেভাবে শেয়ারের পতন ঘটছে, তার সুযোগ নিয়ে চিন আন্তর্জাতিক বাজারে শেয়ার এবং সম্পত্তি প্রচুর পরিমাণে কিনে নিতে পারে । আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু কিছু দেশ বর্তমানে চিনা ফার্মগুলির কাছে প্রযুক্তি সংস্থাগুলির বিক্রি রুখে দিতে সচেষ্ট হয়েছে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাজনিত কারণে । আবার অন্যদিকে মহামারীর প্রার্দুভাবের পর ইট্যালি, স্পেন ও জার্মানির মতো দেশ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কড়া নজরদারি চালু করেছে, বিশেষ করে চিনের জন্য ।

পশ্চিমী দেশগুলি চিনের বিরুদ্ধে কোরোনা সংক্রমণে তাদের ভূমিকার তদন্ত দাবি করেছে, অ্যামেরিকায় ইতিমধ্যে মামলা দায়ের হয়েছে এবং অন্যান্য দেশগুলিও ভাইরাস সংক্রমণে চিনকে দায়ী করে ক্ষয়ক্ষতির জন্য চিনের কাছ থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে । অন্যদিকে, অ্যামেরিকা আবার এই সংকটের মুহূর্তে WHO এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক (যদিও অধিকাংশেরই মতে তা এড়ানো যেত) ব্যবস্থা হিসাবে আর্থিক অনুদান বন্ধ করার ঘোষণা করেছে ।

কিন্তু ভারত এ নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া দিয়েছে? চিনের বিরুদ্ধে এই আন্তর্জাতিক রোষের সঙ্গে গলা না মিলিয়ে সরকারিভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে ভারত । পাশাপাশি প্রত্যক্ষভাবে WHO এর বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনা করাও এড়িয়ে গিয়েছে ভারত ৷ পরিবর্তে (G-20 ভার্চুয়াল কনফারেন্স) WHO এর সংস্কার সাধন এবং মজবুতীকরণের হয়ে সওয়াল করেছে । এই মুহূর্তে ভারত যে যে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তার মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে নিজেদের দেশে কোভিড–১৯ এর সংক্রমণ যেন তৃতীয় স্তরে না পৌঁছয়, তার জন্য আপ্রাণভাবে চেষ্টা করা এবং অন্যদিকে রয়েছে এই মহামারীকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহত বিশ্বব্যপী উদ্যোগকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করা, দরিদ্র দেশগুলির জন্য আর্থিক তহবিল তৈরি করা, তথ্যের বিনিময় করা, যত দ্রুত সম্ভব নভেল কোরোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে এমন প্রতিষেধক তৈরির জন্য গবেষণায় সাহায্য করা প্রভৃতি ।

বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্রে ভারত একটি দ্বিমুখী তথা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এগিয়েছে । সেই মতো বিশ্বব্যপী গবেষণার অঙ্গ হিসাবে ভারত চিন থেকে এই মহামারীর আবহে অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সরঞ্জাম কেনা চালু রেখেছে । সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী (সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে) গত ৪ থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে চিন থেকে ভারতে এসেছে ৩৯০ টন চিকিৎসা সামগ্রী, যার মধ্যে রয়েছে RT-PCR সহ টেস্ট কিট, র‌্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট, থার্মোমিটার এবং পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট(PPE) ।

ঠিক এই সময়েই ভারত এই সতর্কতা নিয়ে এটা নিশ্চিত করার জন্য এগোচ্ছে যাতে ভারতে স্টক মার্কেটের পতনের কোনও অন্যায় সুযোগ চিন না নিতে পারে । উদাহরণস্বরূপ, ১৮ এপ্রিল ভারত তার সংশোধিত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নীতি ঘোষণা করে এটা নিশ্চিত করেছিল যে, সীমান্তে অবস্থানকারী দেশগুলি থেকে বিনিয়োগ কেবলমাত্র সরকারি পথেই আসবে । নিঃসন্দেহে ভারতের এই পদক্ষেপ চিনকে আটকানোর জন্যই যাতে মহামারীর প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়া দেশের ব্যবসা কিংবা উদ্যোগপতি প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিন তার প্রতিপত্তি প্রয়োগ করে কিনে না নিতে পারে । এই মহামারীর প্রকোপের সময়ই যখন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আবাসন ঋণপ্রদানকারী ব্যাঙ্ক তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠান HDFC লিমিটেডের ১৭.৫ মিলিয়ন শেয়ার কিনে নেয় চিনের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, (তাও আবার তখন যখন এই ব্যাঙ্কের শেয়ারের দামে বিশাল পতন হয়েছিল) ঠিক তার পরই ভারত এই ঘোষণা করে । চিন অবশ্য অভিযোগ করেছিল যে ভারতের এই পদক্ষেপ আদপে WTO এবং অন্যান্য বহুস্তরীয় সংস্থার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন কিন্তু ভারত চিনের এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে । ভারত যথাযথভাবে এই ব্যাখ্যা দিয়েছে যে, FDI নীতিতে তারা যে সংশোধনী এনেছে, তার ফলে ভারতে FDI আসার রুট বদল হয়েছে মাত্র । এতে কোনওভাবেই নির্বাচিত দেশগুলির উপর ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি । এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে এটাও নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা যেতে পারে যে, ওষুধ প্রস্তুতি, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাজার দখলের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থাগুলির উপর চিন নিজেই একাধিক বিধিনিষেধ জারি করে রেখেছে ।

COVID–১৯ প্যানডেমিকের প্রভাবে যে বিশ্বব্যাপী সংকট তৈরি হয়েছে, তার নিষ্পত্তি এখনই হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই । এই অভূতপূর্ব সংকটের প্রভাবে ঠিক কত মানুষের প্রাণহানি ঘটল, বিশ্ব অর্থনীতি এমনকী গোটা সমাজের উপরই বা ঠিক এর কতখানি কী প্রভাব পড়ল, কত ক্ষয়ক্ষতি ঘটল, তার যথাযথ হিসাব এখনই চূড়ান্ত করে বলা সম্ভব নয় । চিরন্তন সময় লেগে যাবে এটা জানতে এবং তার পাশাপাশি এটা আবিষ্কার করতে যে, কোভিড–১৯ প্যানডেমিককে তৈরি করা হয়েছিল না ভুলক্রমে এর সৃষ্টি হয়েছিল না কি WHO–এর গাফিলতিতে এটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল না কী গোটাটাই ছিল কোনও DG–র তরফে তাঁর পৃষ্ঠপোষককে অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়া ।

যদিও এই মুহূর্তে, যেটা স্পষ্ট হল, সেটা হল, এই সংকটের ফলে চিনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী দেশগুলির অনাস্থা বেড়ে গিয়েছে । এই সংকটের ফলে আরও বোঝা গিয়েছে আর্থিক উদারীকরণ বা বিশ্বায়ন এবং একক দেশগুলির জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে একটি সীমারেখা অবশ্যই টানা প্রয়োজন ।

এখন এটাই দেখার যে, প্যানডেমিক শেষ হওয়ার পর চিন কি সেই পুরনো পথে হেঁটেই আবার ঘোরতর ব্যবসায়ীর ভূমিকায় ফিরবে না কি বিশ্বের বাকি দেশগুলি চিনের থেকে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করে চলবে ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.